"এসেছে সময়" নিয়ে আলোচনা
কবি--নরেশ বৈদ্য
আলোচক--রণজিৎ মাইতি
-----------------------
আধুনিক কবিতা নিয়ে অনেকেই নাক সিটকান।অভিযোগ আনেন দুর্বোধ্যতার।সঠিক ভাবে রূপকগুলো চিনে নিতে পারলে কেটে যায় দুর্বোধ্যার তমিস্রা।আসুন চিনে নিই প্রিয় কবি নরেশ বৈদ্যর "এসেছে সময়" কবিতার রূপকগুলো।

শুরুতেই কবি প্রশ্ন রাখলেন "ঘুঘু দেখতে কেমন?"
পরক্ষণে কবি নিজেই উত্তর দিলেন তাঁর প্রশ্নের । এমন প্রশ্ন বড়োই বেমানান,কারণ এই বাংলাদেশের আনাচে কানাচে রয়েছে তার প্রমাণ ।তাই কবি বললেন,আসুন আমরা ঘুঘু নিয়ে না ভেবে বরং ভাবি ঘুঘুর বাসা নিয়ে । সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন ঘুঘুর বাসা ।চেষ্টা করে দেখি সে বাসা ভাঙা যায় কিভাবে।

পরক্ষণেই কবি ঢুকে যান ইতিহাস চর্চায়।এ চর্চা চায়ে-পে চর্চা নয়। বরং ভিন্ন পথে কবি যে ঢেউ এর প্রসঙ্গ তোলেন তা আসলে বিপ্লব বিদ্রোহের ইতিহাস। যা দেখেছে এই দেশ বহু,বহুবার।নীল বিদ্রোহ,সিপাহী বিদ্রোহের দেশ,অসহযোগ, ভারতছাড়ো আন্দোলনে হয়েছে উত্তাল।কবি আক্ষেপ প্রকাশ করেন,এতো উত্তাল ঢেউয়ের দেশে কেন
"তবুও,রয়ে গেলো আজও সেই চেনা ফেউ"।
কবির মতো আমরাও অবাক হয়ে দেখছি,শুনছি ফেউ গুলো চুপ না থেকে বরং "সুযোগ খুঁজে আবারও করছে ঘেউ ঘেউ"।কবির নজর সেদিকেই,এই ঘুঘুর বাঁসাগুলো কবির চিন্তার কারণ ।কারণ তিনি জানেন যতোদিন না ভাঙা হচ্ছে এই ঘুঘুর বাসা ততোদিন দেশে চলবে স্বাধীনতার নামে প্রহসন।

এবার কবি একটু বাস্তবে ফেরেন।এই যে চারপাশে ধর্মের নামে অধর্মের চাষ,নরহত্যা,খুন,ধর্ষণ,দুর্নীতি এই সব কারা করে?সেই ঘুঘুগুলো এখন কবির আতশকাচে ধরা দেয়।বিচিত্র রঙে রূপে সেজে তারা কিন্তু ভদ্রবেশী এবং প্রকাশ্য।"সময়ের বেড়াজালে কাটা খাল" অর্থাত্ সময়ের গণতন্ত্র দিয়ে ঢুকে পড়েছে কুমির।যেভাবে রমরমিয়ে চলছে দুর্নীতির আখড়া কবির ভাবনায় সে কুমির মোটেই ছোট নয়,
বরং বৃহৎ।এখন যে কুমিরের কাণ্ডকারখানা দেখে "লজ্জায় মাথা নত করে হাঙর"ও।এবং দেখেন এক দঙ্গল রঙিন তিমি দুর্নীতিগ্রস্ত গণতন্ত্রের চাঙড়কে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে আঁকড়ে ধরে।

মানবিক বোধসম্পন্ন কবি চিন্তিত হন।তাই মানুষের প্রতিনিধি কবিকে ঘোষণা করতে হয় আর নয়, এটাই সেই সময় ধুলো ও জঞ্জাল অপসারণের।যদি আমরা সমবেত ভাবে প্রয়াসী না হই,নরপিশাচদের তীক্ষ্ম নখরাঘাত ছিন্নভিন্ন করে দেবে সমাজ দেহ।এমনই মূল্যবান বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কবি "হাতে হাত রাখা,জোট বাঁধা"র কথা বলেন।চেতনশীল কবি জানেন 'একতাই বল'।যা পারে শোষিত,অত্যাচারীত,নিপীড়িত মানুষের হাতে ফিরিয়ে দিতে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার আকাশ।এবং কবি ইতিহাস বোধ থেকে নিশ্চিত এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা একদিন তাদের হাতে জয় হয়ে ধরা দেবে।সবশেষে কবি একটি বিখ্যাত গানের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করেন,যা উথ্বান-পতনের ইতিহাস সম্পর্কে যারা সম্যক অভিহিত প্রত্যেকেই জানের "চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়"।

ভারি সুন্দর কবিতা।যার শরীর জুড়ে আদ্যন্ত দ্রোহের আগুন।যেহেতু কবি বর্তমান সময়ে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সুতরাং "এসেছে সময়" নামকরণটিও সার্থক।

কবিতার গঠন নিয়ে দু-একটি কথা বলে আলোচনা শেষ করবো।মুক্তছন্দে লেখা চমত্কার কবিতা । বেমানান শব্দের সঙ্গে প্রমাণ,ঢেউ এর সঙ্গে ফেউ ও ঘেউ ঘেউ,তাড়াবার সঙ্গে দরকার শব্দের প্রয়োগে কবিতার মাধুর্য বেড়েছে বই কমেনি । কিন্তু মনে হলো কবিতাটি কয়েকটি প্যরায় হলে ভালো হতো। প্রমাণ পর্যন্ত প্রথম পাঁচ লাইন প্রথম প্যরা।ঘেউ ঘেউ পর্যন্ত দ্বিতীয় প্যরা।রঙিন তিমি পর্যন্ত পরবর্তী প্যরা। বাদবাকি শেষ প্যরা হলে মনে হয় পাঠক হিসেবে সুবিধা হতো বোধগম্যতায়।রূপকগুলো ভারি সুন্দর যা কবিতার বক্তব্যকে গতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে।

এমন একটি সুন্দর বিষয়ধর্মী মনোগ্রাহী কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই । এবং আগামীতে কবির কলম এভাবেই উজ্জীবিত হোক এই কামনা রইলো