কবিতা কষ্টের কলা। সৌন্দর্যের অনন্য জগত। এর প্রেমে পড়ে বিশ্বের কোণে কোণে ভাব- ভাবনা ও বৈচিত্র্যের শিল্পমগ্ন  কবিগণ নানান আঙ্গিক-কাঠামোয় ছবি এঁকে যান কালের পাতায়। আমরা তন্ময় হয়ে দেখি আর ভাবি," তুমি কেমন করে গান করো হে গুণি..!" এমনই এক বাগাড়ম্বরহীন ছবির কবিতা 'তানকা'।

জাপানি হাইকুর মতো তানকা (Tanka)  বা ওয়াকা একটি অল্প কথার গীতি কবিতা । তানকা হাইকুর পূর্বপুরুষ এবং জাপানের প্রচীনতম কাব্যকাঠামোগুলোর একটি। Tan= (short) ক্ষুদ্র,  Ka= poem কবিতা। সুতরাং তানকা (Tanka) হলো Short poem বা  ছোটকবিতা। এ কবিতা মোট ৩১ (মোরা) বা সিলেবলে সমাপ্ত হয়।  ঐতিহ্যগাতভাবে  তানকা এক লাইনে লিখা হতো।  পরবর্তীতে ইংরেজি অনুবাদে এটি পাঁচ লাইনে লিখা হয়ে আসছে । ‘তানকা’কে  তানকা সনেট নামেও অভিহিত করা হয়।

তানকার সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় উকিপিডিয়াতে বলা আছে-
Tanka ( "short poem") is a genre of classical Japanese poetry and one of the major genres of Japanese literature.
Tanka consist of five units (often treated as separate lines when romanized or translated) usually with the following pattern of on (often treated as, roughly, the number of syllables per unit or line): 5-7-5-7-7.

The 5-7-5 is called the kami-no-ku  ("upper phrase"), and the 7-7 is called the shimo-no-ku ("lower phrase").

একাডেমি অব আমেরিকান পয়েট্স এ বলা আছে,
“The Japanese tanka is a thirty-one-syllable poem, traditionally written in a single unbroken line. A form of waka, Japanese song or verse, tanka translates as “short song," and is better known in its five-line, 5/7/5/7/7 syllable count form.”

খ্রিস্টিয় পাঁচ শতকের আগ পর্যন্ত জাপানিদের কোন লিখিত ভাষা ছিল না। চীন থেকে তাঁরা বর্ণমালা নেন, যা ৪০৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানে প্রচলিত ছিল।তানকা (Tanka) এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় এটি জাপানের সুপ্রাচীন কবিতাগুর মধ্যে অন্যতম। এটি সপ্তম শতকের কবিতা। প্রাথম দিকে ‘তানকা’   ৫-৭-৫-৭-৭ মোরাসে দুজনে মিলে পাঁচটি  লাইনে লিখার প্রচলন ছিল। পাঁচ-সাত-পাঁচ সিলেবলে প্রথমে একজন কবি রচনা করতেন প্রথম কাব্যাংশ। এরপর  অনুরূপভাবে দ্বিতীয় কবি সাত-সাত সিলেবলে দ্বিতীয় কাব্যাংশ। তানকা কবিতাকে (Tanka)   ওয়াকা কবিতা নামে অভিহিত করা হয়।তানকা বা ওয়াকার আঙ্গিকে যখন বেশি চরণের কবিতা রচিত হয় তখন তার নাম হতো 'রেঙ্গা'(Renga) কবিতা । জাপানের 'Heian Period' ( ৭৯৪ – ১১৮৫ ) থেকে  বিভিন্ন কবি ও রাজদরবারে অভিজাত ব্যক্তিত্ববর্গ রেঙ্গা বা 'তানকা' কবিতার প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই 'haikai-no-renga' রেঙ্গা কবিতারও প্রচলন হয়। সেই কবিতা গুলি 'হাইকাই'(Haikai) এর মতো হলেও  ওগুলো ছিল হাস্যরসাত্বক কবিতা । তবে তা সতেরশ' শতাব্দী পর্যন্ত অভিজাত ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অনেক কবি যখন সমবেতভাবে একটি দীর্ঘ হাইকাই রচনা করেন তখন তাকে বলা হতো রেঙ্গা। এটি ১০০লাইন পর্যন্ত হতো।

তানকার বৈশিষ্ট:

ক) তানকা ৫ লাইনে ৩১ সিলেবলে সমাপ্ত হয়।এর পাঁচটি লাইন নিম্নরূপে বিন্যস্ত। যেমন:

১ম লাইন= ৫ সিলেবল বা মাত্রা।
২য় লাইন= ৭ সিলেবল বা মাত্রা।
৩য় লাইন= ৫ সিলেবল বা মাত্রা।
৪র্থ লাইন= ৭ সিলেবল বা মাত্রা।
৫ম লাইন= ৭ সিলেবল বা মাত্রা।

