স্বাধীনতার এপিঠ-ওপিঠ
------------------
রমেন মজুমদার,২৬ শে মার্চ'২০২১
কলকাতা।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী
হয়ে গেল অনেক আগেই....
জানি, আমার এই লেখা কোনো পত্রিকায় হয়তো প্রকাশ পাবেনা।
তবুও এর চরম উত্তরীয় সম্পাদকীয়তে বলতে চাই..
যে স্বাধীনতার জন্য মুজিবের রক্তে রঞ্জিত হলো ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়ি। পাকিস্তান উপনেবেশিক কিছু কুলাঙ্গার আর্মি অফিসার মুজিবকে টেনে হিঁচড়ে সিঁড়িতে নামিয়ে তাঁকে গুলি করে মারলো।
একদিন আমিও মুজিবের মুক্তির জন্য গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে রাজপথে মিটিং মিছিল করেছি।
একটা প্রশ্ন থেকেই যায়,স্বাধীনতায় আমি/আমরা কতটা স্বাধীন, কি পরাধীন ? বাংলাদেশের সকল পত্রিকায় সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করলেও তারা নিজেরাই অনেকটা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। গত ১০ বছরে হিন্দুদের উপর অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলছে।
আজ বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর শ্রী নরেন্দ্র মুদি আজ বাংলাদেশের মাটিতে পা'রাখছেন।
এই সুবর্ণজয়ন্তীতে "স্বাধীনতার" শব্দটাই
একটা চরম প্রশ্নের সম্মুখীন।
আজ ২৬শে মার্চ ২০২১ সালে পূর্তি হলো ৫০ বছর।
১৯৭১ সালের এই দিনে আমি তখন কুড়ি বছরের তরুণ যুবক। রাজাকার আলবদরের প্রধান পিস কমিটির চেয়ারম্যান কর্তৃক আমিও সে সময় মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ঝোপজঙ্গলে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছি।
তার কারণ , ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আওয়ামীলীগে পক্ষে রাজপথে দিনের পর দিন মিটিং মিছিল করেছি।
সেই খবর রয়ে গেছে চেয়ারম্যানের মনে।কারণ সেই চেয়ারম্যান করতেন তখন মুসলিমলীগ। পাকিস্তানের চামচাগিরি ।ওদের মত লোকেরাই মা-বোনদের ইজ্জত লুটে নিয়েছিল তখন।
সেই ভয়াল একাত্তরে আমাদের গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় প্রায় অর্ধেকটা।কিছু উগ্র মুসলমান সাথে নিয়ে চরম লুটতরাজ করেন সেই চেয়ারম্যানের নির্দেশে।
মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয় আমাদের উপর,বিশেষ করে তরুণ শ্রেণীর উপর। যখন থানার পাকবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে
পিস কমিটির চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেয়া হয় আমাদেরকে ধরিয়ে দেবার জন্য।
এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে একদিন সেই চেয়ারম্যান কর্তৃক মিলিটারি নিয়ে আমাদের গ্রামে নির্বিচারে গুলি করে একের পর এক মানুষ হাত্যাকরা হয়।
লিষ্ট অনুযায়ী আমি তখন চার নম্বরের তালিকায় ছিলাম।
একে একে আমার গ্রামের যুবক বৃদ্ধ মিলে ১৯টি তরতাজা প্রাণকে ওরা নির্বিচারে ব্যায়নেটদিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
আমি সেই মৃত্যুর হাত থেকে কোনপ্রকার পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করি।
আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর রজতজয়ন্তী পালন উপলক্ষে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদের সফরে গিয়েছেন।
স্বাধীনতার অর্থ অনেক গভীর!
প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে না পারলে সেই স্বাধীনতার কোনো মানেই হয়না।
এর মূল অর্থ অন্যের পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়া। যে কারনে বঙ্গবন্ধু নিজে কঠিন সংগ্রাম করে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশকে।
একদা সমগ্র ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে।
১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট ভারত মাতা মুক্তি পেল ইংরেজ উপনেবিশ থেকে।
তার থেকে আরেক সন্তানের জন্ম হলো পাকিস্তান।ওরা ১৫ ই আগস্ট পালন করলো মুক্তির স্বাদ অর্থাৎ স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বঙ্গের মাটিতে কালরাত্রি শুরু হলো নিধনযজ্ঞ! বাঙালি নিধন !!
২৫ শে মার্চ মধ্যে রাতে শেখ মুজিবকে যখন পাকিস্তানী সেনারা ধরে নিয়ে যায়,তার পরের দিন সকালে আমি স্বপনের দোকানে চা পান করতে গিয়ে একজন পুলিশের মুখে খবরটা শুনতে পেলাম।
স্বপনের চায়ের দোকানের পাশেই থানা।
এই থানার একজন পুলিশ চা খেতে এসে আমাদেরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বললো,তোমরা পালিয়ে যাও কোথায়।
যে কোনো সময় এখানে মিলিটারি এসে ক্যাম্প তৈরি করবে।
তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেল পদ্মায়..
বুড়িগঙ্গা,মেঘনা,পদ্মা,ধলেশ্বরী,
আড়িয়ালখার
জলস্রোতে ভেসে যেতে লাগলো বাঙালির তরতাজা তরুণদের রক্ত !
