ফরাসী “ট্রায়োলেট” ( Triolet) পুনরোক্তিমূলক আট লাইনের অনন্য কবিতা
রহমান মুজিব
সাহিত্য এক আলোর দ্বীপ। এখানে প্রতিনিয়ত আনন্দের বর্ণালি দীপাবলি জ্বলে। এ দ্বীপে কবিতা হলো ফুলের বসন্ত-বাগান। এ বাগানে নানান ফুলে নানান সুবাস, নানান রঙের রংবাহার। নানান সুর মন্দ্রিত হয় এখানে। সুললীত সুবাসের ফল্গুধারা বহে এ ফুলের নহরে থেকে। এ এমন এক ভান্ডার, যেখানে গেলে রস পিয়াসী নীল ভ্রমরা অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে আসে না। আসতে পারে না।
এ ফুলের বাগানে ইতস্তত হাঁটতে গিয়ে কবিগুরুর একটা গানের বাণী কানে কানাকানি করে, প্রাণে প্রদীপ প্রজ্জলিত করল, “ ...ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভালো।...” এমনি এক রজনিগন্ধা ফ্রান্সের বাগানে ফোটা “ট্রায়োলেট (Triolet)”।
ত্রয়োদশ শতক থেকে ফ্রান্সরে বাগানে এ ফুল ফোটে আজও নানা ভাষার কবিতায় সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্রায়তনের সরল বেধের এ কবিতা আট লাইনের। এর চলন ভাব হালকা পলকা চালের। এর বিশেষ বৈশিষ্ট হলো। আট লাইনের কবিতার(৩+২) পাঁচ লাইনই পুনরোক্তি বা পুনরাবৃত্তি। ইংরেজিতে যাকে বলে রিপিটেশন। এর প্রথম,চতুর্থ ও সপ্তম লাইন অভিন্ন । আবার দ্বিতীয় এবং অষ্টম লাইনও অভিন্ন । থাকল বাকি তিন। এ তিনটি লাইন দিয়েই পাঁচটি পুনরোক্তিমূলক লাইনের ভাব সমন্বয়ের মাধ্যমে বাঁধনে জড়াতে হয়। মজার এক জটিল বিষয়। তাইনা?
“ট্রায়োলেট (Triolet)” এর সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় উইকিপিডিয়াতে বলা আছে, “ A triolet is almost always a stanza poem of eight lines, though stanzas with as few as seven lines and as many as nine or more have appeared in its history. Its rhyme scheme is ABaAabAB (capital letters represent lines repeated verbatim).”
অরোকিছু পাঠ পর্যালোচনায় বলা যায়, “ ট্রায়োলেট হচ্ছে প্রধানত আট চরণের কবিতা। এর মেলবন্ধ হবে “ABaAabAB” বড় হাতের অক্ষরগুলো এর পুনরোক্তিমূলক চরণ। বা “কখকককখকখ” নিচে রেখা দেওয়া মিলের চরণগুলো অভিন্ন কথার হবে। অর্থাৎ ১ম, ৪র্থ ও ৭ম চরণ অভিন্ন থাকবে। ২য় আর ৮ম চরণও অভিন্ন হবে। সাত বা নয় লাইনেও কিছু ট্রায়োলেট রচিত হয়েছে। বেশিরভাগ হয়েছে আট লাইনে। আমরা আট লাইনের ট্রায়োলেটই চর্চা করতে চাই।ইংরেজতে আয়াম্বিক ছন্দে ট্রায়োলেট লিখা হয়।বাংলা বনেদি তিনটি ছন্দেই ট্রায়োলেট লিখা যাবে। সমমাত্রার লাইন হলে ভাল হয়।লক্ষ করুন মিল মাত্র দুটি। পুনরোক্তি হয় তিন বার। ট্রায়োলেটের প্রথম দুলাইন খুবই গুরত্বপূর্ণ। কারণ প্রথম দুলাইনই শেষ দুলাইন হয়। প্রথম লাইন দুবার এবং দ্বিতীয় লাইন একবার মোট তিনবার রিপিটেশন হয়। অভিন্ন কথার লাইন হয় পাঁচটি। সব শেষ রিপিটেশনে কখনো কখনো ভাবের ভিন্ন ব্যঞ্জনা দেওয়া যায়।
ত্রয়োদশ শতকে ট্রায়োলেট গীত হিসেবে চিহ্নিত হতো। এডিনেট লি রয় (Adenet le Roi) ত্রয়োদশ শতকে এবং জেন লেসকুরেল (Jean Lescurel) চতুর্দশ শতকে ট্রায়োলেট লিখে খ্যাতিমান হন। প্যাট্রিক ক্যারি (Pstric cary) ইংরেজি ভাষায় ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে ট্রায়োলেট লিখেন। এরপর Robert Bridges, Austin Dobson সহ অনেকেই ট্রায়োলেট রচনায মনোনিবেশ করেন। নিচে কয়েকটি ট্রায়োলেট এর দৃষ্টান্ত দেওয়া হলো।
1. Farewell all earthly joys and care
Worldly designs, fears, hopes, farewell!
Farewell all earthly joys and cares!
On nobler thoughts my sould shall dwell,
Worldly designs, fears, hopes, farewell!
At quiet, in my peacefull cell,
I'll think on God, free from your snares;
Worldly designs, fears, hopes, farewell!
Farewell all earthly joys and cares.
Patrick Cary
2. When we first met
When first we met we did not guess
That Love would prove so hard a master;
Of more than common friendliness
When first we met we did not guess
Who could foretell this sore distress,
This irretrievable disaster
When first we met? We did not guess
That Love would prove so hard a master.
Robert Bridges
3. Love's but a dance
Oh, Love's but a dance,
Where Time plays the fiddle!
See the couples advance,--
Oh, Love's but a dance!
A whisper, a glance, --
Shall we twirl down the middle?
Oh, Love's but a dance,
Where Time plays the fiddle!
Austin Dobson
4.A Kiss,
Rose kissed me to-day.
Will she kiss me to-morrow?
Let it be as it may,
Rose kissed me to-day,
But the pleasure gives way
To a savour of sorrow;—
Rose kissed me to-day,—
Will she kiss me to-morrow?
Austin Dobson
তের্জারিমার মতো ‘ট্রায়োলেট’ মেলবন্ধের কবিতাও বাংলা কাব্যে প্রথম আনেন প্রমথ চোধুরী। তিনি ট্রায়োলেট নিয়ে বলেছেন, “ট্রায়োলেট লিখাও কঠিন– তার পুনরোক্তির জন্য।”
প্রমথ চোধুরীর লিখা একটি “ট্রায়োলেট (Triolet)” নিচে তুলে দেওয়া হলো:-
“তোমাদের চড়া কথা শুনে ক
হয় যদি কাটিতে কলম খ
লেখা হবে যথা লেখে ঘুণে ক
তোমাদের চড়া কথা শুনে । ক
তার চেয়ে ভাল শত গুণে ক
দেয়া চির লেখায় অলম খ
তোমাদের চড়া কথা শুনে ক
হয় যদি কাটিতে কলম । খ”
প্রতিভাধর এ কবি দ্বারা প্রাণিত হয়ে আমিও সামান্য চেষ্টা করেছি। দেখুনতো কিছু হলো কি-না?
রহমান মুজিবের দুটি ‘ট্রায়োলেট’
সত্য অতুল উচ্চে
অথৈ মেধা যতই দেখাক যুক্তি
সত্য চারু সত্য অতুল উচ্চে
এই কথাতে কই অতিশয়োক্তি?
অথৈ মেধা যতই দেখাক যুক্তি।
সত্য বিনা কোথায় পাব মুক্তি
মিথ্যা যতই সাজুক সোনার পুচ্ছে
অথৈ মেধা যতই দেখাক যুক্তি
সত্য চারু সত্য অতুল উচ্চে।
ফুটতে থাকে রক্ত
(প্রেক্ষিত: শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন)
টগবগ করে ফুটতে থাকে রক্ত
জবজব ভেজা রক্তে যাদুর অঙ্গ
চুপচাপ দেখে সামলানো বেশ শক্ত
টগবগ করে ফুটতে থাকে রক্ত।
চুপচাপ কেঁদে গর্বে হলাম ভক্ত
ঝিলমিল জ্বলে আরেক নতুন বঙ্গ
টগবগ করে ফুটতে থাকে রক্ত
জবজব ভেজা রক্তে যাদুর অঙ্গ!
উক্ত আলোচনার প্রক্ষিতে চলুন আমরাও সচেষ্ট হই। কিছু নির্মাণের লক্ষে।
তথ্যসূত্র:
ক)আধুনিক বাংলা ছন্দ- নীলরতন সেন।প্রথম দে’জ সংস্করণ: আশ্বিন ১৪০২।
খ) অন্তর্জাল।