কবিতা কেনো লিখি !!! (24-09-2020)
রণজিৎ মাইতি
-------------
কবিতা কেন লিখি এই বিষয়ে নানান জনে নানান প্রশ্ন করেন,অনেকে উৎসাহ না চাপতে পেরে নিজস্ব সীমানার বাইরে গিয়ে এমন প্রশ্নও করে ফেলেন,--'মানে ইয়ে,বলতে চাইছি কবিতা ফবিতা করে কিছু কি হয় ?' এই কিছু হওয়াটা যে কি মনে হয় প্রশ্নকর্তার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়,নতুবা তাঁরা বিষয়ী দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যে কিছু হওয়ার থাকতে পারে হয়তো সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ,অথবা জেনেও না জানার ভান করেন।যেনো বিষয়টি এমন,যদি এখান থেকে কিছু আয়-উপার্জনের রাস্তা থেকে থাকে তবে এই বেকার সমস্যার বাজারে নিজের একমাত্র বেকার পোলাটিকে এইমাত্র কবিতা চর্চায় কোমর বেঁধে লেগে পড়তে বলি।ভায়া,ভাষা বই তো কিছু নয়! বাঙালি মাত্রেই জীবনের কোনও না কোনও সময় সবাই দু-এক কলম লিখেছেন।ওই একটু অন্ত্যমিল,ছন্দ জানলেই হলো।ঠিক 'পাখি সব করে রব'এর মতো ব্যাপার।তাছাড়া জীবনের কোথায় ছন্দ নেই?শৈশবের দোলনা থেকে যৌবনের সাইক্লিং,কিংবা লুকিয়ে প্রেমিকাকে চুমু খাওয়ায় মধ্যেও নিঁখুত ছন্দ থাকে।এমনকি রাতে বার্ধক্যের কাশিটিও কাশতে হয় উদারা-মুদারা-তারায়।কারণ পাছে বুড়ো পিতৃদেবের এলোপাতাড়ি কাশির ঠেলায় নববিবাহিত ছেলে-বউয়ের সুুুুখের খয়ার ভেঙে যায়।

যাক সেসব কথা,অপ্রাসঙ্গিক কথায় না গিয়ে আসল কথায় আসি।আমার এই এক দোষ মাঝে মাঝে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাই,তার জন্যে প্রথমেই মার্জনা চাইছি।হাঁ যে কথা বলছিলাম,ওই কবিতার কথা।বলে রাখা ভালো আমার এই অপ্রাসঙ্গিক কথার কারণে কোনও দিন কবি হতেই পারলাম না।কারণ কবিতা কখনও বেশি কথা পছন্দ করে না।তার চাই যথাযথ জায়গায় যুত্সই শব্দ।অথচ দেখুন,বাঙালি মাত্রেই কেউ প্রেমে অসফল হয়ে কবিতা লিখছেন তো কেউ ব্যবসা ডুবিয়ে।আবার কেউ নিছক বেকারত্বের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে লিখেছেন তো কেউ চাকরি খুইয়ে।সুতরাং তাদের কাছে কবিতা লেখা কোনও ব্যপারই নয়,জলভাত।অতএব যদি উপার্জনের পথ সুগম থাকে তবে ছেলেপুলেরা না করলেও এই বুড়ো বয়সে নিজেই নিজের অর্জিত জ্ঞান একটু বমন করি।বুড়ো হাড়ে কম অভিজ্ঞতা তো সঞ্চয় হলোনা।তাছাড়া মাতৃভাষা কে না জানে।

যারা এমন ভাবনায় মশগুল থাকেন তাদের সরাসরি বলি,বন্ধু কবি হতে না পারি তবে এতোদিনের চর্চা থেকে যেটুকু বুঝেছি কবিতা কখনও উপার্জনের পথ দেখাতে পারেনি,এখনও সেই পরিবেশ অনুকূল নয়।স্বয়ং কবিগুরুও এখান থেকে কিছু আয়-উপার্জন করতে পেরেছেন বলে আজ পর্যন্ত শুনিনি।বরং কবিতা কালে কালে কবিকে করেছে রাস্তার মানুষ।অনেকেই আবার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া যেটুকু বিষয় আশয় ছিলো সেটুকু খুইয়েই হয়েছেন তৃপ্ত।

আসলে স্বভাবকবি মাত্রেই মননে সন্ন্যাসীপ্রতিম, তিনি একদিকে যেমন ত্যাগী,তেমনি যোগীও বটে।তিনি পরমহংসের মতো 'টাকা মাটি,মাটি টাকায় বিশ্বাসী'।এবং গভীরভাবে বিশ্বাস করেন অর্থই অনর্থের মূল,যা সাধনার পথে অন্তরায়।তাই কবি অর্থ নয়,মোক্ষ চায়।কাম নয়,প্রেমেই অন্তর থাকে সদা পরিপূর্ণ।আমাদের রবিকবিও সেই আলোক স্পর্শ করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে তা বুঝেছিলেন।হয়তো কবিগুরুকেও আমাদের মতো এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার।
তাই তিনি তাঁর বিখ্যাত 'পুরস্কার' কবিতায় নিপুণ আঁচড়ে ফুটিয়ে তুললেন কবি ছবি।
অভাবের সংসারে হাসি ফোটাতে নিজ পত্নীর আবেদনে সাড়া দিয়ে যে কবি বাধ্য হয়ে গেলেন রাজ সমীপে।কিন্তু শেষে কি তিনি পারলেন পুরস্কার স্বরূপ রাজার দেওয়া মণি মুক্তো নিয়ে বাড়ি ফিরতে ? এমনকি কাব্যাপ্লুত রাজার দেওয়া রাজ সিংহাসনটি পর্যন্ত হেলায় প্রত্যাখ্যান করে যখন ভোলেভালা কবি বাড়ি ফিরছেন,তখন তাঁর গলায় দুলছে কেবল একটি ফুলের মালা।সেটুকুও তিনি চেয়ে নিয়েছেন প্রিয় পত্নীকে উপহার দেওয়ার জন্যে।আসলে কবির কাছে প্রেমকে অমরত্ব দিতে এরচেয়ে বেশি কিছুরই প্রয়োজন নেই।বলুন এমন ভাবনা কি সাধারণে ভাবতে পারেন ?

হাঁ পারেন,ব্যতিক্রমী কেউ কেউ পারেন।যিনি পারেন কোনও সন্দেহ নেই তিনিই স্বভাবকবি,কালের যাত্রীক।বাদবাকি যারা গলায় ডিগ্রি ঝুলিয়ে রাজদরবারে আসন অলংকৃত করেন,কিংবা কখনও ক্ষমতাবান মন্ত্রী আমলার পেছনে ঘুরঘুর করেন কোনও একটা 'শ্রী'র লোভে।তারা আসলে কবির মতোন ।অর্থাৎ কবি সাজেন,কিন্তু কবি নন।তা ঠিক এরা বাতানুকূল গাড়ি-বাড়ির মধ্যে বিলাস ব্যসনে সুখে দিন কাটান,কোনও কোনও ছদ্মকবি বাড়িতে পত্নী থাকা স্বত্ত্বেও ক্ষমতার ইন্দ্রজাল দেখিয়ে জড়িয়ে পড়েন ব্যভিচারে।মুখে হাজারো প্রেমের কথা বললেও নারী শরীর এদের কাছে খেলনা।আসলে প্রকৃত অর্থে এরা হলেন স্তুতিকার এবং ক্ষমতা লোলুপ।খ্যাতির মোহে স্তুতি-বন্দনায় এতোটাই নিমগ্ন থাকেন,একটি বারের জন্যেও বুঝতে পারেন না চাটুকারিতার দ্বারা 'শ্রী'র চেয়ে দিন দিন হতশ্রী চেহারাই ফুটে ওঠে। বলুন কখনও কি লালন,রামপ্রসাদ কিংবা আদিকবির কলম থেকে 'কম খেলে নাই খেদ,বেশি খেলে বাড়ে মেদ।' অথবা 'পড়াশোনা করে যেই,অনাহারে মরে সেই'এর মতো লেখা বেরিয়েছে?

জবাবে বলি,'না'।জানবেন যাদের হৃদয় পূর্ণচন্দ্রের মতো প্রেম ও মানবতার আলোয় পূর্ণ,ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত যাদের শরীর ও মনন,তাঁরা কখনও স্তুতির পথ মাড়ান না।বরং জীবনের সব সেরা সম্পদ খুইয়েই দাঁড়ান মানুষের পাশে।আসলে চারণকবি মাত্রেই এমন।চারণভূমির মাটি হলো এদের মা,মায়ের ব্যথা আপন হৃদয়ে ধারণ করে তা উপশমের জন্যে করেন প্রাণ প্রণিপাত।এতোটাই বাহ্যজ্ঞানশূণ্য কঠিন কঠোর সাধনায় নিমগ্ন থাকেন উইপোকাও কাঠ ভেবে ঘিরে ধরে কবির অস্থিমাংসহীন কঙ্কালসার দেহ।গড়ে ওঠে উইঢিপি।অথচ সাধনার জোর এমনই  মরা মরা থেকে একদিন রাম রাম আলো উৎসারিত হয়।তখনই কবিও হন অমর,সাথে কাব্যগাথা।বাদবাকি যা দেখি তা সাময়িক,সবই কালের স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যায়।তা সে যতো বড়োই রাজকবি,সভাকবি,শ্রীকবি,পদ্মশ্রী বা মহাপদ্মশ্রীই হোন দিনশেষে বড়াই করার কিছুই থাকেনা।আপনি যতোই বিস্মিত হোন এটাই সত্য,এটাই শাশ্বত । এভাবেই অতীত পথ মাড়িয়ে অনন্তের দিকে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছেন হোমার,বাল্মীকি প্রতিভা,প্রিয় বেদব্যাস।

