[প্রেক্ষাপট: সদ্য সতেরো পেরুনো এক তরুণ মুস্তাকিল। সদ্যই ¯œাতকে ভর্তি হয়েছে। উদারতাবাদ, মার্কসবাদ, স্বাধীনতাবাদ ইত্যাদি নিয়ে কেবল সে সাগ্রহে শিখতে শুরু করেছে। যা কিছু সে শেখে, দাদুর কাছে গল্প করে। কী করে দেশের সব মানুষকে সত্যিকারের স্বাধীনতা দেওয়া যায়_ সেই তার ভাবনা। স্বৈরাচারের শোষণে নিপীড়নে অবরুদ্ধ জাতি। কিন্তু, সে এখনি শক্ত সংগ্রাম চায় না। তবু হঠাৎ করে কীসের এক মিছিলে বাবা-হারা মুস্তাকিল হারিয়ে যায়। সেই শোক-সন্তপ্ত রাতে মুস্তাকিলের বৃদ্ধ বিকলাঙ্গ পিতামহ স্বগোতক্তি করতে থাকে:]

মুস্তাকিল, দাদুভাই, সারাদিন চলে গেল রাত হয়ে যায়!
এখনো মিছিল শেষ হয় নাই! দাদুভাই, তুই বাড়ি ফিরে আয়।
তোর বিধাব জননী দুপুরেও খায় নাই, তোর অপেক্ষায়।
মুস্তাকিল, দাদুভাই, মুস্তাকিল, দাদুভাই, বাড়ি ফিরে আয়।।

সাত-সকালে ঘাম-ভেজা কপালে তড়িঘড়ি উঠে চলে গেলি!
“আজকে স্বাধীনতা নিয়েই ফিরবো, দাদু” আমায় বলে গেলি!
রাত তো গভীর হলো, বারোটা তো পার হলো ঘড়ির কাঁটায়!
এখনো তোর ‘আজকে’ শেষ হয় নাই? তুই বাড়ি ফিরে আয়।।

ছোটবেলায়, আমারো দাদা ছিল_ মোহাম্মাদ হযরত আলী,
আজাদীর কথা বলে তোর মতো মিছিলে ঘুরে বেড়াতো খালি!
দাদাজান বলত_ “আজাদী এলে আমি আর মিছিলে যাব না।
তখন তো সত্য কথা বললে পেয়াদারা ধরে নিয়ে যাবে না।
আমার লাঙলে ফসল ফলাবো, আমার ফসল আমি খাবো।
দেশের রাজা আমরা বানাবো, কথা না শুনলে টেনে নামাবো।”
এই আশায় দাদা মিছিলে যায়; হঠাৎ পড়ে যায় দাঙ্গায়।
দাদা আর আসে নাই। তার রূপে তুই এলি ভাই, চলে আয়।।

দাদা চলে যাওয়ার পর, শুনলাম, এলো আজাদীর ভোর!
কী এক অধিকারের মিছিলে মরে গেল বাপজানও মোর।  
হুঙ্কারে বলত বাজান_ “অধিকার ছাড়া এই আজাদী ঝুটা;
আজাদীকে জনতার করে পেতে স্বৈরাচারের সংসার টুঁটা।
যে আজাদীর নতুন নিশানে জনগণের কোনো হিস্যা নাই,
সে আজাদী আমার নয়, আজাদীকে আমার করে পেতে চাই।”
আজাদীর পরেও আজাদীর তরে বাপজান মিছিলে যায়,
সেই যে গেল হায়! আর ফিরে আসে নাই, তুই ফিরে আয়।।

মিছিলে মিছিলে মুক্তির ছলে হারালাম দাদা আর পিতাকে।
আমরা দুই ভাই লড়াই করলাম, আনতে স্বাধীনতাকে।
আমরা ভাবলাম_ যদি পাই সুষ্ঠ গণতন্ত্র ও অধিকার,
তাহলেই স্বাধীনতা হবে জনতার, আমরা পাব সুবিচার।
আমাদের বুকে গুলি করে যেসব গুণ্ডা, পুলিশ আর সেনা,
তারা আমাদের লোক না, তাদের প্রতিরোধেই করলাম হানা।
সেই যুদ্ধেই আমার ভাইয়ের প্রাণ যায়, আর আমার ঠ্যাং যায়।
স্বাধীনতায় প্রাণ তো দিলাম কত, তুই কেন দিবি তায়?

