অনুসন্ধান নিয়ে আলোচনা
কবি--সুমিত্র দত্ত রায়
আলোচক--- রণজিৎ মাইতি
----------------
আমরা যখনই কোনও কিছু দেখি,অথবা সেই সংক্রান্ত কথা বলি বাস্তবে তা সেই বস্তুটির বহিরঙ্গ।যেমন যখন বলি,আহা গাছটি কি সুন্দর ! তখন আমাদের সুন্দরের ভাবনা অই ফুল ফল পাতা কাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কখনো তা শেকড়ে পৌঁছাতে পারে না । অথচ ফুল ফল পাতা কাণ্ড ও মূল নিয়েই হয় সমগ্র গাছ। অথবা যখন বলি বাড়িটি ভারি চমত্কার নির্মাণ । তখন কি আমরা খুঁটিয়ে দেখি নির্মাণের ইতিহাস ? বাড়িটি তৈরিতে কতো প্রাণ নিবেদিত ।কতো ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন সুরম্য হর্ম্য। অবশ্য আমরা সবাই নির্মাণের ইতিহাস কিংবা গাছটির মূল নিয়ে না ভাবলেও কেউ কেউ আছেন যিনি পৌঁছাতে চান মূলে। অবশ্যই তিনি ব্যতিক্রমী । তাই তো সেই ব্যতিক্রমী মানুষটিকেই আমরা গবেষক কিংবা ইতিহাসবিদ আখ্যায় ভূষিত করি।যিনি প্রকৃতির রহস্য উদঘাটনে রত হন তাঁকে আমরা বৈজ্ঞানিক আখ্যায় ভূষিত করি,যিনি সমাজ সভ্যতার অতীত নিয়ে নিমগ্ন হন তাঁকে বলি ঐতিহাসিক বা ইতিহাসবিদ ।
কবি সুমিত্র দত্ত রায় তেমনই একটি গল্প শোনালেন তাঁর "অনুসন্ধান" নামক অনুকাব্যে।তাঁর অনুসন্ধানের উপাদান ফুল, ফল,পাতা ও কাণ্ড ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় মূলে,আরও এগিয়ে মূল থেকে শাখামূলে।যতোই মূল থেকে শাখামূলে পৌঁছোই ততোই বাড়ে বিভ্রান্ত। বাড়ে জটিলতা। ঐতিহাসিক তখন প্রমাদ গোনেন।অনেক সময় কেঁচো খুঁড়তে কেঁউটে বেরিয়ে পড়ে। প্রবুদ্ধ কবি এসব ভালোই বোঝেন। তাই তো তিনি বললেন,-----
"ইতিহাসের বহু গভীরে,
শেকড় ঢোকে নানান কোণে।
ঐতিহাসিক ঠিক উপরে
খুঁড়তে গিয়ে প্রমাদ গোনে।"
অনেক সময় একটা পুরোনো বাড়ি তার একটা ইতিহাস আছে।হয়তো লোকশ্রুতি স্বরূপ সেই ইতিহাস মানুষের মুখে মুখে ঘোরে । কিন্তু ইতিহাসবিদ যখনই তা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন,দেখা যায় জানা ইতিহাসের উল্টো পথে হাঁটছে প্রকৃত ইতিহাস । অনেক সময় আসল সত্য এমনই হয় যা ভিমরুলের চাকে ঘা মারার মতো দশা। তাই কি সত্য উদ্ঘাটনের পথে গবেষক প্রমাদ গোনেন?
কোনও কিছুই অস্বাভাবিক নয়।দেখা গেছে যুগে যুগে শাসকশ্রেণী নিজেদের সুবিধার্থে আসল সত্য কে ধামাচাপা দিতে প্রভাব খাটান।ফলস্বরূপ প্রচারিত হয় বিকৃত ইতিহাস । কিন্তু প্রকৃত সত্যান্বেষী যখন তা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তখনই বেরিয়ে আসে আসল সত্য। তখন অবাক হতেই হয়।ঐতিহাসিকও তাই সেই প্রমাদের ব্যতিক্রম নন।
সত্যান্বেষী (গবেষক) নাছোড় ।এই নাছোড় মনোভাবই গবেষকের সাফল্যের চাবিকাঠি। তিনি ঢুকতে চান অতলে।এবং খননকার্যে পাওয়া সংগ্রহীত উপাদান নিয়ে খুঁজতে থাকেন কার্যকারণ সম্পর্ক।ভাবনা যতো গভীরে পৌঁছোয় ততো তাড়াতাড়ি ধরা দেয় সাফল্য।এই প্রথমিক সাফল্যের স্বাদ প্রেরণা যোগায় আরও আরও গভীরে যেতে। তাই কবি বলেন,---
"কতোটা গভীরে ঢুকতে পারে,
সেটাই হলো সার্থকতা ।
জরিপ থেকে আলোর দ্বারে,
আসবে ছুটে মূলের কথা।।"
আর যুক্তি ও বুদ্ধির উপর ভর করে গড়ে ওঠা এই গভীর পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলই খুলে দেয় "আলোর দ্বার"।তখন গবেষকের মনোজগত আলোয় আলোকিত।সেই ইতিহাস তখন জোর করে কারুর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়না । আপনিই ছুটে এসে ধরা দেয় গবেষকের হাতে।ছুটে আসা "মূলের কথা" তখন অমৃতকথা । অর্থাত্ আদি সত্য ।
সত্যিই তো আমরা চারপাশে বিশাল বিশাল প্রাসাদ দেখি ।তাই নিয়ে আমাদের কতো গর্ব । এটা এই রাজা গড়েছেন,ওটা ওই রাজা।কিন্তু এই সভ্যতার মূল অর্থাত্ শ্রমজীবী মানুষের কথা আমরা কেউ উত্থাপন করিনা।যাদের ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ সব অট্টালিকা ।
সম্ভবত মানবদরদী কবি তাঁর "অনুসন্ধান" নামক এই রূপক কাব্যে রূপকের আড়ালে সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন ।
মাত্র আট লাইনের কবিতা । চার-চার লাইনের দুটি স্তবক। কিন্তু কি অসাধারণ ব্যপ্তি।নিখুঁত ছন্দে নির্মাণ ভাবগম্ভীর চমত্কার কাব্য ।
সুন্দর ভাবনাময় চমত্কার কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় প্রবুদ্ধ কবিকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই ।কলম চলুক এমনই দুর্বার গতিতে ।শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো ।