কবিতার নাম---আফশোস
(কবিতাটির শরীর জুড়ে সাদামাটা কথার আড়ালে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা)
কবি--- মিহির চৌধুরী ইমন
আলোচক---- রণজিৎ মাইতি
-------- ------ ------
কোনও কোনও প্রবাদ এতোটাই প্রচলিত আমরা কথায় কথায় সবাই প্রায়ই বলি,যেমন এই প্রবাদটি
"Man proposes,God disposes"
যার অর্থ -- Human beings can make any plans they want, but it's God that decides their success or failure.
আর বাংলা করলে দাঁড়ায়,"মানুষ ভাবে এক,হয় আর এক।"
এই আসরের নবাগত কবি- মিহির চৌধুরী ইমন তাঁর কবিতা "আফশোস"এ শোনালেন এমনই একটি গল্প যা ছুঁয়ে আছে উপোরিউক্ত প্রবাদ।অবশ্য একে গল্প না বলে বলা যেতে পারে বাস্তব থেকে উঠে আসা স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের জীবন্ত দলিল,ঠিক যেনো সবুজ অববাহিকা।সত্যিই কি সেই অববাহিকা জুড়ে সবুজের সমারোহ ? তবে কবির এতো আফশোস কেনো ? চিনে নেওয়া যাক অববাহিকার হালহকিকত ।
কবি প্রথমেই যা বললেন তা স্বগতোক্তির মতো শোনালেও আসলে তা কবি তথা আপামরের স্বপ্ন।কবি বললেন,---
"আমাদের পূর্বপুরুষ দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ভেবেছিলো
এ দেশ স্বাধীন হলে--
আমাদের ধর্ম হবে সবুজ সোনালি মাঠ!
আমাদের জাত হবে বাংলাদেশী
হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান আমরা হবো বাংলা মায়ের সন্তান!"
দেখুন কি সুন্দর সহজ সরল সাবলীল ভাবনা ও তার প্রকাশ।যে ভাবনা আপামরের এবং আকাঙ্ক্ষাটিও যেকোনো আধুনিক ও নবগঠিত রাষ্ট্রের কাছে যুক্তিসঙ্গত ও স্বাভাবিক।কবির কথায় তাঁরা আমাদের 'পূর্বপুরুষ'।কি ভেবেছিলো তারা?না দেশ স্বাধীন হলে "আমাদের ধর্ম হবে সবুজ সোনালি মাঠ! আমাদের জাত হবে বাংলাদেশী", যেকোনো ধর্মের মানুষ বাংলা মায়ের সন্তান।এখানে লক্ষণীয়,কবি পূর্বপুরুষদের ন্যাহ্য সাধারণ চাওয়াকে দুই বার 'আমাদের' শব্দটি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে অসীম দক্ষতায় তা যে আপামরের ভাবনা তার চমত্কার রূপদান করলেন।এবং কবির গণতন্ত্রী মানসিকতার প্রকাশ পেলাম।এখানে এসে কবি আর কবি নন,যেনো তিনিই হয়ে উঠছেন সাধারণ পূর্বপুরুষ ।সুতরাং পূর্বপুরুষদের প্রতিনিধি স্বরূপ তিনিই ফুটিয়ে তুলেছেন কাঙ্ক্ষিত ও বাঞ্ছিত চিত্র । আমরা এক জাতি এক প্রাণ, গোরে কিংবা শ্মশানে যাই বাংলারই সন্তান।যার ধর্ম সবুজ সোনালি মাঠের মতো প্রশস্ত ও উদার।আমরা সবাই জানি,মাটি তো শস্যের 'মা'।সেই 'মা' কি কখনও কোনও সন্তানকে আলাদা ভাবে দেখেন,না আলাদা করতে পারেন ?তাঁর কাছে সবাই সমান। সবাই বাংলাদেশী।
কিন্তু বাস্তবে কি দেখলাম?গভীর ছন্দপতন!তাল কেটে গেছে,তাই বড্ড বেসুরো।কবির কথায় --
"অথচ আমরা---
কাদা ছোঁড়াছুড়ি করছি এখনো
জাতপাত,ধর্ম আর জমির মালিকানা নিয়ে।"
কাদা ছোড়াছুড়ি কি নিয়ে?সেই জাতপাত,ধর্ম আর জমির স্বত্ব নিয়ে। অর্থাত্ স্বাধীনতার আগের ও পরের অবস্থার কোনও হেরফের নেই। যা কিনা স্বপ্ন ভঙ্গের কথাই বলে এবং আমাদের নিয়ে যায় সেই প্রচলিত প্রবাদের কাছে "ভাবি এক,হয়ে যায় আর এক।"।সুতরাং পাঠক হিসেবে পাঠ শেষে আমাদেরও 'আফশোস' লুকোনোর জায়গা থাকেনা।
সহজ সরল সাবলীল স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে দুই চিত্র তুলে ধরেছেন কবি তাঁর সুনিপুণ কলমের আঁচড়ে।একটি চিত্র স্বপ্ন হলে অন্যটি অবশ্যই স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা যার পরিণাম আফশোস।অতএব নামকরণ নিয়েও আমাদের কোনও কথা থাকতে পারে না ।
তবে দু-একটি কথা না বললে মনে হয় আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।যদিও এটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ভাবনা।কবি একমত নাও হতে পারেন।
প্রথমত,-- কবিতাটি দুটি স্তবক দাবি করে।প্রথম স্তবকটি পূর্বপুরুষদের ভাবনা বা স্বপ্নও বলা যায়,দ্বিতীয় স্তবকটি ছন্দপতন বা স্বপ্নভঙ্গের রুক্ষ অববাহিকা।যেখানে এসে ভাবনার সবুজ মাঠ খরতাপে ফেটে চৌচির।
দ্বিতীয়তঃ--যোতি চিহ্নের প্রয়োগ।কবি মাঠ ও সন্তান শব্দের শেষে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।এখানে পূর্বপুরুষদের প্রতিনিধি স্বরূপ কবি স্বপ্নের যে বীজ বপন করলেন তা তো আপামরের বাঞ্ছিত ও কাঙ্খিত । সুতরাং ওই দুটি লাইনের শেষে বিস্ময় প্রকাশ কেনো!এখানে তো কোনও বিপন্নতা বিষণ্ণতা নেই।নিছক স্বপ্ন,যে স্বপ্ন সুখানুভূতি নিয়ে আসে।মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সুখসাগরে।
সেই কারণে আমার মনে হয়েছে মাঠের শেষে ( ; ) চিহ্ন এবং সন্তান এর শেষে(।)চিহ্ন হওয়া উচিত । আর একদম শেষে এসে (! চিহ্ন) অর্থাত্ বিস্ময় প্রকাশ করা উচিত ।কারণ এই যে স্বপ্নভঙ্গ, তা কবির সাথে সাথে আমজনতাকেও অবাক করে।কি হলো,কি পেলাম স্বাধীনতার জন্যে এতো রক্তক্ষয় করে?বরং দিন দিন বেড়ে যায় রক্তক্ষরণ!!
এছাড়া একটি শব্দ আমি সংযোজন করতাম সন্তানের আগে,শব্দটি হলো 'দামাল'।কখনো কখনো একটি শব্দই কবিতার ব্যঞ্জনা অনেক বাড়িয়ে দেয়।দামাল সন্তানের জন্ম না হলে কে গড়বে আধুনিক বাংলাদেশ ? আর প্রথম লাইনে দেশ স্বাধীন 'হওয়া' নয়, 'হওয়ার' আগে' হবে প্রিয় কবি।সম্ভবত টাইপিং (মুদ্রণ) প্রমাদ।মেজে নেবেন প্রিয়, প্লিজ ।
সুন্দর কবিতা,বিষয় ভাবনাও সুন্দর ।পাঠ শেষে কবির সাথে পাঠকের মনও বিষাদিত হয়।উঠে আসে আফশোস।সুন্দর একটি কবিতা আসরকে উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই ।