"বাবার পিছনে দুটি ছায়া"(কবিতাটির গভীরে লুকিয়ে আছে বিশ্বাস ও বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণা)
কবি--রশিদ হারুন
আলোচক--রণজিৎ মাইতি
--------------   ---------- ---------
যেদিন আমার বাবা তার পাঁচ বছরের সন্তানের সামনে নির্বিকারে
ফোনে কাকে যেনো মিথ্যে বললেন,
-আমার শরীরটা আজ খারাপ,অফিসে আসতে পারবো না!
পাঁচ বছরের আমি তারপর থেকে বাবার পেছনে দুটি ছায়া হাঁটতে দেখতাম সবসময়।

আমি কাউকে কখনও বলতে পারিনি,
এমনকি মাকেও না।
বাবার সেই মিথ্যের পর থেকে
আমি আকাশে ঘুড়ি উড়াতে গেলেই
-সেই ছায়ার একটি আমার ঘুড়ির সুতো কেটে দেয় সবসময়!

-------------------

ছায়া সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকেরই একটা ধারণা আছে।ছায়া বা ইংরেজিতে (Shadow) হলো,--কোনও আলোক উৎসের সামনে কোনো অস্বচ্ছ বস্তু রাখলে,ওই বস্তুটির পেছনে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানের সৃষ্টি হয়, তাকে ওই অস্বচ্ছ বস্তুর ছায়া বলে।তবে আলোর উৎসের বিপরীত দিকে অস্বচ্ছ বস্তুর পেছনে আমরা একটাই ছায়া দেখতে পাই,এবং সাধারণ আমরা দেখি সৃষ্ট ছায়াটির আকার, বস্তুর আকারের মতোই হয়।কেবল আলোর উৎস অস্বচ্ছ বস্তু বা ব্যক্তির কাছে কিংবা দূরে সরিয়ে ছায়ায় আকার বড়ো ছোটো করা যায় ।কিন্তু এখানে লক্ষণীয়,কবি দেখলেন দুটি ছায়া।তা কিভাবে সম্ভব !চিন্তা করুন কবির এই বিষ্ময় মাত্র পাঁচ বছর বয়সে।

যখন সবে পাঁপড়ি মেলছে গোলাপ কুঁড়িটি, গড়ে উঠেছে বিশ্বাসের ভিত।এবং বিশ্বাসও করতে শুরু করেছে বাবা মানেই সৎ,নির্মল ও পবিত্র।তাছাড়া সেই বাবার হাত ধরেই তো শিশুটি শিখছে সততার পাঠ।ঠিক তখনই পাঁচ বছরের শিশুটির সামনেই করলেন বিশ্বাস নামক অনড় তরুর মূলে চরম কুঠারাঘাত।

"ফোনে কাকে যেনো মিথ্যা বললেন,
-আমার শরীরটা আজ খারাপ,অফিসে আসতে পারবো না!"

সেই বয়সে শিশুটি দেখলো বাবা নামক আজন্ম লালিত বিশ্বাসের ছায়া থেকে নতুন জন্ম নিয়েছে আর একটি ছায়া।যে ছায়াতরুর শিকড় অনেক গভীরে,মিথ্যা নামক মাটি আঁকড়ে আছে অথচ ছায়াটি মিথ্যা নয়।

সুতরাং কবি স্বয়ং কথক হিসেবে বিশ্বের সমগ্র শিশুর প্রতিনিধি স্বরূপ দেখলেন দুটি ছায়া।তবে কবিতায় শিশুটি দর্শক মাত্র,কেন্দ্রীয় চরিত্রে বাবা থেকেও থেকে গেছেন আজীবন শিশুটির নেপথ্যে,অর্থাত্ পর্দার আড়ালে।অবশ্য আড়ালে থেকে মিথ্যা নামক ছায়া বাবারাই এখনও নাড়ছেন জগতের সমস্ত কলকাঠি।যা শিশুকে ব্যথিত করে।বিশ্বাস নামক প্রথম ছায়ার অবনমন দেখে হয় যন্ত্রণাক্লিষ্ট।মিথ্যা নামক যে ছায়ার কথা সে তার মাকেও এতোদিন বলতে পারিনি,একটু বড়ো হয়ে দেখে আকাশে ঘুড়ি উড়াতে গেলেই সেই ছায়াটি তার ঘুড়ির মাঞ্জাসুতো কেটে দেয়!

