একুশ, একুশে ফেব্রুয়ারি-
বছর ঘুরে আবারও এসেছে
একুশে ফেব্রুয়ারি।
চারিদিকে গণজাগরণ ঢেউ
উন্মাদ, উওাল বাঙালি জাতি।
কোন এক টানে, একান্ত প্রয়োজনে।

আমি তখন হাফপ্যান্ট পরা
আট বছরের ছোট্ট সে বালক।
গণজাগরণ, মিছিলে জনস্রোত-
তার কোন কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।
যে দিকে তাকাই শুধু মানুষের ঢল
প্লেকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুনে ভরপুর।
কন্ঠে তীব্রতা, চোখে-মুখে মুক্তির নেশা।

নুয়ে পড়া কুমড়ো লতাটা
আবার জেগে উঠেছে।
সজনের ডালে ঝুলে থাকা
সজনে ডাঁটা আগের চেয়ে দৃঢ়,
জনতার স্রোতে তারাও যেন
সামিল হতে চায়।
দু'মুঠো ভাতের অন্বেষণে,
যারা কোদাল কাস্তে ভারে ন্যুব্জ
তারাও আজ
সটান হয়ে মিছিলে এসেছে।

ঘরকোনে লজ্জায় আড়ষ্ট নারীরা
আজ রাজপথে,
জনতার কাতারে মিছিলে সামিল।
বিস্ফারিত নেত্র, শত্রু হননের জিঘাংসা;
ধেয়ে চলে সামনের পথে।
নবীন-প্রবীণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম
বাদ নেই কেউ।
মজুর, মুটে-কুলি, কৃষাণ, কামার, কুমোর ,
ছুতোর,ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার
কেউ বাকি নেই,
নেমে এসেছে রাজপথে।
ঢেউ হারা নদীর উত্তাল গর্জন
আছড়ে পরে তীরে।
কোন এক আহবানে জেগেছে সবাই -
কিন্তু কেন ?
কেন এ আয়োজন!

লাখো জনতার ঢল এ
ততক্ষণে ভরে গেছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ।
মিছিল থেকে স্লোগান আসছে
"আর কোন দাবি নাই
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই "।
মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত চারিদিক।

কিছুটা বুঝতে শুরু করেছি-
বাংলা ভাষার দাবিতে এ মিছিল
ফাঁকা রাজপথে তখন একটি সুর
"রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই "।
মুহুর্মুহু স্লোগানে চলছিল মিছিল।

বসন্ত বেলায় ফুলে ফুলে ছেঁয়ে আছে চারিদিক
কৃষ্ণচূড়া যেন মাথার উপর লাল প্রহরী।
ফুটেছে গোলাপ, গাঁদা, রক্তকরবী
নিজীর্ব নয়;
সজিব,প্রাণবন্ত প্রস্ফুটিত।
ভরে আছে কার্জন হল প্রান্তরে।
আমি হাঁটছি মিছিলের সাথে
আর দেখছি সব;
কন্ঠে স্লোগান
"রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই"
সকলের সাথে তাল মিলিয়ে।

সেদিন সকালে বাবার মুখে শুনেছি-
ঢাকায় কারফিউ চলছে।
কিন্ত তার মাঝে মিছিল কেন?
কিছু বুঝে ওঠার আগেই
রাজপথে পুলিশের ব্যারিকেড,
ফাঁকা গুলি।
কিন্ত মিছিল এগোতে থাকে,
সব বাঁধা উপেক্ষা করে।

তারপর-
শুরু হল গুলির আওয়াজ,
অবিরাম যেন খই ফোটাচ্ছে।
একে একে ঢলে পড়তে লাগল
ব্রজকন্ঠ গুলো।
মুষ্টিবদ্ধ হাত গুলো নিস্তব্ধ হতে লাগল।
ছোটাছুটি, আর্তচিৎকার, রক্তের বন্যা।
একি কোন সাজানো নাটক -
না বাস্তবতা?

গুলির পর গুলি আসছে,
কানের ঠিক পার্শ্ব ছুয়ে
একটা গুলি ছুটে গেল
কৃষ্ণচূড়ার ডালে।
ককিয়ে উঠলাম ব্যথায়,
শম্ভিত ফিরে পেলাম; দেখি
গায়ে দেয়া হাফ হাতা গেঞ্জিটা ততক্ষণে
রক্তে ভিজে লাল হয়েছে।
তখনো জানি না এর মানে কি?
বজ্রকন্ঠগুলো পরিণত হয়েছে
লাশের মিছিলে।

তারপর-
নিস্তব্ধ চারিদিক।
কিছুক্ষণ আগের স্নিগ্ধ সে পরিবেশ
পরিণত নিস্তব্ধ ভাগাঁড়ে।
লাশের মিছিল ডিঙিয়ে এলাম
সামনের সারিতে।
সবাই যেন ঘুমুচ্ছে।
গলগল করে রক্তের বন্যা ;
রঞ্জিত রাজপথ।
সালাম বরকত, রফিক
সব ভাইয়েরা ঘুমিয়ে।
এমনকি আমার
আদর করে পাশে থাকা সারোয়ার ভাই ;
সেও নির্বাক।  
কপালের ঠিক বাম পাশে
একটা ছিদ্র হয়েছে,
রক্ত ঝরছে।
আমি ডাকলাম-
ভাইয়া;ভাইয়া কথা বল।
কিন্তু না!
কোন সাড়া শব্দ নেই।
ছোট্ট, ভীত-শংকিত আমাকে রেখে
চিরনিদ্রায় শয্যাশায়ী।
আমি বুঝতে পারিনি এর মানে কি?
ছুটে গেলাম বাড়িতে।
জিজ্ঞাসিলাম মাকে
মা?
মা! সারোয়ার ভাইয়া রাজপথে ঘুমিয়ে
কথা বলছে না কেন?
কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা।
তার কোন অর্থ খুঁজে পাইনি।

কিন্তু আজ-
আজ আমি পরিণত বয়সে পৌঁছেছি।
একে একে পাড়ি দিয়েছি ৬১ বছর।
কালের পরিক্রমায় শিখেছি
কি ছিল সেই দিনটির মানে?

কেন কথা বলিনি ভাই সারোয়ার?
সালাম, বরকত, রফিক সহ
হাজারো ভাইয়েরা চিরনিদ্রায়
তপ্ত পীচে শয্যাশায়ী।
কেন মা আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিলেন?
বুঝেছি আজ-
সেদিনের নির্বিচারে গুলির মানে।
জনতার গনস্নোত,
মুহুর্মুহু মিছিলের প্রতিবাদি ভাষণ।

আজ সেখানটাতেই তৈরি হয়েছে
শহীদ মিনার।
একুশের প্রথম প্রহরে
লাখো জনতার ঢল নামে।
ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদ মিনারের বেদি।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
স্মরণ করে জাতির সূর্যসন্তানদের।
আর আমি ফিরে যাই
আমার হাফপ্যান্ট পরা
কচি সে বয়সটিতে।