অনেক দিন পর আলোচনার পাতায় ফিরলাম।ফিরলাম না বলে বলি,ফিরিয়ে আনলো প্রিয় কবি স্বপন বিশ্বাসের কবিতা "পাথর" ও প্রিয় কবি বন্ধু রহমান মুজিবের হার্দিক আবেদন। "পাথর" নামক এমন সুন্দর কবিতাটি নাড়িয়ে দিল আমার ভেতরের জগদ্দল পাথরটিকে।যেমন অহল্যা রামচন্দ্রের স্পর্শে ফিরে পেয়েছিলো পূর্বের অবস্থা।জানিনা এ সাময়িক কিনা,হয়তো এই অভাগা দেশটার মতো আমিও ফিরে যাবো পাথর জীবনে ।
মনে হয় সেখানেই প্রিয় কবি স্বপন বিশ্বাসের হতাশা,হতাশ থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজতে গিয়ে ঢুকে পড়লেন ইতিহাস চর্চায়।কবির অনুভবে---
"কবে থেকে পাথর হয়ে শুয়ে আছি
ঘিরে ঘিরে আগাছার ঝাড়,দেখেও দেখিনি।"
এখানে কবি আমি থেকে আমরা,আমরা থেকে সমাজ ও দেশের মুখ হয়ে গেলেন।কি দেখলেন যা কবি মনে বিষাদের কারণ? দেখলেন আমি নামক দেশটা (ভারতবর্ষ) আজও জগদ্দল পাথরের মতো,নড়েনা চড়েনা।চারপাশে অশিক্ষা,অস্বাস্থ, কুসংস্কার নামক আগাছায় ঢাকা পড়ে গেছে অতীতের উদ্ভাসিত মুখ।রাজনীতির চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে আস্ত একটা দেশ ।দিন দিন জমে উঠেছে শ্যাওলা,ফার্ণ,মস।অথচ আমরা দেখেও দেখিনা । যদিও সুনাগরিক হিসেবে গিয়ে দাঁড়াই ভোটার কার্ড হাতে গণতন্ত্রের উৎসবে।আসলে এটাই কবিকে চিন্তায় ফেলে। কতো দিন আরও কতো দিন এভাবে আমরা নিজেরাই দেখেও না দেখার ভান করে থাকবো, দেশটার অতীত কি এমনই ছিলো ?
এই অতীত ভাবনাই কবিকে টেনে নিয়ে গেলো বাংলার রেনেসাঁস বা নবজাগরণের যুগে । মূখ্যতঃ উনবিংশ শতক। তখন দেশটা পরাধীন ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত । কবি দেখলেন এই বন্ধা দেশে একে একে জন্ম নিচ্ছে বীর সন্তান । হৃদয়ে সিংহের বিক্রম। বর্তমান সমাজের অবক্ষয় দেখতে দেখতে কবি মনে অনেক যদি, কিন্তুর প্রশ্ন ভিড় করে । যে প্রশ্ন গুলো কবিকে ভয়ের আবহে ঠেলে দেয়।যদি এই সব মহাপুরুষেরা জন্ম না নিতেন বাংলার পুণ্য ভূমিতে তবে আমাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো ? তাই কবি স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকেন,---
"ভাবি,ঈশ্বর,রামমোহন ---- সেদিনও যদি পাথর হয়ে থাকতেন ?
সুভাষ যদি বাড়ির বাইরে একটুও না বেরোতেন ?"
আমরা আজও পড়ে থাকতাম কোন সে বর্বর যুগে । সতীর চিতা ঘিরে করতাম উল্লাস নৃত্য,বাল্যবিধবা আজীবন ভোগ করতো অকাল বৈধব্য যন্ত্রণা,আর দেশটা পরাধীনতার নাগপাশে থাকতো বন্দী। ভাবতে বসলে গায়ে কাঁটা দেয় বৈকি । সেই কাঁটা কবিকেও যন্ত্রণা দেয়।গভীর যন্ত্রণাতে কবি খোঁজেন উত্তোরণের পথ যা আমাদের বাঞ্ছিত । কোথাও কি নেই মুক্তির পথ ? এখনও তো শুয়েই আছি,শুধু শোয়া নয় দিচ্ছি কুম্ভকর্ণের রেকর্ড ধুলোয় মিশিয়ে।এবার কবি টেনে আনেন পুরাণ।
"কখন কোন রামচন্দ্রের পায়ের ছোঁয়ায় ম্যাজিকটা হবে!"
কবিকে অনেক ধন্যবাদ জানাই এমন সুন্দর একটা লাইন উপহার দেওয়ার জন্যে ।আবেশিত হই বারবার আপনার শিল্প বোধ ও সমাজ সচেতনতার কথা ভেবে । এই একটা লাইনেই কতো আশা নিরাশার দোলা,ব্যঙ্গ,কৌতুক ও বিস্ময় ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে "ম্যাজিক" শব্দটির প্রয়োগ লা জবাব । মনে হয় শুধু এই একটি কবিতার জন্যেই আপনি বাংলা কবিতার আকাশে জ্বলজ্বল করবেন অনন্তকাল।
এবার কাব্যের কথায় আসি,এখানে কবি সুকৌশলে অনেক অব্যক্ত কথা বলে গেছেন । রামচন্দ্র,আমরা সবাই জানি তিনি অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র । পিতৃসত্য পালনের জন্যে বনবাসে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁর পায়ের স্পর্শে পাষাণী অহল্যা ফিরে পেয়েছিলেন নবজীবন । এবং বনবাস থেকে ফিরে এসে তিনি নাকি এই মর্ত্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুখের রাজ্য ।তাই কোনও শাসন ব্যবস্থায় ভালো কিছু দেখলেই রামরাজ্য হয় দৃষ্টান্ত স্বরূপ। মনে হয় কবি সেখানেই করলেন চমত্কার ব্যাঙ্গ । যদি তেমন রাজ্য এই ভারতবর্ষে কোনও কালে ছিলো তবে আজ দেশটার এই হাল কেনো ? অথচ আজ জাতপাত ও অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে জন্ম নেওয়া সন্ত্রাসবাদে দেশটা জীর্ণ ও দৈন্য । রামমন্দির ও বাবরি মসজিদের জিগির তুলে সাধারণ ছাপোষা মানুষদের ভুলিয়ে রাখার ফিকির। একবার ধর্মের আফিং এর নেশায় ডুবিয়ে দিতে পারলেই সে প্রশ্ন করতে ভুলে যাবে,এই দেশটার বুকে এতো ক্ষুধা কেন ? এতো বেকারী,অস্বাস্থ,অশিক্ষা কেন ?
এইসব দেখতে দেখতে কবি বিতশ্রদ্ধ ও হতাশ হন। আবার দেখেন আশার আলো। এই আলো আঁধারিতে কবি প্রশ্ন করেন আগামী ভারতবর্ষে কেউ কি এসে দেখাবেন রামরাজ্য নামক নয়নাভিরাম ম্যাজিক ? হোক অহল্যার মতো তেমন যুগাবতারের পাদষ্পর্শে ভারত নামক দেশটার পাথুরে জীবনের মুক্তি ।
ভারী সুন্দর কবিতা । চমত্কার নামকরণ । এমন মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা । এবং আগামীতে এমনই নান্দনিক কাব্যে পাতা ভরিয়ে তুলবেন সেই আশা পোষণ করি। আবারও শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানাই ।