“ডাইল দিয়া ভাত খাই, আইল দিয়া হাঁটি” বাংলাদেশের পল্লীঅঞ্চলে প্রচলিত একটি লোককথা।ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে সারা বাংলায়ই কম বেশি প্রচলিত। একটা অঞ্চলের লোক কথায় সে অঞ্চলের মানুষ, তাদের জীবনাচার, অর্থনীতি, সামাজিক বৈশিষ্ট ইত্যাদি অকৃতিম রূপে রূপায়িত হয়ে থাকে। এগুলো এক বিশেষ সম্পদ। এ লোককথাটা মনে পড়ল বাংলা কবিতা ডট কমের শক্তিমান কবি জনাব গলোম রহমান এর ‘জড়াতে চাই না’ কবিতা নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে। প্রশ্ন আসতে পারে, “কোথায় আব্বাছ আর কোথায় গাব গাছ।” কীসের সাথে কি! কোথায় রূপকাশ্রয়ী আধুনিক এক উত্তীর্ণ কবিতা আর কোথায় লোক কথা? ধান ভানতে শীবের গীত! আসুন না গীত গাইতে গাইতেই আমরা জড়িয়ে পড়ি “জড়াতে চাই না” কবিতার সাথে।
একজন মৌলিক কবি তার জনপদের প্রতিনিধি। তাঁর মনন ওই জনপদের পরিবেশ প্রতিবেশের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে।ওখান থেকেই তিনি তার কবিতার আয়ুধ গ্রহণ করে থাকেন। প্রথমোক্ত লোককথাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কথক ডাল দিয়ে (যৎসামান্য) খেয়ে আলপথে (সরুপথ তথা সোজা পথ) চলতে চান। এটি গোটা বাংলাদেশের সহজ সরল আমজনতার মৌলিক চরিত্র। আলোচ্য কবির কাব্যমানসও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। আসুন পড়ি নিম্নের কবিতাটি,
“এক সময় মাছিরা বসে থাকতো আমের ছিলকায়
এখন আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না;
বাহারী আমের রসালো শরীরে
কীভাবে দাঁত বসাই!
তেতুলে মোটেও মোহ নাই
তবু দেখলে জিভে জল আসে!
নিজেকে জড়াতে চাই না কাঁটাবনে
ঘুঘুছানা ছোঁয়ার নেশায়…
মিহি কুয়াশার আড়ালে রমণীর মুখ
দেখে ব্যথিত হৃদয়…”
এ কবিতার সাদামাটা অর্থ, আমে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো ফলে এতে মাছিও বসতে পারে না।তাই ভয়ে কবিতার কথক আম খান না। তেঁতুল দেখলে জিবে জল এলেও এর প্রতি তাঁর টান নাই। কাঁটার ভয়ে তিনি ঘুঘুছানা ছুঁতেও যান না। নারীদের মলিন মুখ তাঁকে কষ্ট দেয়। আহারে গোবেচারা নন্দলাল!
কিন্তু এর বাইরেওকি এ কবিতার কোনো বক্তব্য আছে? নিশ্চয়। তা না হলে অপনি এ কবিতা অতটা
আগ্রহ নিয়ে পড়তেন না। আমাকেও রাত জেগে আলোচনায় উদ্বুদ্ধ হতে হতো না।লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এ কবিতায় তিনটি বিবৃতিতে মূল কথনের জাল বিস্তার এবং চতুর্থ বিবৃতির মাধ্যমে উপসংহার টানা হয়েছে। প্রথম বিবৃতিতে আমে মাছিও বসে না, এ কথার রূপকে এক শ্রেণির মানুষের আবিলতা স্বার্থপরতার কথা বলা হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, আম-পাবলিকের আমের চামে বিষ মিশ্রিতি হয়ে গেছে। ফলে সে জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার মতো ক্ষতিকর কাজ করতেও পিছপা হয় না। কিন্তু কথক এর থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চান।
দ্বিতীয় বিবৃতিতে তেঁতুল দেখে জিবে জল আসা, এ রূপকের দ্বারা সমাজের নানা দিকে লোভনীয় নানা বস্তুর বিদ্যমানতা এবং তা দূর থেকে দেখে প্রলুব্ধ হয়েও চূড়ান্ত প্রস্তাবে তাঁর এসবে জড়াতে না চাওয়া প্রকাশিত।
তৃতীয় বিবৃতি ঝোপের ঘুঘুছানা না ছোঁয়া – এখানে সস্তায় পাওয়া মনোহর বস্তুর বিদ্যমানতা এবং বদনামের ভয়ে তার আস্বাদ গ্রহণে অনিহার কথা উঠে এসেছে।
চতৃর্থ বিবৃতিতে মিহি কুয়াশার আড়ালে রমণীর মুখ দেখে কষ্ট পাওয়া– এটি তৃতীয়টির বিবর্ধন। তিনি না চাইলে কি হবে, সমাজের কিছু মানুষের মাঝে যে পঙ্কিলতা ছেয়ে গেছে, এর ফলে নারীরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। এ দেখে বিবেকবান কথক বেদনাক্লিষ্ট হয়ে পড়ছেন।
কবির শব্দরুচি, পরিমিতিবোধ, কাব্যিকতা,চিত্রকল্প নির্মাণ অনন্য। সহজ সরল কথায় তিনি বলেছেন এক আর বুঝাতে চেয়েছেন গভীর কিছু। এটি কবিতাটির কবিতা হয়ে উঠার নিয়ামক। শুদ্ধতাপন্থি কবিকে তাঁর নান্দনিক কবিতার জন্য অভিনন্দন।
কবির প্রতি: ততেুল> তেঁতুল, বাহারী> বাহারি হবে কি?