"ছোট হতে হতে--" নিয়ে আলোচনা
কবি-মৌটুসী মিত্র গুহ (কেতকী)
আলোচক--রণজিৎ মাইতি
-----------------------
একটি সোজা রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে সেই রাস্তা দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে দুটো রাস্তা।আবার সেই দুটি রাস্তাও দুটি থাকে না,ভাগ হতে হতে চার,আট,ষোল সরল গুনিতকে বৃদ্ধি পায় । অথচ আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম রাস্তা আসলে একটাই ।প্রিয় কবি মৌটুসী মিত্র গুহ (কেতকী) আমাদের চেনালেন গতানুগতিক রাস্তার বাইরে ভিন্ন এক রাস্তা । যখন সমাজ সভ্যতা প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়কে জীবনের মোক্ষ জ্ঞান করেন,দুধের শিশু পরীক্ষার খাতায় কম নাম্বার পেলে বাবা-মা তথা অভিভাবকরা মনে করেন তাদের সন্তান পিছিয়ে পড়ছে,তখনই কবি মৌটুসী বললেন ভুল,সম্পূর্ণ ভুল রাস্তায় হাঁটছেন আপনি । আসলে---
"প্রতিযোগিতায় নামলে
ছোট হয়ে আসে পরিধি"
কবির এই বিক্ষণ আমাদের ভাবায়,ভাবতে বাধ্য করে।কারণ,কবি তার বক্তব্যের সমর্থনে যে যুক্তি দিয়েছেন তা এতোটাই অকাট্য আমরাও পারিনা তা খণ্ডন করতে ।দেখে নিই আসুন কি বললেন কবি,---
"গাঁথুনির আগেই চোখের সামনে
ইমারতের ছবিটা ভেসে ওঠে বারবার,
আমি আর আমায় নিয়েই যেনো গোটা পরিবার! "
যখন কবি এমন কথা বলেন তখন কোথাও যেনো আমরা আছাড় খাই,মুহুর্তে কি ভেঙে পড়ে না আমাদের আজন্ম লালিত ভাবনার ইমারত? অথচ অস্বীকার করতে পারিনা বাস্তবকে। যেকোনো প্রতিযোগিতা মানেই সাফল্য ছোঁয়ার যে উদগ্র বাসনা তা হয়ে পড়ে সীমিত।ওই তো একশো মিটার,দুশো মিটার কিংবা চারশো । অথবা আরও এগিয়ে ভাবতে বসলে হয়তো বিশ্ব অলিম্পিকের আসরে এথেলেটিক্স হিসেবে একটা সোনার ঝকঝকে মেডেল । অথচ জীবন তার চেয়েও আরও আরও বড়ো। আমরা ভুলে যাই জীবন আসলে অপরিমেয় সোনার আকর।কিংবা এই যে আমরা গাল ফুলিয়ে বলি আমার সন্তান দারুন রেজাল্ট করেছে । এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমাদের কি দিতে পারে?হয়তো একজন স্কুল শিক্ষক,অথবা ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বড়ো আমলা।আর আমরা সেই করতলস্থিত (হস্তামলক) আমলকি নিয়ে দিব্বি মশগুল হই পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে । আর গণ্ডিতে আটকে পড়া মানেই তো সেখানেই গল্পের যবনিকাপাত।তাই কবি একদিকে খেদ,অন্যদিকে বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন,---
"শুধুমাত্র এগিয়ে যাওয়ার নেশায়
পেছনে ঠেলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা
শুরুর আগেই লেখা হয়ে যায় গল্পের শেষটা!"
হায় রে সাধের প্রতিযোগিতা,এতো জীবনের নির্মম পরিহাস! যে গল্প ডালপালা মেলতে পারতো বটবৃক্ষের মতো,সেই গল্প শুরুর আগেই শেষের ঘন্টাধ্বনি শুনিয়ে যায়! এটাই আমাদের বেলাশেষের গান ! তাই তো কবি কবিতার নামকরণটি করলেন,"ছোট হতে হতে- -"
যে প্রতিযোগিতা ভেবেছিলাম একদিন সাফল্যের মুখ দেখাবে পরিণামে তা মরীচিকাসম।যদিও সাফল্যরূপ মরীচিকাও ডুবে যায় বিস্মৃতির অতলে ।কবিগুরুর কথার প্রতিধ্বনি শুনি প্রিয় মৌটুসী কবির কণ্ঠে।
"আমি রাজা,একেশ্বর,
সমকক্ষ মোর চিরশত্রু,স্থান দুশ্চিন্তার
সম্মুখের অন্তরাল,পশ্চাতের ভয়
অহর্নিশি যশোশক্তি গৌরবের ক্ষয়
ঐশ্বর্যের অংশ অপহারী"
আর কবি প্রিয় মৌটুসী বলেন,
"বিস্মৃতির অতলে ডুব দেয় মরীচিকা,
সেই ভালো----
একচ্ছত্র রাজত্ব-- সিংহাসনে আমি এ--কা!"
সাফল্যের এই দম্ভের মধ্যেও কোথাও যেনো শুনতে পাই হাহাকার। কারণ--
"পরিণত বলে কোনও কথা নেই,
সুন্দরও আশ্চর্য এক চলমান সিঁড়ি
মৃত্যুতেই তার পরিণতি!"
সুতরাং স্বপ্ন ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনা।
"স্বপ্ন ভাঙলে বোঝা যায়
পৃথিবী মুঠোয় পুরে নেওয়াও এতোটাও সোজা নয়!"
এই বিশাল পৃথিবীতে হাজারো পথ,প্রতিটি পথই স্বতন্ত্র । একটি নির্দিষ্ট পথকেই জীবনের মোক্ষ না ভেবে যার যেই পথ ভালো লাগে সেই পথেই এগিয়ে যাক। কারণ পৃথিবীকে কখনও মুঠোবন্দী করা যায় না । বরং তা করতে গিয়ে আরও ছোট হয়ে যায় ।
চমত্কার নামকরণ।প্রতিযোগিতার আড়ালে কবি সুকৌশলে ছোট হওয়ার গল্পই শুনিয়ে গেলেন। তথা গল্পের অন্তরালে নীরবে শুনিয়ে গেলেন সাবধানবাণী । সাধু সাবধান ! প্রতিযোগিতার নামে দুধের শিশুকে করো না গণ্ডিবদ্ধ। কবিতার শরীর জুড়ে ফুটে ওঠে সামাজিক সচেতনতার মৌলিক ফুল ।
সুন্দর ও মনোগ্রাহী কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা,শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।