খ) এর নির্দিষ্ট কোনো মিল বিন্যাস নাই।

গ) এর দুটি কাব্যাংশ থাকে। প্রথম অংশ হাইকুর মতো ৫/৭/৫ তিন লাইন। এটিকে জাপানি ভাষায় (কামি নো কু) / upper phrase. বলে। এতে কবিতার বিষয়বস্তু,রূপ-প্রতিরূপ, ছবি-চিত্র বণির্ত হয়। দ্বিতীয় অংশে ৭/৭ দুই লাইন। এটিকে জাপানি ভাষায় বলে  (শিমো নো কু) / lower phrase. এখানে কবিতার সারকথা বা চূড়ান্ত পরিণতি ব্যক্ত হয়।

ঘ)  আদর্শ তানকায় একটা দৃশ্যকল্প বা ইমেজ থাকবে যাকে কেন্দ্র করে কবিতাটি পর্যায়গত উত্তরণ ঘটবে। অর্থাৎ প্রথম তিন লাইনে যে দৃশ্যের অবতারনা হবে তার সাথে সঙ্গতি রেখে পরের দুলাইনে মূলকথা উপস্হাপিত হবে।

বিষয়বস্তু:

ঋতুচিত্র বা প্রকৃতি, জীবনের রূপবৈচিত্র্য, আনন্দ-বেদনা,আশা- নিরাশা, শিক্ষামূলক অভিব্যক্তি, নীতি- নৈতিকতা, বাদ-প্রতিবাদ, ভালোবাসা, আবেগানুভূতি ইত্যাকার বিষয়াবলী নিয়ে তানকা রচিত হতে পারে। আর কবিতার বিষয় নির্বাচন করা কবির একান্ত ইচ্ছাধীন।

তানকার  নমুনা:

১)
“On the white sand
Of the beach of a small island
In the Eastern Sea.
I, my face streaked with tears,
Am playing with a crab.” (Ishikawa Takuboku)

২)
“The bucket's water
poured out and gone,
drop by drop
dew drips like pearls
from the autumn flowers.” (Masaoka Shiki)

বাঙালিদের সাথে জাপানি সাহত্যির প্রথম পরিচয় ঘটান সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র। 'জাপানি ঝিনুক' নামে তিনি হা্ইকু অনুবাদ করেন।অতঃপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাইকুর অনুবাদ এবং হাইকুর আদলে কবিতা লিখেন। কিছু তানকা লিখেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।নিচে তাঁর একটি তানকা উদ্ধৃত করা হলো।

“অশ্রুর দেশে
হাসি এসেছিল ভুলে;
সে হাসিও শেষে
মরণে পড়িল ঢুলে
অশ্রু সায়র কূলে”।( তানকা সপ্তক)

এখানে মাত্রাবৃত্তে ৬,৬/২,৬,৬/২,৬/২=৩৬মাত্রা হয়।

আমার ‘পলিমাটি ডট কম’ গ্রন্থে  তানকার আদলে লিখা দুটি অনুকাব্য আছে। তা নিম্নরূপ:


“চাহনিতে তার
বুকে বিধেঁ চুখা তির
রোচে না আহার
ভাসে মুখ প্রেয়সীর
মন মিলনে অধীর!” (মাত্রাবৃত্তে ৩৬মাত্রা)


চান্দু শেখের চেলা
গরীব দুখির ভাগ্য নিয়ে
নিত্য করেন খেলা;
নিঃস্ব লোকের রক্ত পিয়ে
উথলে ওঠেন চর্বি ঘিয়ে!(স্বরবৃত্তে ৩৬মাত্রা)

সুতরাং এগুলোতে তানকার আদল থাকলেও তানকা বলা যাবে না।কবিতাদ্বয় ২০০৪ সালে রচিত।তখন আমার জানাটা অসম্পূর্ণ ছিল। এবার আসুন অধুনা জানা থেকে তানকা লিখার প্রয়াসী হই।

নিচে সদ্যলিখা দুটি তানকা উপস্থাপন কর হলো :

তানকা

ঠোঁটে রাঙাফুল
এবং অন্তরে ফাগুন
প্রিয়া গুলের বাগ;
ধগ্ধি তার অনুরাগে
দেখো, এ কেমন আগুন! (স্বরবৃত্তে ৫/৭/৫/৭/৭)

তানকা

সুদূরাকাশে
রামধনু মৃদু হাসে
মেঘদল ভাসে;
তা শুনে এক কানা
খুঁজে পরীর ডানা! ( অক্ষরবৃত্ত)

প্রশ্ন উঠতে পারে প্রায় ১২০০ বছর পূর্বের এক কাব্য কাঠামো( form ) নিয়ে  আমরা মেতে উঠব কেন? মেতে উঠব এজন্য, এখানে কথাকে ফেনিয়ে ফেনিয়ে না বলেও অল্প কথায় গল্প করা যায়। এখানে ছবিগুলো কথা বলে, তাই কবিতার বর্ণিত বিষয় দেখা এবং ক্ষত্রেবিশেষে শোনেও যায়। আর আধুনিক যান্ত্রিক কর্মব্যস্ত জীবনের সাথে বেশ সঙ্গতিপূর্ণ।

উক্ত আলোচনার প্রক্ষিতে চলুন আমরাও চেষ্টা করি কিছু বিনির্মাণের লক্ষে।

তথ্যসূত্র:
ক)আধুনিক বাংলা ছন্দ- নীলরতন সেন।প্রথম দে’জ সংস্করণ: আশ্বিন ১৪০২।
খ) অন্তর্জাল।