আজ আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছি অনেকেই জানিনা খাগের কলম কি বস্তু ।কলমের বিবর্তন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলেই একমাত্র জানতে পারি কিভাবে খাগের কলম থেকে ঝরনা কলম,বল পেন হয়ে এখন আমরা লিখি কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনের কিপ্যাডে।কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন তালপাতার উপর খাগের কলম দিয়ে দোয়াতের কালিতে চুবিয়ে চুবিয়ে মানুষ লিখতেন ।শ্রদ্ধেয় কবি আগুন নদী মহাশয় তাঁর কবিতা "লেজকাটা ইতিহাস থেকে "কবিতায় আমাদের সেই সময়ে নিয়ে গেলেন ।সময়ের অনুষঙ্গে আসে সমসাময়িক সমাজ,জীবন কথা ও দর্শন । অতীত ও বর্তমান দেখতে দেখতে কবি বিচলিত হন ।স্বতঃই কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয় অমোঘ বাণী।
" থাক তবে ভুলে থাকা ভালো-
বুড়ো হয়ে গেছে আহা ভাঁটফুল চোখ
ভালো করে চিনিনা আজ বৈশ্য বণিক
কীইবা আসবে যাবে দলছুট হলে !"
সত্যিই কি কবি সেই সময়কে ভুলে থাকতে চান ? এখানে কবি পরিষ্কার বললেন "থাক তবে"।মানে অতীত যা যা ঘটেছে তা কবির কোমল হৃদয়ে রেখাপাত করেছে তাই তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চান । আসলে তা নয় ।জীবন বোধে ঋদ্ধ চেতনশীল কবি জানেন আদতে তা সম্ভব নয় ।বরং আরও জড়িয়ে পড়া জীবনের কাছে।
"বুড়ো হয়ে গেছে ভাঁটফুল দুইচোখ"
এবার তিনি একটা সময়কে তুলে আনলেন । কি সেই সময় ? না এটা সেই সময় যখন জীবন সূর্য পশ্চিম দিগন্তে অস্তাচলগামী।চোখ ঘোলাটে,রাস্তার ধারে অনাদরে অবহেলায় ফুটে থাকা ভাঁটফুলের মতো দুইচোখ।যে সময়কে সমাজ এখন বৃদ্ধাশ্রমের দিকে ঠেলে দেয়।
স্মৃতিচারণে সত্য ও সুন্দরের পূজারী ঠোঁটকাটা কবি কাটলেন জিভ।দেখলেন খাগের কলমে লেখা ইতিহাস লেজকাটা । সে ইতিহাস পাঠে বারবার জাবর কাটলেন।না পেলেন না কিছুই,বরং অনুভব করলেন যা শিখেছেন সব ভুলভাল । আলজিভও বিস্বাদ । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন পটে আঁকা ছবি ।যে ছবি আঁকা হয়েছে প্রাগের কলঙ্কমাখা মাটির দোয়াতের কালি দিয়ে ।অথচ সেই কলঙ্ক মোচনের চেষ্টা নেই ,বরং আপন খেয়ালেই লেওয়াললতা বেড়ে চলছে অবাধে।
না কবির এসব কিছুই ভালো লাগে না ।তবে কি তিনি দলছুট হয়ে বাঁচবেন? চেতনশীল কবির বিবেকে লাগে আঘাত ।মনও সায় দেয় না। ততদিনে জীবনও পোড়া মাটির মতো কয়লা কালো,ঋদ্ধ ।এইসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব বুকে বইতে বইতে ভাবলেন তারচে নাকে সর্ষে তেল দিয়ে লম্বা ঘুম দিলে কেমন হয় ? তাতে গলদের হুল থেকে তো নিষ্কৃতি মিলবে !
না কবি পারেন না তা করতে,বরং বিবেকের হুলে বিদ্ধ হন।চেতনার আলো বারবার আঘাত করে মনন।তাই শেষ স্তবকে এসে বললেন,-- না এটাই শেষ কথা নয়।কানে ভেসে আসে দূরাগত প্রতিধ্বনি,আগামীর কথা ভেবে পারেন না চুপ করে বসে থাকতে বা নাক ডেকে ঘুমাতে।হৃদয়ের গভীরে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠে ।শিরায় শিরায় তার তাত অনুভব করেন । এ ব্যথা অনুভব করার মতো অনুসারী কাউকে না কাউকে তিনি কাছে পাবেন,তার হাতেই কি দিয়ে যাবেন তাঁর জাগরণী অনুপ্রাস ?
অতীত ও বর্তমানের দিকে তাকিয়ে কবি আশাহত হন।তাই ধিক্কার জানান মিছে লোকদেখানো মতবাদকে ।হতাশায় নিমজ্জিত হতে হতে ভাবেন চেতনার হীরকদ্যুতির কথা।কার হাতে দিয়ে যাবেন সেই আলোরকণা ! জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি কি শুধু লার্ভা ছড়িয়েই শীতল হবে প্রকৃতির নিয়মে ?
"লেজকাটা ইতিহাস থেকে " কবিতায় আশা নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে কবি শেষে কি গভীর নৈরাশ্যের ভেতর ঢুকে পড়লেন? আদতে তা নয়,জীবন বোধের ঋদ্ধ কবি জানেন এ হীরক দ্যুতি বিচ্ছুরিত হবেই।যেমন ঘন অন্ধকারে খদ্যোত ছড়ায় জোনাক।
পরিশেষে বলি,আমি তেমন সাহিত্য বোদ্ধা বা সমালোচক নই।আসলে কবিতাটি পাঠে এতো ভালো লেগে গেলো তাই আলোচনার পাতায় নিয়ে আসলাম ।কয়েকটি যুগ্ম শব্দের প্রয়োগ মনে হলো কবিতাটিকে আরও বেশী শিল্পমণ্ডিত করেছে।যেমন--- প্রাগের কলঙ্কমাখা,খেয়ালের দেওয়াললতা,ভাঁটফুল দুইচোখ,জাগরণী অনুপ্রাস,বিবেকের হীরকখনি।আহা চমত্কার প্রয়োগ কবিবর।মুগ্ধতার ভাষা নেই।
আর একটি কথা বলে শেষ করছি।এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত ।আসলে ভাঁটফুল আমি চিনি না ।তাই কবিই বলতে পারবেন কেন তিনি ভাঁটফুল চোখের বিশেষণে প্রয়োগ করলেন । আমি হলে ধুতরো ফুল বা সর্ষে ফুল বিশেষণ হিসেবে প্রয়োগ করতাম ।কারণ ধুতরো বা সর্ষে ফুলের একটা আলাদা ব্যঞ্জনা আছে ।
এমন সুন্দর নান্দনিক কাব্য উপহার দেওয়ার জন্যে প্রবুদ্ধ কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা,অশেষ শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।এবং ভবিষ্যতে আরো এমন সুন্দর কাব্য পাঠের আশা রাখি ।