দায়িত্ব শব্দটার মাঝে দায় শব্দটা একাকার। সমাজ-সংসারে নানা দায় আছে। দায় মেটাতে পালন করেতে হয় দায়িত্ব। তাহলে শক্তিমান কবি খলিলুর রহমান তাঁর ‘দায়িত্ব’ শিরোনামের কবিতায় কোন দায়িত্বের কথা বলেছেন? তা বুঝেতে গিয়ে  কজন অগ্রজ মনীষা কবির অমর কাব্যকলি মনে সুভাস ছড়াচ্ছে…

“বিপদে মোরে রক্ষা করো/ এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে/ নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়”। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি/ বিচার দিনের স্বামী।
যত গুণগান হে চির মহান/ তোমারি অন্তর্যামী।….
সরল সঠিক পূণ্য পন্থা/ মোদের দাও গো বলি,
চালাও সে-পথে যে-পথে তোমার/ প্রিয়জন গেছে চলি। (গোলাম মোস্তফা)

উদ্ধৃত কবিতা দুটোর একটিও শৈশবে পড়েননি এমন বাঙালি শিক্ষিতজন বিরল। আমাদের শিশুমানস গঠনে এ প্রার্থনামূলক কাব্যদুটি ব্যাপক নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। এখনো করছে। কবি খলিলুর রহমানরে ‘দায়িত্ব’ সেই চিরন্তন ধারার এক বিশেষ নির্মাণ কি না আসুন দেখি। কবি যখন বলেন,

“আমার হাতে,/
দিয়েছ যে/ আলোর প্রদীপ/খানি
জানি, প্রভু/ জানি
পেয়েছি তা /তোমার অনু/গ্রহে….”।

এই যে মানব জীবন আমরা পেলাম তা অনন্ত সম্ভাবনার এক আলো। দেহ খাঁচায় আত্মা ফুঁকে দেওয়ার মাধ্যমেই আলোর প্রজ্জ্বলন সূচনা । মাতৃগর্ভে যে বিস্ময়কর পর্যায়গুলো অতিক্রম করতে হয়, তা মহানপ্রভুর অপার দয়ার অনন্য নিদর্শন। পৃথিবীতে আগমণের পর মাতৃদুগ্ধ, স্নেহ-ভালোবাসা, ভাষা, শিক্ষা, আলো-বাতাস,জ্ঞান-গরিমা, নানা নাজ-নিয়ামত কত কি! এতসব দয়ার বিবরণ দিতে গেলে মহাকাব্য রচিত হবে। জীবন নামের আমূল্য এ প্রদীপ প্রাপ্তির ফলেইতো পৃথিবীর রূপ-রস, সৌন্দর্য সুধা পান করা গেল। “ সুতরাং তুমি তাঁর কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে” (আল কুরআন)।

পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্মই পারলৌকিক কল্যাণের জন্য ইহলৌকিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কথা বলে। যদি ধরাধামে আসাই না হয়, তাহলে কী করে পারলৌকিক অনন্ত সুখের জন্য কাজ করা যাবে? তাইতো “দুনিয়া আহেরাতের শষ্যক্ষেত্র”। একই অনুভব শুনি ফকির লালনের কথায়, “এমন মানব জীবন আর কি হবে/ দয়া করো গুরু এবার/ এই ভবে।… কত ভাগ্যের ফলে না জানি/ পেয়েছো এই মানবতরণী…”। ‘দায়িত্ব’ কাবতায় কবি এ চিরন্তন বোধের প্রতিধ্বনিই শুনিয়েছেন। তিনি জানেন যে প্রদীপ তথা মানবতরণী তিনি পেয়েছেন এর শক্তি অঢেল । এ শক্তি যেন ধরে রাখতে পারেন এবং এর দাহ্যক্ষমতা যেন তাঁকে পুড়িয়ে না দেয়, এ সক্ষমতাও  প্রভুর সমীপে চরম সর্মপণের মাধ্যমে তিনি কামনা করেন।
এই যে আলোর প্রদীপ পেলেন, তা দিয়ে কবি কি করতে চান? তিনি চান, আগুনের উত্তাপটুকু আড়াল করে, সবার চলার পদরেখা ধরে ঝঞ্ঝার মাঝেও আলোর ভাতি নিয়ে পথ চলতে । কবির কথায়,

“সবার চলার /পদরেখায়
সেই আলো যে/ পথটি দেখায়
সেই পথে হোক/ আমার চলাও
সবার সাথে রহে”।

অতপর তিনি চূড়ান্তভাবে আত্মনিবেদন করেন প্রভুর পদে। যদি ক্লান্তি নেমে আসে, তখন যেন নয়ন জলে ধুয়ে তাঁকে পরিশুদ্ধ করা হয়। তিনি বর চান, পথের মাঝে  পথ না হারিয়ে যাতে আপন কাজে অবিচল অটুট থাকতে পারেন। সবার আলো নেভার দায়ে যেন তিনি প্রভুর দ্রোহে না পড়েন সে আর্তিও তিনি প্রভুর নিকটই পেশ করেন। তাঁর ভাষায়,

“ক্লান্তি যদি/ নিদ্রা আনে
নয়ন আসে/ মুদে
হৃদয় ধুয়ে /নয়ন জলে
নিও আমায়/ শুধে”।

এতক্ষণ আমরা কবির উচ্চারণ অনুযায়ী কাবতার মূলসুর ধরার চেষ্টা করলাম। এবার কবিতাটির গঠনগতদিকে  দৃষ্টিপাত করা যাক। কবিতাটি স্বরবৃত্ত/ দলবৃত্ত ছন্দে মুক্তক ঢঙে রচিত। মূল পর্ব চার মাত্রার, উপপর্ব দুই মাত্রার। নিও, দিও কে স্বরবৃত্তে দুই মাত্রার মূল্য দেয়া হয় না। নিও আমায় শুধে> নাও হে আমায় শুধে করা যায়। এ ছাড়া ছন্দ ঠিকঠাক।

কাবতাটিতে মানব জীবনকে একটা মহৎ সুযোগ হিসেবে দেখে আত্মার উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেকে জাগ্রত করে সুমহান জীবন দাতার উদ্দেশ্য সফল করার দায়িত্ব পালনের যে বোধ তা চিত্তাকর্ষক। আর এ বোধের জন্যই মহাজন কবিদের ভাবের সহগামী হয়েও  এ কবিতা ভিন্ন এবং অনন্য।

কাবর প্রতি:- কাবতাটিতে “সবার” তিন বার চয়ন করা হয়েছে। “সবার চলার পদরেখায়, সবার সাথে রহে, এবং  সবার আলো নেভার দায়ে”। সবার শব্দটি কবিতাটির পায়ের কাঁটা হলো কি না ভেবে দেখার অবকাশ আছে। কবির বক্তব্য যদিও বোধগম্য তথাপি প্রশ্ন  থেকে যায়, সমাজের সবাই কি ন্যায়ের পথের পথিক হয়? তাহলে তিনি সবার সাথে চলবেন বা রইবেন কী করে? আবার  সমাজের সবার আলো যদি নেভে তো কবিও সবার মধ্যেই পড়বেন তাহলে তিনি দায়বদ্ধ হতে চাইবেন না কেন?  সুরায়ে ফাতেহা স্মরণ করে সম্ভব হলে “সবার” শব্দটির পরিবর্তন করার প্রস্তাব রাখি।

চিরায়ত বোধের এ কবিতার জন্য কবিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।