অবশেষে আমি ডিভোর্স পেয়েছি।
এখন আমার একটু দেরিতে
ঘুম ভাঙ্গলে শুনতে হয় না
আমার বাবা মা আমাকে
কিছু শেখায় নি।
এখন আমার জ্বর আসলে
কেউ বলে না রোগা মেয়েকে
বৌ করে ঘরে এনেছি।
এখন আমি ভাত রান্না
করতে গেলে কেউ এসে বলে না
চাল কি আমার
বাবার বাড়ি থেকে এনেছি কিনা।
এখন আমি বারান্দায়
একটু মন খারাপ করে দাঁড়ালে
কেউ বলে না
আমি বাইরের পুরুষ মানুষ
দেখার জন্য দাঁড়িয়েছি৷
এখন আমার মায়ের ফোন আসলেই
কেউ বলে না
এত বারবার মেয়ের খোঁজ
নেওয়ার কি আছে?
এখন আমি না খেয়ে
কারো জন্য অপেক্ষা করার পর
কেউ বলে না এসব ঢং।
এখন আমি কাঁদতে গেলে
কেউ বলে না আমি নাটক করি।
এখন আমি আমার পছন্দের
একটা জামা কিনতে গেলে
আমাকে ভাবতে হয় না
এই রংটা আমার জন্য নিষিদ্ধ।
এখন আমি চুলটা খুলে
আয়নার সামনে দাঁড়ালে
আমাকে কেউ বলে না
আমি বেহায়া।
এখন আমি রান্না করতে গিয়ে
আমার হাত পুড়িয়ে ফেললে
আমাকে শুনতে হয় না
আমি কোন কাজই পারি না।
এখন আমার মা আমাকে
একটা জামা দিলে
কেউই বলে না এত দেয়ার কি আছে?
এখন আমাকে আমার
আশেপাশের মানুষ
কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে
আমাকে মিথ্যা বলতে হয় না যে
'আমি ভাল আছি।'
এখন আমি প্রতিবাদ করতে গেলে
আমাকে আমার স্বামীর
মার খেতে হয় না।
এখন আমি আমার অধিকার চাইলে
গালি শুনতে হয় না।
এখন আমি ক্লান্ত থাকলেও
আমার উপর কারো শরীরের
খিদা মিটানোর অধিকার নাই।
এখন আমি চাকরি করতে গেলে
আমাকে কেউ বলে না
তার পরিবারের কোন মেয়ে
বাইরে গিয়ে নিজের ট্যালেন্ট দেখায়?
এখন কেউ আমাকে বলে না
আমার সার্টিফিকেট গুলো
শুধু মানুষকে বলার জন্য যে
আমি শিক্ষিত।
এখন আমাকে শুনতে হয় না
কারো ঘরের অশান্তির
কারণটা আমি।
এখন আমাকে
কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে
কেউ ওখানের বৌকে উদ্দেশ্য করে
দেখায় না আমার বাপের বাড়ি থেকে
আমাকে ভরিভরি গয়না দেয় নি।
এখন আমার মা অসুস্থ হলেও
আমাকে দুদিন যাবৎ
কাউকে বুঝিয়ে কাকুতি মিনতি করে
আমার মাকে দেখতে আসতে হয় না।
এখন আমায় শুনতে হয় না
'ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করলে
আমি সুখী হতাম,
তোমার সাথে আমি সুখী নই।'
এখন আমাকে
রাতের পর রাত জেগে
একটা ঘুমিয়ে থাকা মানুষের
মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে হয় না
এই মানুষটাকেই কি ভালবেসেছিলাম
যে আজ আমার গায়ে হাত তুলেছে?
এখন আমি শ্বাস নেওয়ার সময়
কারও অনুমতির প্রয়োজন হয় না।
তবে আমাকে এখন শুনতে হয়
অন্যকিছু।
আমি ভাল না তাই
আমি সংসার করতে পারিনি,
দোষটা আমারই।
আরো কিছুদিন নাকি আমার
সহ্য করার দরকার ছিল।
আমি এখন দুশ্চরিত্রা একটা মেয়ে।
অনেক সিঙ্গেল ছেলে
আমাকে দেখে বলে
"ডিভোর্সী মাল,
একটু পটালেই পাওয়া যাবে"৷
আমার আত্মীয়স্বজন
আমার বাবা মাকে বলে
"তোমাদের আহ্লাদে মেয়ে খারাপ হয়েছে"৷
বন্ধুবান্ধব বলে
"মা তোর সাথে মিশতে মানা করেছে,
তুই ডিভোর্সী"৷
মনের অলিগলি ঘুরে
জিজ্ঞাসুমনে একটা প্রশ্ন এখন
হররোজ ঘুরপাক খায়।
কোথায় ছিলেন আপনি, আপনারা?
