ভালোবাসা কি কখনও ফাঁদ হতে পারে কিংবা ফাঁস ? এমনই গভীর প্রশ্ন তুলে ধরলেন প্রিয় কবি সংহিতা তাঁর "ফাঁদ" কবিতায়। কবিতাটি পাঠান্তে মনে পড়লো বিখ্যাত উক্তি "প্রেমের ফাঁদ পাতা ভূবনে"
প্রশ্ন আসে সে ফাঁদ ভালো না খারাপ । ফাঁদ কখনও কি ফাঁস হয়ে গলায় চেপে বসে ? স্বতঃই সমাজের দিকে চোখ ফেরাতেই হয়।
কবি বললেন,----
"ভালো যদি বাস,যদি সত্যই ভালোবাসো--
তবে ভালো বেসে কেন নারী,তুমিহীনতায় কেন--
তুমি ভোগ"
কবির এই উক্তি থেকে বোঝাই যাচ্ছে সমাজের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখলেন নারীর সমাজিক অবস্থান । কাব্যিক চেতনা থেকে উৎসারিত এমন কথায় ঝরে পড়ছে কবি মনের বেদনা,হতাশা,যন্ত্রণার কথা। যে ভালোবাসা মানুষকে সমৃদ্ধ করে,মহত্বর জীবনের পথ দেখায় সেই ভালোবাসা দিতে গিয়েই নারী ভুগছে আমিহীনতায়। সত্যিই যদি সমাজ ও সময় নারীকে এই পথে ঠেলে দেয় তখন চেতনশীল মানুষ হিসেবে ভাবতে হয় বৈকি । নারী-পুরুষ পরস্পরের পরিপূরক । মনে পড়লো বিদ্রোহী কবির উক্তি,
" বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর ।"
অর্থাত্ এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচতেই পারেনা। অথচ নারী ভালোবাসতে গিয়ে হচ্ছে ফাঁদে বন্দী।
ভালোবাসা মানুষকে মহান করে,উদার করে,মানুষ হয় সমৃদ্ধশালী ।তাই তো কবি পরক্ষণেই বললেন,---
"তোমার ভালোবাসায়,তোমার গভীর ভালোবাসায়--
নেই তো নিদারুণ অস্তিত্ব সংকটের গোপন ভয়"
কবি কি এই বক্তব্যে তুলে ধরলেন কবিতার সংজ্ঞা? ঠিকই তো ভালোবাসতে গিয়ে কেউই অস্তিত্ব সংকটে ভোগে না বরং জানান দেয় অস্তিত্ব । এর পরই কবি করলেন অমোঘ দিকনির্দেশ----
"যদি এমনই হয়,তা যে ভালোবাসা নয়"
সে তোমার জড়িয়ে থাকা লতার মতো বৃক্ষ শরীরে---
শুধু বেঁচে থাকা, শুধু আঁকড়ে ধরা "
ঠিকই তো এ কেবল পশুপাখিদের মতো বেঁচে থাকা । অর্থাত্ কবি টানলেন ভালোবাসা না-বাসার সীমারেখা । যে ভালোবাসা এই একবিংশ শতাব্দীতেও দিতে পারে না আত্মপ্রত্যয়,বাঁচতে হয় পরজীবীর মতো পুরুষ নামক শমীবৃক্ষকে জড়িয়ে, তাকে আর যাইহোক ভালোবাসা বলে চালাতে কষ্ট হয় বৈকি।
সেখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে পথের দিশা তো পান-ই না,বরং ভোগেন একাকীত্বে । নারীর জীবনে নেমে আসে---
"কেউ নেই কিছু নেই
সূর্য নিভে গেছে"
কবিও কি দেখাতে পেরেছেন উত্তোরণের দিশা।দেখেন গভীর ফাঁদের ভেতর যন্ত্রণায় ছটফট করে নারী।কখনও হারেমে,কখনও প্রভাবশালীর রক্ষিতা হয়ে।কেউ কেউ পয়সা দিয়ে কেনে প্রেম ও শরীর।তাই গভীর হতাশা থেকে শেষে কবি বলেন,---
"এ মিথ্যে প্রেমের অবয়বে বুনে চলা
মাকড়সার জালের মতো এক ফাঁদ"
ভালোবাসা নয়,মোটেই ভালোবাসা নয়।শেষে ভালোবাসা নয় বলতে গিয়ে মানব দরদি কবি মনের যতো হতাশা যন্ত্রণা সব উগরে দিলেন ।
চমত্কার সমাপ্তি টানলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । আমিও বলবো ভালোবাসার ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটুক মুক্ত,স্বাধীন বিহঙ্গের মতো।
#####
সুন্দর কবিতাটি সম্পর্কে আমার কিছু ব্যক্তিগত মতামত জানিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই।
প্রথমত-- মনে হয় স্তবক বিন্যাসে কবির একটু নজর দেওয়ার দরকার ছিলো। কারণ কবিতাটিতে উঠে এসেছে( 1 ) ভালোবাসতে গিয়ে নারীর বর্তমান সামাজিক অবস্থান কোথায় । (2) ভালোবাসার সংজ্ঞা ও( 3)নারী কিভাবে ভালোবাসার নামে হচ্ছে সামাজিক বঞ্চনার শিকার ।
দ্বিতীয়ত--- যেহেতু কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় ভালোবাসা এবং তা চিরন্তন ও নারী-পুরুষ কারুরই একচেটিয়া নয় তাই শুধু নারীর বঞ্চনার কথা না বলে সার্বিক ভাবে সব লিঙ্গের বঞ্চনার কথা বললেই ভাবনাটি সম্পূর্ণতা পেতো।ভালোবাসতে গিয়ে অনেক সময় পুরুষও শোষিত ও নিঃস্ব হয়,যা পুরুষ শাসিত সমাজে লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায় । এই ভারতেই উত্তর-পূর্বের কিছু অঙ্গরাজ্য আছে যা নারী শাসিত । ভালোবাসার শোষণ যাকে আপনি ফাঁদ বললেন তা আর্থসামাজিক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে ।
সবশেষে বলি "ফাঁদ" অর্থাত্ বিতংস । চমত্কার নামকরণ । সমাজ বেরিয়ে আসুক ভালোবাসার শোষণের হাত থেকে । হোক নতুন সূর্যোদয় ।
সুন্দর ও সুখপাঠ্য কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই । কবির কলমে আগামীতে সৃষ্টি হোক এমনই কবিতা