কবিতা লিখতে হলে(রম্য)3(05-07-19)
রণজিৎ মাইতি
--------------------
গিন্নি প্রায়ই একটা অভিযোগ করে,আমার নাকি সংসারে মন নেই । সবসময় অন্য কোনও জগতে ডুবে থাকি । আমি হেসে বলি,ডুবতে কি যে সে লোক পারে গো?আমি কি পরমপুরুষ ঠাকুর রামকৃষ্ণ ? নাকি নদের চাঁদ ? এই বঙ্গে একজনই ভাবসমাধিস্থ হতেন।তিনি ওই পাগলা ঠাকুর । সংসারে থেকেও কামিনী কাঞ্চনে আসক্তি হীন।শুনেছি টাকার সংস্পর্শে তাঁর গাত্রে জ্বালা হতো । স্ত্রীকে বসাতেন দেবীর আসনে। যিনি শরীরের উপরে স্থান দিতেন মনের।তাই তো নিরুদ্বিগ্ন মুখে সহজেই বলতে পারতেন,দেহ রোগের আঁতুড়,সুতরাং শরীর থাকলে রোগ ভোগ হবেই । গলায় তখন বাসা বেধেছে দুরারোগ্য কর্কট,কণ্ঠ ক্ষীণ।অথচ ভক্তদের দিচ্ছেন বজ্র কঠিন কণ্ঠে আগামীর জন্যে প্রয়োজনীয় পথনির্দেশকা।সেই অমৃত বানীতে ভক্তেরা বিহ্বল । যিনি এমন কঠিন সময়েও অনর্গল বাক্যসুধা বর্ষণ করেন তিনিই তো প্রকৃত শিল্পী,কবি তথা ভাষ্যকার । যিনি সত্য ও সুন্দরের পথে চলেন এবং লক্ষ্য অমৃতকুম্ভ তাঁর কথাই তো হয় কথামৃত।
আমি ডুবতেও পারিনা আবার ঠিক ভাবে ভাসতেও পারিনা।ওই মাঝামাঝি টাইপ, দরকচা।যাকে সোজা কথায় বলে মধ্যবিত্ত । মধ্যবিত্তের কি কোনো ভবিষ্যত আছে ? অথবা ডোবার ও ভাসার ফুরসত ? ইঁদুর দৌড়ে হাঁপ ধরে যায়।বুক ধড়ফড় করে। চাল ডাল নুন তেল চিনি জোটাতেই হাড় মাস কালি। কখনও কখনও মুখে লেপ্টে যায় কালি । গিন্নি ও সন্তান বুঝতেই পারে না এ কালি ঘুষের,নাকি খুশের।
গিন্নির অভিযোগ আমাকে ভূত,ভবিষ্যত ও বর্তমান নিয়ে ভাবায় । ভুতপূর্ব হওয়ার আগে ভাবি,সত্যিই কি আমার ভেতর আছে কবি স্বত্ত্বা।আমি কি নির্ভীক ও নির্বিকার কঠিন বিপদে ? নির্ভয়ে দাঁড়াতে কি পারি আয়নার সামনে ? পা কতোটা সবল কিংবা শিরদাঁড়া ? এখন খুব ইচ্ছে করছে একবার আরশির মুখোমুখি হই ।একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকি নির্বাক ও নিষ্পলক।কতো কথা যে এখনও বলা হয়নি ! গিন্নি কে বলা হয়নি ভালোবাসি কিনা।লকারের চাবি ও ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের কথা । হঠাত্ রোগভোগ হলে চিকিত্সা সংক্রান্ত বিষয় ভাবায় । না,আমি আজও ডুবতে পারিনি জীবন সাগরে।যিনি পারেন তিনিই সাধক,তিনি কবি,আবার তিনিই মহাযোগী পরমহংস।
যদিও মাঝে মাঝে ডুবতে খুব ইচ্ছে করে।গিন্নিকে না বলে চুপিচুপি।কালি কলম মন, লেখে তিন জন।একদিন গভীর উৎসাহে বইয়ের ঝুলকালি ঝেড়ে বসলাম পড়ার টেবিলে।রবিঠাকুর না হতে পারি অন্তত প্রেমিকঠাকুর হতে তো অসুবিধা নেই।চেষ্টায় কি না হয়।যখন গিন্নি বাড়ির বাইরে যায় দরজা জানলা বন্ধ করে দেবী সরস্বতীর পায়ে ফুল দেই,ধুপ ধুনো দিই।কখনও গভীর রাতে অন্ধকার ঘরে খুব কাঁদি।শুনেছি কান্নায় সবাই গলে জল হয়ে যায়।কিন্তু কি আশ্চর্য একটি শব্দও বেরোয় না।আসলে আমার কান্নাটা ছিলো পুরোটাই ফেক।সাধনার চেয়ে সাফল্যের দিকে ঝোঁক বেশি ।তাছাড়া তখন জানা-ই ছিলো না যথার্থ সাধনসঙ্গিনী ছাড়া এখানে সিদ্ধি লাভ হয়না।সন্তান ঝাঁপিয়ে পড়ে পিঠে,মাথার চুল ধরে ঝাঁকায়।অতঃকিম ঝাঁপ বন্ধ করে দিই।ডুব আর হয়না।কাকস্নান সেরে যেই ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি গিন্নি ঠিকই ধরে ফেলে।আমি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করি,না মানে ওই।গিন্নি ধমক দিয়ে বলে, 'ছাড়ো,আর শিবের গীত গাইতে হবেনা।আমার সর্বনাশের মূলে শুধু তুমি।বাচ্চাটা দিন দিন বখে যাচ্ছে,সেদিকে খেয়াল আছে ? তিনার চেপেছে কাব্যের ভূত।' এখন মা সারদাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে । এক ধাক্কার বেড়ে গেলো শ্রদ্ধা কয়েক গুন।যখনই কেউ বলেন একজন সফল পুরুষের পেছনে থাকে সফল নারী, তখন আমি তা হাড়ে হাড়ে টের পাই।আমার ডোবা হয়না,ভাসাও হয়না।যা হয় সব ভাসাভাসা।বরং যা যা করি সবই ওই ভাবের ঘরে চুরি।