যখন আমি রাত জেগে কাঁদতাম।
কোথায় ছিল আমাকে নিয়ে
এত সমালোচনা যখন আমার
চোখের নিচে কালি পড়েছিল?
কোথায় ছিলেন আপনি,আপনারা
যখন আমার স্বামী
আমাকে নোংরা ভাষায় গালাগালি করত।
কোথায় ছিল আপনাদের সম্মানবোধ?
যখন আমাকে, আমার বাবা-মাকে
প্রতি মুহুর্তে অপমান করা হত?
কোথায় ছিল আমার বন্ধু-বান্ধব?
যখন আমার বিয়ের পিঁড়িতে
আমার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী
আমার বাবা-মাকে অপমান করেছিল?
কোথায় ছিল সবার এই বিবেক?
যখন আমি শরীরের ব্যথায়
কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।
সত্যি করে বলুনতো কেউ কি ছিলেন?
সংসার ছেড়েছি অন্যায় করেছি।
যেগুলো আমার সাথে হয়েছিল
সেগুলা কি আপনাদের আইনে ন্যায় ?
তখন তো কেউ এভাবে আমাকে নিয়ে
একটু সচেতনতা দেখান নি।
এখন কেন আপনাদের
গল্পের আসরের মূল বিষয়টা আমি?
এই দুনিয়ার কোন মেয়েই চায় না
তার সংসার ভাঙ্গুক।
সুখের আশাতেই হাত রাখে অপরিচিতের।
আমিও তো তাই চাইতাম।
আচ্ছা আপনার মেয়ে অথবা বোনের সাথে
যদি এমনটা হত
তাহলে ভেবে দেখেছেন
আপনি কি করতেন !
আমার এই অবস্থায়
আমার বাবা-মা আমাকে আশ্রয় দেয়ায়
আপনারা তাদের খারাপ বলছেন?
কোনটা ভাল হতো বলুন তো?
আমি আত্মহত্যা করলে?
আপনাদের দেয়া অপয়া অপবাদের
এই আমি যদি চলে যেতাম
আপনাদের মাঝ হতে দূর-বহুদূরে?
তখন হয়তো সবার টনক নড়ত।
বলতেন "আহারে মেয়েটা ভাল ছিল।
অনেক সহ্য করেছে।
খোদা ওর আত্মাকে শান্তি দিক"।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আমায় নিয়ে
তোলপাড় পড়ত
"নিড জাস্টিস ফর অমুক-তমুক"৷
কিন্তু যারা জন্ম দিয়েছে
তারা কি করত?
আমি অন্তত বেঁচে আছি
এতেই তারা খুশী।
আপনারা কিছু হলেই
কেন মেয়েটার দোষ বের করেন?
সম্পূর্ণ ঘটনাটা
জেনেই কি সমালোচনা টা করছেন?
আমি বেঁচে আছি।
ভাল না থাকি,অন্তত খারাপ নেই।
কাঁদছি না।
আমি মনে করি এটা আমার ব্যর্থতা না।
আমি সংসার ছেড়ে এসেছি।
এটা তার ব্যর্থতা।
যে বুঝতে পারেনি
একটা মেয়ে তার জন্য
একটা পৃথিবী ছেড়ে শুধুমাত্র
তার হাত ধরে গোটা জীবন
পাড়ি দেয়ার আশা করেছিল।
সম্মান, ভালবাসা,
অধিকার ছিল আমার প্রাপ্য।
যেটা সে দিতে পারে নি।
আপনি,আপনারাও।
প্রথম প্রকাশ : ২০ অক্টোবর, ২০২০
অনলাইন প্রকাশ : ২২ নভেম্বর, ২০২০