লাখ শহিদের তালিকায় আমার ভাইয়ের নামটা নাই!
তুই বললি_ “দাদাভাই, শহিদের তালিকাই তো নাই!
আর শহিদের তালিকার দরকারটা কি আসলেই আছে?
মানুষ থেকে মানুষকে বেছে বেছে আলাদা করলে পাছে,
সাম্যের আদর্শে মুক্তির সংগ্রামটাই হয়ে যায় বরবাদ;
পড়ে দেখো উদারতাবাদ, মার্কসবাদ আর স্বাধীনতাবাদ।”
তুই বলতি_ “মুক্তির মানে শেখার আগে বোকারা যুদ্ধে যায়।”
আজ মিছিলে গেছিলি কেন? তুইও কি বোকা হায়? বল, আয়।।

ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার লুটছে জনতার মুক্তি ও অধিকার।
তুই বলতি_ “এখন কোনো ধ্বংসাত্মক সংগ্রাম চাই না আর।
আমি বড় হয়ে শিক্ষক হবো, ফ্যাসিস্টের সন্তানকে পড়াবো,
আমার মুক্তি-হত্যার বেদনার সুর তার কানে ঢেলে দেবো।
আম-জনতাকে শেখাবো_ ম্যাপ ও পতাকাই নয় স্বাধীনতা,
স্বাধীনতা মানে জনতার স্বাধীনতা, অধিকার ও সমতা।”
তুই-ই তো হারিয়ে গেলি ভাই, মুক্তির মানে আজ কে শেখায়?
জনতাকে আজ পথ কে দেখায়? দাদুভাই, তুই চলে আয়।।

স্বাধীনতার বহুমত, বহুপথ, বহু তত্ত¡কথার শেষে,
তুই বলতি হেসে_ “স্বতন্ত্র আলাদা পথ লাগবে বাংলাদেশে।
ডানপন্থী স্বাধীনতাবাদে বাতলানো সম্পূর্ণ মুক্তবাজারে,
ব্যবসায়ী-গুণ্ডারা সিন্ডিকেট গড়ে জনতার পকেট মারে!
ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশি সন্তান মানবে বামধারার মত,
বাংলাদেশকে খুঁজে পেতে হবে নিজস্ব মুক্তির স্বকীয় পথ।”
পথহারা পথিকেরা পথচেয়ে বসে আছে তোর অপেক্ষায়,
সেই স্বকীয় নিজস্ব পথ প্রস্তুত করতে তুই চলে আয়।।

তোর অভুক্ত জননী ভাত বেড়ে বসে আছে তোর অপেক্ষায়,
সংগ্রামে প্রাণ হারানো পূর্বপুরুষেরাও তোর পথপানে চায়,
স্বৈরাচারের আওতায় পরাধীন জনতা পথ পেতে চায়,
তোর বৃদ্ধ বিকলাঙ্গ দাদা পথচেয়ে বসে আছে তোর আশায়।।

এতো জনম ধরে মুক্তির তরে আমরা দিলাম যত প্রাণ,
সে বেদনা হতে মুক্তি পেতে আমিও চললাম দিতে প্রাণদান।
তোদের মিছিলে আমার লাশের মিশেলে ঝড় তোল বাংলায়,
নিজেরে খুন করে মুক্ত বাংলায় তোর দাদু তোর মুক্তি চায়।।
রচনাকাল: ১৮-২০ জুলাই ২০২৪


সাহিত্যশৈলী:  কবিতাটি একই সঙ্গে একটি একক নাটকীয় স্বগোতক্তি ও গীতিকবিতা। ১০ স্তবকের এই কবিতাটির প্রতি পঙক্তি গঠিত হয়েছে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের হিসেবে ২২টি করে মাত্রার দ্বারা। তবে, সবগুলো স্তবকের পঙক্তিসংখ্যা সমান নয়। প্রথম ২টি এবং শেষ ২টি স্তবকে পঙক্তি রয়েছে ৪টি করে। মাঝের ৬টি স্তবকে পঙক্তি রয়েছে ৮টি করে। মাত্রাসাম্য ও অন্তমিলের সুষম মিশেলে গড়া এই কবিতাটার স্তবকগুলো অসমান কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটু কবিতাটার ভাবের দিকে তাকাই। কবিতায় দাদার স্বগোতক্তির মাঝেই বিভিন্ ব্যক্তির উক্তি এনে ব্যাখ্যা করা হয়েছে _কী করে উদারতাবাদ, মার্কসবাদ, স্বাধীনতাবাদ_ তিনটিরই শাখা-প্রশাখাগুলো মানুষকে মুক্তি দিতে চায়। সকলের লক্ষ্য এক তবে, পথ আলাদা। আলাদাপথের আলাদা টানে সমাজ ছুটে চলেছে ভবিষ্যতের পানে হেলে-দুলে এক অনিশ্চিত অবারিত অসীমের কোলে, এতো এতো অমিলের মিলে সুললিত এক ছন্দের তালে এই কবিতার মতোন।