একটা মাছ দিই ?
কবি---প্রবীর চ্যাটার্জি (ভোরের পাখি)
আলোচক -- রণজিৎ মাইতি
-------------------------
ধূপ না পুড়লে যেমন বোঝা যায় না ধূপের গন্ধ,তেমনই স্মৃতি।স্মৃতিচারণায় উঠে আসে অতীত।স্কুলজীবন,আঁচার-ঝালমুড়ি,ডাঙ্গুলি,চু চিত্ কিত্ কিংবা এর ওর গাছের ফল চুরি।তখনকার বর্ষা কিংবা শীতের সকাল কেমন ছিলো,রথের মেলায় ভেঁপুর পৌঁ পৌঁ,পাঁপড় ভাজা ইত্যাদি ইত্যাদি । স্মৃতি এমনই দুঃখের দিনগুলোও ধরা দেয় সোনালী আভায়।
স্মৃতির সোপান বেয়ে তেমনই এক সোনালী সম্পর্কের রসায়ন তুলে আনলেন প্রিয় কবি প্রবীর চ্যাটার্জি(ভোরের পাখি)।আমরাও সিন্ধু সেঁচে পাওয়া মুক্তোর মতো পেলাম সেই সম্পর্কের উষ্ণতা।সঙ্গে হারিয়ে গেলাম মিঠেকড়া সম্পর্কের গহীনে।আসুন স্মৃতি হাতড়ে আমরাও দেখে নিই কবির মতো কিছু পাই কিনা।কবি বললেন,- - -
"মাঝে মাঝে
ভেসে আসে যেনো ঠাকুরমার চুলের সুগন্ধি তেলের গন্ধ,
আর মায়ের আঁচলের থেকে হলুদ গন্ধ;
কিছু অসংলগ্ন দুপুরের রোদ
হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে যাওয়া বিকেল"
হাঁ,প্রতিটি মানুষের মতো কবিরও ছিলো একটা মিঠেকড়া শৈশব।যে শৈশব দাদু-ঠাকুমার সাহচর্যে উত্তীর্ণ হয়েছে তার গণ্ডি,মায়ের আঁচলের শান্ত স্নিগ্ধ ছায়ায়,বাবার শক্ত হাতের স্পর্শে। যা কবিকে আবেগাপ্লুত করে সঙ্গে কবির মতো আমরাও ভেসে যাই ঠাকুমার চুলের তেলের সুগন্ধে।যিনি পান চিবোতে চিবোতে শোনাতেন কাশিদাসী রামায়ণ,রাক্ষস-খোক্কোসের গল্প ও ঠাকুমার ঝুলি । কিন্তু বর্তমান নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সেই সুযোগ নেই।সুতরাং আমাদের অসংলগ্ন দুপুরের মতো কিংবা হঠাত্ লোডশেডিং এর বিকেলের মতো সমাজের এ এক চিরন্তন লোডশেডিং ।তারপরই কবি যখন বলেন---
"আর এখন?
যে যার মতো নিজের বুঝে নিতে ব্যস্ত
কতোটা আমি পেলাম?"
এখন এই চিরন্তন লোডশেডিং এর চিত্র পরিষ্কার করে কবির শৈশব ও বর্তমান ।যে যার মতো নিজেকে বুঝে নিতেই ব্যস্ত । আমাতে আমি,তোমাতে তুমি । তোমাদের বৃদ্ধাশ্রম,আমাদের ছোট্ট কুঠি বাড়ি । স্বতঃই কবির আক্ষেপ কি পেলাম আমরা। অর্থাত্ আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠা দুটো ছবি পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় বর্তমান অবক্ষয়ের চিত্র ।শুধু তাই নয়,অতীত থেকে কবি শুনতে পান মায়ের দূরাগত স্নেহস্বর।যা পাঠক হিসেবে আমাদেরও টেনে নিয়ে যায় শৈশবের সুশীতল মাতৃছায়ায়।কবির মতো আমরাও কি সেই স্নেহকোমল স্বর শুনতে পাই না ?
"শুধু ভাবি আর দূর থেকে শুনতে পাই মায়ের গলা
হাতে পাখা নিয়ে বাতাস করতে করতে বলছে
'হাঁরে,কিছুই তো খেলি না বাছা,
আর একটা মাছ দিই'?"
এই স্বর শুনতে শুনতে ইচ্ছে হয় মায়ের আঁচলের হলুদ গন্ধে ও ঠাকুমার চুলের তেলের গন্ধে মুখ ডুবিয়ে খুঁজে ফিরি শৈশবের সোনা ঝরা দিন,সেই হাতপাখার যুগে ।এখনও এক বার বলুক "আর একটা মাছ দিই" খোকা। কিছুই তো খেলিনা বাছা।
সুন্দর আবেগঘন কবিতায় কবি একদিকে যেমন চেনালেন তাঁর সোনালী শৈশব তেমনই সুনিপুণ আঁচড়ে ফুটিয়ে তুললেন বর্তমান শৈশবের চিত্র। স্বতঃই পাঠক হিসেবে আমাদের ভাবতে হয় কোনটা ভালো,কোনটা খারাপ । এখানেই কবিতার উত্তোরণ এবং কবির স্বার্থকতা।
চমত্কার নামকরণ । সহজ সরল শব্দে এবং সাবলীল কথকতার ঢঙে কবি এক গভীর বিষয় উপস্থাপন করলেন । এটাই কবিতার উৎকৃষ্ট নান্দনিকতার নিদর্শন । আসলে কঠিন কথা সহজে বলা অতো সোজা নয়।
এমন একটি সুন্দর নান্দনিক কাব্য উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।