ঢাকা,চট্টগ্রাম,রংপুর,ফরিদপুর,খুলনা,
সিলেট,গোপালগঞ্জ সমস্ত জেলা শহর জুড়ে শুরু হলো বাঙালি নিধন।
শেখ মুজিব স্বাধীনতার সনদ লিখে কালুরঘাট রেডিওতে পাঠিয়ে দিলেন।সে স্বাধীনতার পত্র পাঠ করলেন জনাব এম এ হান্নান।
তারপর সেই পত্র পাঠ করলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান।
তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন,
"অন বিহাফ অব আওয়ার বিলাভড লিডার শেখ মুজিবুর রহমান", আই জেনারেল জিয়া ডিক্লেয়ার দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্স অব বাংলাদেশ...’ওই দিনটি, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হয়ে ইতিহাতে উজ্জ্বল স্বাক্ষরিত হয়ে থাকলো।
মূলত জিয়াউর রহমান কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষক নয়।
সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটাই মূল স্বাধীনতার ডাক। সেদিনই হয়ে গেছিল স্বাধীনতার ভাষণ।।
লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ও রক্ত দিয়ে
ছাপন্ন হাজার বর্গকিলোমিটার বঙ্গের মাটি বিধৌত করেন রক্তের লেলিহানে।তারপর স্বাধীনতা।
কত লক্ষ প্রাণ মিরপুর ও মোহাম্মদপুর
বধ্যভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছে পাক বাহিনীর নির্মাণ অত্যাচারে,তার হিসাব কে কয়জনে আমরা বলতে পারবো ?
নয় মাস মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দিয়ে দেশ স্বাধীন করলো ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর।
ভারত সরকার লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের থাকা খাওয়ার জায়গা করে দিয়েছে সেই গৃহহারা মানুষদের ।
আমি তখন কৃষ্ণনগর ক্যাম্পে কিছুদিন কাটিয়ে ফণীভূষণ মজুমদারের ক্যাম্প বনগাঁও গিয়ে নাম লেখাই মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে।
কোনো কারণ বসত আর যাওয়া হয়নি।
তারপর দেশ স্বাধীন হলো পাকিস্তানের সেনা প্রধান আত্মসমর্পণ করলেন ঢাকার
রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় সেনা প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে।
স্বাধীনতা একসময় বিকৃত হতে লাগলো।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কিছু বাঙালি কুলাঙ্গার সেনা অফিসার কর্তৃক শেখ মুজিব স্বপরিবারে ঢাকার ধানমন্ডির বাড়িতে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে যান। ওরা শেখ রাসেলকেও প্রাণ ভিক্ষা দেয়নি।বঙ্গবন্ধুর কোলের সন্তান তাঁকেও কেড়ে নিল বুলেটের আঘাতে।
ক্ষমতাও আসলেন যারা ,তারা সকলেই জিয়াপন্থী।স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত হতে লাগলো দিনের পর দিন।
অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ক্ষমতায় এলেন শেখ হাসিনা।
তিনি শান্তির প্রতীকী। মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রীর কুর্শীতে বসে।
শেখ হাসিনার পরিবার খতম।তার কিছু চাওয়া পাওয়ার নেই। জনসেবাই তার মূলমন্ত্র।
তবুও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ফাঁসি দিলেন রাজাকার মতিউর রহমান গংদের।
এখন এই ২০২১ শতকে এসেও এক শ্রেণীর মানুষ বঙ্গের স্বাধীনতা,হাসিনার ইমেজ নষ্ট করার জন্য উগ্র কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক অত্যাচার করছে হিন্দুদের উপর।
তার জ্বলন্ত ইতিহাস হালে ঘটে যাওয়া সুনামগঞ্জে।
১৯৯০-৯১-৯২ সালে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে।লুটতরাজ,অগ্নিসংযোগ, এমনকি হিন্দু পুরুহিতদেরকেও পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
অনন্তকাল ইতিহাস এ ভাবেই বিকৃত হতে থাকবে। অনন্তকাল হিন্দুরা এভাবেই নির্যাতিত হয়ে আসবে।এটা একশ্রেণীর উগ্র
হায়েনার রক্তের ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কি !
তবু ভারতবাসীর প্রাণে এত দয়া যে উগ্রপন্থীর তাড়ায় পালিয়ে আসা কিছু হিন্দুদেরকে আশ্রয় দেয়া ছাড়া উপায় নেই।
এই ইতিহাস লিখলে সাতদিনেও শেষ হবেনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এখন বাংলাদের সফরে রয়েছেন। তবুও তার যাওয়াকে নিয়ে কিছু উগ্রপন্থী মুসলিমের কালো পতাকা,আন্দোলন,স্লোগান,
জমায়েত,প্রভৃতি বাংলাদেশের মটিতেই অহরহ ঘটছে।
এই কি স্বাধীনতা ?
১৯৭১ সালে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের বাসস্থান,খাবার,থাকার জায়গা করে দিয়েছিল এই ভারতই। আর সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনে সেই পাকিস্তানি দোসর এখনও বিযাঙ্কুর হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে।
**
স্বাধীনতা তুমি বেঁচে থাক অনন্তকাল মানুষের মনে। তুমি বিকৃত,বিক্রীত হতে যেওনা কোনো লম্পটের কাছে।
এই উদ্ধার্থ আহ্বান জানাই সকল বাঙালি মননের মানুষদের প্রতি,
সকলেই ভালো থেকো।
কলকাতা।