স্বয়ং কবির সাথে আমরাও অবাক হই।শুধুই অবাক নয়,একদিকে অবাক অন্যদিকে বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণায় পীড়িত হতে হতে মনে হয় মিথ্যা নামক দ্বিতীয় ছায়াটিও কি সত্য 'অশ্বত্থামা হত ইতি গজ'র
মতো ? অথচ দুনিয়ার সব বাবাই তাঁর সন্তানকে শেখান 'সদা সত্য কথা বলিবে'!তবে কি হবে এমন নীতিবাক্য শিখে ?

কবিতাটি পাঠ শেষে পাঠক এমন হাজারো প্রশ্নে বিদ্ধ হতে হতে হাত দিতে বাধ্য হবেন নিজস্ব বুকে।আমাদের জীবন নামক দুধ সাগরে কতোটা দুধ,কতোটা জল।হৃদয় সুন্দরবনে কতোটা ঝোপ,কতোটা সুন্দরী গরান ঘেরা।বরং প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গিয়ে নিজ কর্মে নিজেকেই হতে হয় লজ্জিত।আর মূর্তশিশু হয় তার খেলনার মতো খানখান,চুর্ণবিচুর্ণ।চুর্ণী নদীর জলে কাগজের নৌকো ভাসিয়ে বলে,'হে অবিশ্বাসী ছায়া,তুমিও কি ভেসে যাবে বিশ্বাসী ছায়ার সাথে সমান্তরালে!'জবাব না পেয়ে শূণ্য মাঠে আজও দাঁড়িয়ে থাকে শিশুরা।যার হাতে ধরা ছিন্ন লাটাই,চোখ তখনও ঘুড়িটির দিকে নিষ্পলক।এখন ছেলেটিও বুঝে গেছে ঘুড়িটির অভিমুখও হাওয়ায় অনুকূলে।উজানে সাঁতার কাটার মতো ছায়া আজও জগতে বিরল।

সহজ সরল প্রকাশ ভঙ্গি হলেও কবিতার মর্মবাণী যে কোনো রসিক পাঠককে ছুঁয়ে যায়।সাধের সমাজ ও গর্বের সভ্যতার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এখনও মানুষকে যথার্থ মানুষ হতে গেলে অনেক পথ হাঁটতে হবে।হয়তো কোনো একদিন আবহমানই বলবে,হাঁ এই পৃথিবী আজ মানুষের পৃথিবী,শিশুর বাসযোগ্য।যার একটাই মুখ,ছায়াও একটা।ছায়ামুখোশ পরে কোনও বাবা বলবে না,"শরীরটা আজ খারাপ,অফিসে আসতে পারবো না!"

চমত্কার কবিতা,তেমনই অপূর্ব নামকরণ।পাঠক হিসেবে কবিতার বোধে একাত্ম হতে পেরে কবির সাথে যন্ত্রণা ভাগ করে নিচ্ছি।বাবাদিবস সাড়ম্বরে পালন করি কিন্তু কোনো শপথ গ্রহণ করিনা।আজ থেকে উচ্চারিত হোক বিশ্বাসী ছায়ার মুখে এমনই স্নেহবচন,"খোকা,খোকা। তোদের মুখ মুখোশ হোক একটাই।"

পরিশেষে,এমন একটি সুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।এবং আগামীতে এমন আরও সুন্দর সুন্দর কবিতা উপহার দিয়ে আসরকে উজ্জীবিত করবেন এই আশা রাখি।