তবে কি কবিদের সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই? একেবারে যে কিছুই নেই তা বলতে পারিনা। নদীর যেমন এক কূল ভাঙে অন্য কূল গড়ে,তেমনই কবি তার সঞ্চিত মেধাসম্পদ বিলিয়ে পাওয়া তৃপ্তি টুকুকেই মনে করেন সেরা সম্পদ।মানবতা যার লোহিত সাগরে,প্রেম দখল করে আছে যার অন্দরমহল,এবং আনন্দ যার আকাশ জুড়ে,বলুন তেমন মানুষের এরচেয়ে বড়ো সম্পদ আর কি হতে পারে ?  

সুতরাং যারা এমন প্রশ্ন করেন,তেমন বিষয়ী মানুষের জন্যে কবিতা কখনোই নয়।বরং
তাদের সরাসরি বলুন,বন্ধু আপনি কোমর বেঁধে লেগে যান তেজারতী কারবারে।সাইলকের দরবারে কড়া নাড়ুন।দু-দিনেই ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়ে যাবেন।নতুবা রাজনৈতিক নেতাদের ছত্র ছায়ায় আশ্রয় নিন।মাইক হাতে একবার যদি বাগ্মিতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন তখন
আপনার আগামীর রাস্তা সম্পূর্ণ মসৃণ।জানবেন জনতার সামনে বক্তৃতাও কিন্তু ভাষা শিল্প।

তবে কবিতা লেখা ও নেতার বক্তৃতা কখনোই এক বিষয় নয়,কবিতা হলো ফাইন আর্ট।প্রকৃত জায়গায় যুত্সই শব্দ প্রয়োগ করতে না পারলে পুরো কবিতাই ঝাড়,এবং ছন্দের যথাযথ প্রয়োগও জরুরী।তাছাড়া কবিতায় মিথ্যার কোনও স্থান নেই।কিন্তু ছন্দহীনতাই বক্তার তথা মঞ্চের সেরা সম্পদ। জনসমক্ষে আপনি যতো মিথ্যা কথা বলবেন ততোই উঠবে হাততালির ঝড়।এবং মশা মারার ভঙ্গিতে যতো দ্রুত করবেন ডাঁয়ে-বাঁয়ে হাত ও হৃদয় ততোই আপনি ওজনদার নেতা।দেখবেন মিথ্যা কথার সমানুপাতিক হারে চড়ছে নেতার বাজার দরও।এবং যতোটা আপনি বড়ো নেতা ততোটাই বাড়ছে আপনার গাড়ি,বাড়ি ও ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স । দেশ ও দশের টাকা গোপনে সুইস ব্যাংকে সরিয়েও আপনি হবেন জনদরদী,দেশহৈতেষী।আমৃত্যু গুনোত্তর প্রগতিতে বাড়বে আপনার সম্পদ।সাত পুরুষ কেনো চোদ্দ পুরুষের সাধ্য নেই তা শেষ করতে পারে।

অতএব যারা উপার্জনের ভাবনা নিয়ে কবি হতে চান তাদের জন্যে কবিতা কোনো পথই নয়,বরং বিপথ।কবি মাত্রেই সম্পূর্ণ নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা।তিনি যেমন অন্ধকারের ভেতর আলোর সন্ধানী,তেমনই ঘন কুয়াশার ভেতর জলবিন্দু।জানেন এই জলকণা ও আলোর ভেতরেই লুকিয়ে আছে রামধনু রহস্য।এই ইন্দ্রিয়াতীত রহস্যের সন্ধানই হলো কবির কাজ।তা সে ঈশ্বর হোক কিংবা অনীশ্বর। সে কারণে রণে বনে জলে জঙ্গলে যেতেও তিনি পিছপা নন।তার চেতনার আলো এতোটাই তীব্র যে যেখানে কেউ পৌঁছাতে পারেন না সেখানেই তিনি পৌঁছে যান একান্তে।অনেক সম্পদের অধিকারী হয়েও যেখানে ঘুমাতে পারেননা ধন্যাঢ্য,সেখানেই ঘুমান হাভাতে কবি।যেমন মৌমাছি ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে ফুলের উপর।

আসলে কবি মাত্রেই সুন্দরের উপাসক কিন্তু বিলাসী নন।অনাসক্তির মধ্যেই তিনি সঞ্চয় করেন শক্তি।তাই যারা বলেন কবি মাত্রেই শাক্ত,তারা ভুল কিছু বলেন না।আবার যারা বলেন কবি মাত্রেই শৈব,তারাও যথার্থ কথাই বলেন।আসলে শৈব বলুন কিংবা শাক্ত আসলে এরা উভয়েই সুন্দরের উপাসক।বিলিয়েই আনন্দ।নিজেকে,সাথে চেতন ও মগজ।তাই দিন রাত নিমগ্ন সাধনার দ্বারা করেন আত্ম-শব ব্যবচ্ছেদ।জীবিত-মৃতের ভেদরেখা এতোটাই পরিষ্কার,ব্যবচ্ছেদে প্রয়োজন হয়না ছুরি কাঁচি।মানসনেত্রের নির্গত লেজার দিয়ে ফালাফালা করেন নরক নামক অর্বুদ।আর সেখানেই রচনা করেন সুন্দর । জানবেন কল্পতরু সুন্দরের নাম।যেমন মেঘ বলাহক,বজ্র জিমূদ,আকাশ নিলীমা।তেমনই কবি ও সুন্দর কোথাও এক একাকার ।

কবি মাত্রেই সবকিছুতে বিলিন ও নিলীন।যদিও কোথাও কোনো নির্লিপ্তির অবকাশ নেই।তিনি চেতনায় আস্তিক হোন,কিংবা নাস্তিক সবার উপরে রাখেন মানবতা।মানবতার জ্যোতির্ময় আলোয় পূজো করেন আপন জীবন দেবতার।তার জন্যে কবি পোড়েন,কালে কালে নিজেই হয়ে ওঠেন আত্মারতীর সমীধ।আপনি কি হতে চান তেমন মানুষ ? তাকান লালনের দিকে,রামপ্রসাদের চোখে চোখ মেলান।দেখবেন তাদের সাধনার প্রদীপ্ত আলোয় আপনি শিউরে ওঠবেন।ঝলসে যাবে আপনার মুখ,লিঙ্গসহ সারা শরীর।লিঙ্গশরীর তখন ভয়কাতর,কারণ সেই মুহূর্তে আপনি অনুভব করবেন লিঙ্গ ও ব্রহ্ম এক একাকার,অর্থাত্ অভেদ ।দেখবেন যেই মুহূর্তে ভয়ে পিছিয়ে আসছেন,জীবন দেবতাও চিৎকার করে বলছে, 'হেরো,হেরো।'

কবির জীবনে হার নেই,হারিয়ে যাওয়া নেই।
সুতরাং হাহুতাশও নেই ।তাছাড়া ব্যক্তিগত জয় নিয়ে কখনও ভাবে না কবিরা।কেবল সমষ্টির ভাবনা থেকে আমরণ লড়াই আছে।তাই কবি মাত্রে মল্লযোদ্ধা না হলেও আজীবন কলম সৈনিক।শাসকের রক্তচক্ষু তার ভীষণ চেনা।যতোই আপনি এগোবেন ততোই অস্পষ্ট চেনা ফাটক হয়ে ওঠবে চেনা মামাবাড়ি।যেমন কালের যাত্রায় ভারভারা রাও ও মামাবাড়ি হয়ে ওঠছে সমার্থক।

তবুও কবি দমে যাওয়ার পাত্র নয়,কারণ তাকে প্রথম লড়াই লড়তে হয় নিজের সাথে।আজন্ম মগজে যার আগুন,হৃদয়ে যার দাবানল সে কি অপরকে পুড়িয়ে কখনও নিজে থাকতে পারে অক্ষত ? পুড়তে পুড়তেই চৈতন্যের মতো উর্দ্ধবাহু হয়ে মিশে যান মানব সমুদ্রে।কখনও সরযু নদীর তীরে বসে করতে থাকেন মরা মরা।অবশ্য এতোটা কঠিন পরিশ্রমের পর শরীরের বাহ্যিক কিছু ক্ষয় হলেও ভেতরে ভেতরে সম্পূর্ণ তরতাজা।মুখে সূর্যের দীপ্তি। দধীচির মতো কবিঅস্থিতে নির্মিত বজ্রবান যখনই আছড়ে পড়ে সমাজের বুকে তখনই সমগ্র সমাজও সমস্বরে বলে ওঠে "আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন"।হয়তো আমজনতার মুখে এই পদচিহ্নের আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হোক এটাই চান কবি ভীষণভাবে।তাই কবি তাদের মুখ হয়ে যান। কাউকে না কাউকে তো মুখপত্র হতেই হয়।

