স্বপ্ন শ্রম
কবি--দীপঙ্কর বেরা
আলোচক-- রণজিৎ মাইতি
-------------
প্রিয় কবি দীপঙ্কর বেরা তাঁর "স্বপ্ন শ্রম" কবিতায় কম কথায় সুন্দর ভাবে ও সফলতার সহিত 'সাম্য ও শান্তি'র গান গাইলেন । এখন প্রশ্ন উঠে আসে কোথাও নিশ্চয়ই অসাম্য ও অশান্তির বীজ রোপিত হয়েছে যা কবি মনে অস্বস্তির কারণ। স্বতঃই নেমে আসি বাস্তবের মাটিতে ।
মাটিতে পা দিয়েই কবি বলতে শুরু করলেন,--
"চল চল টেনে নিয়ে চল এখন এ বর্তমান"
লক্ষ্য করুন কবির বক্তব্যটি, 'চল চল' দিয়ে শুরু করলেন । কি অসম্ভব তাড়া,কবি মানবেতিহাস ও বর্তমান অবস্থা দেখতে দেখতে তিতিবিরক্ত।তাই তো কবির আর তর সইছে না । দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অভিমানী জীবন,অনেক পুরনো দাবী যা পুরণ হয়নি (সাম্য,মৈত্রী,স্বাধীনতা,শান্তি ইত্যাদি ইত্যাদি) তা পাওয়ার জন্যে উদ্গ্রীব । তাই তো সভ্য সুশীল সমাজের প্রতিনিধি কবি চান যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পচা গলা অন্তঃসার শূন্য ধারণা গুলো যার শেকড় বর্তমানেও চারিয়ে আছে সমাজের অনেক গভীরে তা খুব শীঘ্রই টেনে ছুড়ে ফেলে দিতে চান পূণ্যতোয়া গঙ্গায় । তাই কবি অনায়াসে বলতে পারেন চল চল আর তর সইছে না,ভেসে যাক বস্তাপচা ধারণা যা মানব কল্যাণে তো লাগবেই না বরং সমাজে জঞ্জাল স্বরূপ ক্ষতি করে,বিভেদের পাঁচিল তুলে দুর্গন্ধ ছড়ায় তা ছুঁঁড়ে দিই।
কোনও সন্দেহ নেই এমন একটি মানবিক কবিতার চমত্কার শুরু।তার পর পরই কবি ব্যক্ত করলেন সেই আশাবাদ যা মানব সমাজ কে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়।
"মানুষের কাঁধে ভর দিয়েই তো আসবে ভোর"
কবি কি গভীর প্রত্যয়ী দেখুন।বর্তমান এই যান্ত্রিকতার যুগেও তিনি ভরসা করছেন সেই মানুষেরই উপর যাদের শক্ত কাঁধই পারবে নতুন ভোর আনতে।
এবার মানবদরদি কবি সমস্ত মানুষকে ভাই সম্বোধনে ডাক দিলেন তাঁর স্বপ্নের সমাজ গড়ার কাজে হাত লাগাতে । কি চমত্কার সেই আহ্বান,ওরে ও ভাই আয় সবাই কোমর বেঁধে লেগে যাই জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজে। সমাজ নামক "বেলাভূমিতে তোরা সব লাগা জোর।" বিগতের "ঢেউ ঢেউ খেলা" যা সামগ্রিক মঙ্গলের কথা না ভেবে মুষ্টিমেয় মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছে সেই সব আমাদের স্বপ্নের শ্রমে চূর্ণ করি। পরিণামে রচনা করি সাম্য ও শান্তির লীলাক্ষেত্র ।
কোনও সন্দেহ নেই কবিতাটি কম কথায় সুচতুর নির্মাণ । এবং সাবলীল ভাষায় প্রাঞ্জল কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবি দীপঙ্কর বেরা মহাশয়কে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই ।
কবিতাটি সম্পর্কে আমার কিছু ব্যক্তিগত মতামত জানিয়ে আলোচনা শেষ করবো । মনে হয় তা না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায় ।
প্রথমত কবিতাটি মুক্ত ছন্দে লেখা । যেহেতু আমি নিজেই এমন ছন্দে লেখা পছন্দ করি,তাই আমার মনে হয়েছে মুক্ত ছন্দে লিখতে গেলে কবিতায় যেসব জায়গায় শব্দের উপর জোর দেওয়া দরকার তা দিতেই হবে । তা না হলে মনে হবে ছন্দপতন হয়েছে । তাছাড়া সঠিক জায়গায় সঠিক শব্দ প্রয়োগ । সেটি যথাযথ ভাবে না করতে পারলে মনে হবে কবিতাটি দুর্বল ।
যেমন এই কবিতাটি সম্পর্কে শব্দ নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই,যথাযথ । কিন্তু জোরের জায়গা গুলোতে বাঁধন ঠিক হয়নি মনে হলো।
যেমন----
"চল চল টেনে নিয়ে চল এখনই এ বর্তমান"
দ্বৈত "চল" শব্দে,আবার "টেনে নিয়ে চল" এমন কথায় যাওয়াটা চমত্কার ফুটিয়ে তুলেছেন । কিন্তু 'এখন' এর জায়গায় 'এখনই' লিখলে একেবারেই তর সইছে না প্রকট হয় বলে আমার মনে হলো। আর বর্তমানের আগে এখানে "এ" শব্দটি যথার্থ প্রয়োগ । অর্থাত্ এ বর্তমানকে তাচ্ছিল্য করি।
দ্বিতীয় লাইন
------------
"ওই তো দূরে দাঁড়িয়ে আছে জীবনের অভিমান"
"তো" শব্দটি বাক্যের অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করলাম ।
তৃতীয় লাইন
-----------
কোনও বক্তব্য নেই,চূড়ান্ত । যেনো সঙ্গীতের শমে এসে গেছি।
চতুর্থ লাইন
----------
"ওরে ও ভাই বোনেরা,এই প্রিয় বেলাভূমিতেই এবার উগরে দে তীব্র বিষ"
প্রথমে বলি কবি কি লিঙ্গ বৈষম্য স্বীকার করেন ? মনে করেন এমন মহান কাজ বোনেদের দ্বারা হবে না । তাই তিনি বোনেদের ডাক দিলেন না।মনে হলো অবচেতনের খেলায় কবি হেরে গেলেন
লক্ষ্য করুন এখানে 'এ' না করে "এই" করলাম কারণ প্রিয় বেলাভূমির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে। এছাড়া বেলাভূমির উপর জোর দিতে একটা 'ই' কার দরকার মনে হলো।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ
-----------
"পেছনেই পড়ে থাক যত্তোসব ঢেউ ঢেউ খেলা
এই মহাজীবন হোক সাম্য ও শান্তির মিলনমেলা"
আমার ভাবনায় যা যা মনে হয়েছে আলোচনায় বলে গেলাম । কবি এবং এই আলোচনার পাঠক হিসেবে কারুর কিছু বক্তব্য থাকলে মতামত দিয়ে আলোচনাটিকে সমৃদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে শেষ করছি ।
এমন সুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে পুনরায় অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই