মানুষ চিন্তাশীল প্রাণি। চিন্তা থেকে আসে ভাব। ভাবের বাঁধন ভাষা। এ ভাষা যখন নিত্যনৈমিত্তিকতার বাইরে এসে ভিন্নরূপে ভাবকে প্রকাশ করে তখন সৃষ্টি হয় কাব্য। কাব্যের আকার প্রকার আবার নানা রূপের। রুপ থেকে আসে রুপপ্রকল্প, কাঠামো,ছাঁচ (From)। মহাকাব্যও কবিতা, আবার এক দুলাইনের অনু কবিতাও কবিতা। মূল বিষয় হলো একটা ভাবকে সুচারু রূপে প্রকাশ করা, যা নন্দনতাত্ত্বিক মানে রসোত্তীর্ণ। ‘শামুকে সমুদ্রের গর্জন’, ক্ষুদ্রায়তন রচনার শক্তি প্রকাশক দ্যোতনাময় উক্তি। জাপানের এক লাইন বিকল্পে তিন লাইনের ‘হাইকু’ তেমনি এক শামুকে সমুদ্রের গর্জন শোনানো অনুকবিতা। জাপানি ‘হাইকাই’ শব্দটির অর্থ হল মজা, কৌতুক, পার্থিব ইত্যাদি।
হাইকুর সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় Oxford English Dictionary তে বলা আছে, “A Japanese poem of Seventeen syllables, in three lines of five, seven and five.”
আবার Cambridge Advanced learner’s Dictionary বলে, “ A short Japanese poem in 17 syllables.”
আবার Academy of American poets বলেছেন, “A traditional Japanese haiku is a three-line poem with seventeen syllables, written in a 5/7/5 syllable count. Often focusing on images from nature, haiku emphasizes simplicity, intensity, and directness of expression.”
তাই বলা যায় হাইকু হচ্ছে তিন লাইনের সেই ঐতিহ্যবাহী কবিতা যা, ৫/ ৭/ ৫ = ১৭ (মোরাস) মাত্রায় সমাপিতব্য। তবে কোথাও কোথাও ১৭ মাত্রার বেশি এবং তিনের অধিক লাইনেও হাইকু রচনার প্রয়াস দেখা যায়। প্রায়সঃই এতে ঋতু ভিত্তিক বর্ণময় চিত্রকল্পকে কেন্দ্র করে সহজ কথায় গভীর ভাবের বিস্তার ঘটানো হয়। এতে অন্ত্যমিল কদাচিৎ দেখা যায়। হাইকুর জন্ম জাপানে। তারপর কাব্যাদর্শের ক্যারিসমেটিক গুণে এটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পরে। হাইকু শব্দটি বহুবচন। এর একবচন ‘হাইকি’। কবি মাতসুও বাশো (১৬৪৪-৯৪) বুসন (১৭১৫-৮৩) ও ইসা (১৭৬২-১৮২৬) এঁরা হচ্ছেন জাপানের সুপ্রসিদ্ধ হাইকু কবিতার রচয়িতা।
হাইকুর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায় প্রাথম দিকে 'রেঙ্গা'(Renga) কবিতা ৫-৭-৫-৭-৭ মোরাসে মোট পাঁচটি লাইনে লিখার প্রচলন ছিল। 'রেঙ্গা' (Renga)কবিতাকে তান্কা (Tanka) বা ওয়াকা কবিতা নামে অভিহিত করা হতো। জাপানের 'Heian Period' ( ৭৯৪ – ১১৮৫ ) থেকে বিভিন্ন কবি ও রাজদরবারে অভিজাত ব্যক্তিত্ববর্গ রেঙ্গা বা 'তানকা' কবিতার প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই 'haikai-no-renga' রেঙ্গা কবিতারও প্রচলন হয়। সেই কবিতা গুলি 'হাইকাই'(Haikai) এর মতো হলেও ওগুলো ছিল হাস্যরসাত্বক কবিতা এবং তাতে কিছুটা লঘু মানের শীল্পবোধ ছিল। তবে তা সতেরশ' শতাব্দী পর্যন্ত অভিজাত ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ক্রমাগত বিবর্তনে সেই রেঙ্গা বা তানকা বা ওয়াকা কবিতা থেকেই হাইকু কবিতার উৎপত্তি। রেঙ্গা কবিতা একাদিক কবি মিলে রচনা করতেন। অনেক কবি যখন সমবেতভাবে একটি দীর্ঘ হাইকাই রচনা করেন তখন তাকে বলা হয় রেঙ্গা। পাঁচ-সাত-পাঁচ স্বরের সাহায্যে প্রথমে একজন কবি রচনা করেন প্রথম চরণ। এরপর অনুরূপভাবে দ্বিতীয় কবি দ্বিতীয় চরণ। এভাবে পর্যায়ক্রমে কয়েকজন কবির হাত ঘুরে একটি ‘রেঙ্গা’ কবিতা জন্ম নেয়। এই রেঙ্গা সভার কবিদের মধ্যে বাশো ছিলেন সবথেকে দক্ষ ও জনপ্রিয়। ‘রেঙ্গাতে’ একেক কবির অংশকে আলাদাভাবে ‘হোক্কু’ বলা হতো। বাশোর হাত দিয়ে কোন রেঙ্গার শুরু হলে সেটি বেশ ভালো হতো। আবার অনেক সময় পরবর্তী কবিরা তাঁর সাথে তাল মেলাতে পারতনে না। তাই বাশো প্রায়ই তাঁর ‘হোক্কু’ আলাদা করে লিখতেন। সেই 'হক্কু' কবিতায় পরিবর্তন এনে মাতসুও বাশো ( ১৬৪৪ – ১৬৯৪ ) সেগুলিকে অন্যান্য 'তানকা বা ওয়াকা' কবিতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ৫-৭-৫ মোরাসে নতুন ধরনের এক ক্ষুদ্র কবিতার প্রচলন করেন! তারপরে Masaoka Shiki (১৮৬৭ – ১৯০২ ) বাশোর কবিতাকে 'হাইকু' নামে নামকরণ করেন । আধুনিক জাপানি কবিদের অনেকেই মনে করেন বাশোর সঙ্গে হাইকুর শুরু এবং শেষ। নিচে কয়েকটি হাইকু দেয়া হলো।
বাশো (১৬৪৪-৯৪) এর একটি হাইকুর ইংরেজি উচ্চারণ
“ha-tsu shi-gu-re (5)
sa-ru mo ko-mi-no o (7)
ho-shi-ge na-ri” (5)
এর অনুবাদ প্রথমটি।
*
শীতের বৃষ্টিতে
বানরেও খোঁজ করে
একটা বর্ষাতির।
*
শরতের বৃষ্টি
হিম নেকাবে ফুজি পাহাড়
কেড়ে নেয় দৃষ্টি!
বুসান (১৭১৫-৮৩)
মৌশুমি বৃষ্টি
নামহীন নদীর কিনারে
ভয়েরও নাম নেই।
ইসা (১৭৬২-১৮২৬)
এক পশলা বৃষ্টি
একাকি একটা মানুষ
চেরিফুল ছায়ায়।
হাইকুর বৈশিষ্ট:
হাইকু সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “এ ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়।” কবিগুরু তাঁর “জাপানযাত্রী” বইয়ের মাধ্যমে বাংলায় “হাইকু” নিয়ে প্রথম আলোকপাত করেন।বিভিন্ন আলোচনা থেকে নিম্নরূপভাবে আমরা হাইকুর বৈশিষ্টগুলো বুঝে নিতে পারি।
১) জাপানি হাইকু এক লাইনে বা তিন লাইনে লিখা হয়। ইউরুপিয়দের মতো বাংলায়ও তিন লাইনে হাইকু লিখিত হয়। হাইকুকে বলা হয়ে থাকে এক মুহূর্তের ভাবনা। কিন্তু এর বিস্তার অনেক। পাঠক তার মনের মাধুরি মিশিয়ে ভাবনার ডালপালা প্রসারিত করে নিজ নিজ দৃষ্টিকোন থেকে বুঝে নিতে পারে।
২) একটি হাইকুতে ১৭টি মোরাস থাকে। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় ‘মোরাস’ মাত্রা হিসেবে ধরে নিয়ে হাইকু চর্চা হয়ে আসছে। অর্থাৎ বাংলা হাইকু ৫/৭/৫= ১৭ মাত্রায় পদ্য ছন্দে লিখিত হয়ে থাকে। মোরাস ও মাত্রা এক রকম নয়। মোরাস, দল/অক্ষর/ সিলেবল ও মাত্রা প্রতিটি ভাষার নিজস্ব শ্বাস মোতাবেক হয়। জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিগণ মনে করেন মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক।জাপানি ১২ মোরাসে ১৭ সিলেবল হয়। ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ সিলেবলের পরিবর্তে আরো বেশি সিলেবলের হাইকু লেখা শুরু হয়। এখানে উল্লেখ্য যে প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব ছন্দ রীতি আছে। সেমতে সে ভাষার কাব্য রচিত হয়। বাংলা ভাষার ছন্দরীতি মেনে বাংলা ‘হাইকু’ রচিত হবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু হাইকুর অন্যতম বৈশিষ্ট তার সংক্ষিপ্ততা সেহেতু তিন লাইনের এবং ১৭ মাত্রার অধিক লাইন বা মাত্রায় লিখিত রচনা হাইকু হিসেবে স্বীকৃত হবে কিনা ভাববার অবকাশ থেকে যায়। সেসব কবিতাকে অন্য নামে অভিহীত করলে ক্ষতি কি? এখানে উলেখ্য বাংলা ছন্দবিজ্ঞানে সিলেবল (অক্ষর/ দল )এবং মাত্রা এক জিনসি নয়। কেননা মুক্ত উলেখ্য সিলেবল/ অক্ষর/ দল সব ছন্দে এক মাত্রা হলেও মাত্রাবৃত্তে দুইমাত্রা এবং অক্ষরবৃত্তে শব্দের আদি মধ্য একমাত্রা অন্ত্যে দুই মাত্রা ।