অবশ্য মুখপত্র হওয়া কবির একান্ত বাসনা কখনোই নয়।হয়তো এই একান্ত অন্তর্লীন যাত্রায় কোথাও লুকিয়ে আছে খ্যাতি নামক মোহ,কিন্তু তা সাময়িক।কারণ জীবন সম্পর্কে সচ্ছতা তাকে আলোয় ফেরায়।স্বচ্ছতাও এক সুক্ষ সূঁচিমুখ,তা এতোটাই তীক্ষ্ম ও দীপ্ত যা নিমেষে এফোঁড় ওফোঁড় করে বদ হাওয়া।তখন সে পুনরায় মনোনিবেশ করে সুন্দরে,সত্য ও শিবে।

এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন,দিন শেষে একজন কবিও কিন্তু মানুষ । ক্ষুধায় যেমন নির্লিপ্ত থাকা যায় না,তেমনই হাওয়া খেয়েও বাঁচেনা জীবন মেশিন।যেখানে জীবীকার কোনও সংস্থান নেই,অথচ এতো শ্রম,এতো দহন তবে কেনো এক একজন মানুষ ডুবে থাকে আশ্চর্য এই ভাবজগতে!একি নিছক সুন্দরের টান ? নাকি একান্ত মুদ্রাদোষ ? হয়তো কবির নিজের কাছেও নেই এই কেনোর প্রকৃত জবাব।তাই তিনি নিয়তি বিশ্বাসী না হয়েও মনে করেন এটাই তার নিজস্ব নিয়তি এবং আলো অন্ধকারে যেখানেই যান তার মাথার ভেতর 'স্বপ্ন নয়,এক বোধ খেলা করে'।এ বোধ কিসের বোধ ? নিছক ভালোবাসা ? যেখানে বোধ আছে কিন্তু বোধি নেই,সুক্ষ অনুভূতি আছে অথচ স্পর্শ নেই,হয়তো শীতের নরম পশমিনা রোদ্দুরে কেবল একটু শরীর এলিয়ে দেওয়ার অবকাশ আছে ।

আসলে কেনো যে মানুষ ভালোবাসে সেটাই সে আজও জানেনা।এ এক গভীর রহস্য। সে কবিতা হোক কিংবা নারী।নীরা হোক কিংবা বনলতা,অথবা সুরঞ্জনা,সুচেতনা।তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়,বেড়ে যায় চাবির গোছা।কিন্তু ভালোবাসার তালা কখনও খোলেনা।বরং কুহক যতো বাড়ে ততোই বাড়তে থাকে আকর্ষণের পারদ।ছোটে কু ঝিক ঝিক,লোকাল থেকে বুলেট ট্রেনের গতিতে। অথচ তখনও কি অসাধারণ দৃপ্ত ভঙ্গিতে বলছি, 'সুরঞ্জনা,তুমি আজও আমাদের পৃথিবীতে আছো','সুচেতনা,তুমি এক নির্জন দ্বীপ।' আবার সেই কবিই যখন দিন শেষে জীবনের সব লেনদেন ফুরিয়ে গেলে ফিরে আসেন নীড়ে,পা রাখে গদ্যময় ক্ষুধার রাজ্যে,নিশ্চিত বুঝতে পারেন সুচেতনা আসলে আজও এক 'দূরতম দ্বীপ'।যেমন গোলাপ ছুঁই,কিন্তু কোনও ভাবেই কি ছুঁতে পারি গোলাপের অনিন্দ্য সৌন্দর্য ? এই না পারাটাই তাকে নাছোড় করে।হয়তো এভাবেই বেঁচেবর্তে আছে কবি ও কবিতা ।হয়তো এভাবেই বেঁচেবর্তে থাকবে বছরের পর বছর,যুগের পর যুগ । যতদিন পৃথিবী থাকবে,ফুল পাখি ঝর্ণা ও পৃথিবীর মানুষ ।হে ভাবজগত,তুমি কেনো যে অনাদি অনন্তকাল কিছু সৃষ্টিছাড়া মানুষে এভাবে সৃষ্টিতে ভাসাও তা আজও সত্যিই রহস্য !