৩) হাইকুতে সাধারণত এক বা একাধিক চিত্র উপস্থাপিত হয়।
৪) বনেদি হাইকুতে প্রকৃতিচিত্র থাকে। একে ‘কিগো’ বলা হয়।কিগো হচ্ছে প্রকৃতিচিত্র তথা প্রাণি, পাখি, কীট-পতঙ্গ এবং ঋতু ভিত্তিক ছবি। এসব সম্বলিত কবিতাই প্রকৃত হাইকু ।
৫। হাইকুতে ছন্দটা অতি জরুরী। অন্ত্যমিল অনিবার্য নয়। থাকতে পারে আবার না থাকলেও ক্ষতি নেই।
৬। মাতসুও বাশো তাঁর রচনায় একাদিকবার বলেছন, হাইকুর প্রধান বৈশিষ্ট হল নতুনত্ব বা অপ্রত্যাশিত কে পাওয়া।
৭। হাইকুতে কৌতুকের উপাদানও থাকতে পারে।
৮। ঐতিহ্যগতভাবে হাইকু “বর্তমান কাল (present tense)” এ লিখা হয়।যার কেন্দ্রে থাকে ঋতুভিত্তিক চিত্রগুলোর মধ্যে সম্মলেন ঘটানো।
৯। একটা উত্তির্ণ হাইকুতে দুটি লজিক্যাল ভাগ থাকে। সাধারণত প্রথম ও দ্বিতীয় লাইনের একটি ভাগ। তৃতীয় লাইনে অন্য একটি ভাগ। কিংবা প্রথম লাইনে একটি ভাগ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইনে অন্য একটি ভাগ। প্রথম ভগ্নাংশ এক বা একাদিক বর্ণিল ছবির মাধ্যমে একটা অবস্থার চিত্র উপস্হাপন করবে । আর দ্বিতীয় ভগ্নাংশে উক্ত চিত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করে মূর্ত বা বিমূর্ত ভাবনার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটাবে।
হাইকু লিখতে হয় কঠোর নিয়ম মেনে। এর সংক্ষিপ্ত আকার এবং এরই মাঝে ভগ্নাংশ রেখে প্রাকৃতিক চিত্র উপস্থাপন করে ভাবের বাতায়ন মেলেধরা সত্যিই কঠিন। এ কঠিনেরে ভালোবেসেই দেশে দেশে শত শত বছর ধরে হাইকু রচিত হয়ে আসছে। আসুন আমরাও হাইকু রচনায় নেমে পড়ি। এখানে আমার কয়েকটি হাইকু তোলে দিলাম আপনাদের বিবেচনার জন্য ।
রহমান মুজিবের হাইকু
শীতার্ত ক্ষণ
হলুদ পাতা ঝরে টুপ–
হুহু আর্তনাদ!
*
কাঁকন ঝিনাক ঝন
পাতার সানাই তোলে সুর
মাধবি লগন।
*
গুরু গুরু মেঘ
কাঁদে সাথিহীন পাখি
হৃদয়ে আবেগ!
*
নীলাকাশে চাঁদ
কাশফুলে রূপোর পারা
জোড়া বালিহাঁস।
*
নায়ের বাদাম নাই
ধরে আছে হাল তবু
পদ্মার পাটুনি!
*
ঘুরে ঘুর্ণিপাক
সাগর পাগলাটে বৃষভ
কাঁপছে কেয়াফুল।
*
গাও যে রাখালি!
রাতে ফুটে সকালেই
ঝরে শেফালি!
*
বাঁজ ডাকে কড় কড়
তরি টানো সাবধানে
হতে পারে ঝড়।
*
মনে জমা আশ
শিশিরের বারিকণা
ধরে রাখে ঘাস।
*
কৃষ্ণচূড়ার ডাল
বসন্তবাউরি ডাকে
উতলা বাতাস!
*
ফুলে মধুকর
অবারিত রস পেয়ে
বড় বেখবর!
*
ঝড়-বৃষ্টির দিনে
একটা বর্ষাতি হাঁটে
ভেজাবিড়াল মিঁউ।
*
মিষ্টিবিকেলে
বৃষ্টি ঝরায়ে তুমুল
বলপেনটা নাচে ।
*
ভাদ্রের পাকা তাল
টসটসে রসাসক্ত
সমুদ্র ঘামে।
*
কেটে চলে ঘুণ
নিরবেই ঝরে ঝরে
দুপায়ারা খুন!
*
বস্তাতে ভূষি
কলেপড়া ইঁদুরের
কই তাতে খুশি!
স্বরবৃত্ত, স্বরমাত্রিক, স্বরাক্ষরিক ছন্দে উপরের হাইকু রচিত। স্বরবৃত্তে সবগুলোতেই ৫/৭/৫ মাত্রা পাওয়া যাবে। আপনার ভালো লাগাই আমার আনন্দ।
তথ্যসূত্র: অর্ন্তজাল ।