বিজ্ঞান দর্শন কাব্য এ তিনের সমন্বয় ‘ভ্রমের কক্ষপথ’
‘তোমার জীবনের কক্ষপথটাই একটা ভ্রমের কক্ষপথ
আসলে তুমি ভ্রমে থাকতে খুব ভালবাস….’।
কবিতার চরণদুটি পড়ামাত্র আপনার শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে উঠবে। আপনি বিস্ময়ে নিজের অজান্তেই প্রশ্ন উঠাবেন, “বলেন কি কবি? মানব জীবনের এত গুণকীর্তন অথচ আপনি উলটো বললেন!” না বন্ধু, কবি ভুল বলেননি। তিনি জীবনের চলন প্রবণতা তথা কক্ষপথের কথা বলেছেন । যদি বলি ভ্রমের ফলেই এ্যাডাম-ইভ বা আদম- হাওয়ার স্বর্গ চ্যুতি, অতপর বিস্তার । তাহলে কি ভুল বলা হবে? হয়তো না। তাই ‘ভ্রমের কক্ষপথে’ কবিতার কবি ড. প্রীতিশ চৌধুরী মানব জীবনকে যথার্থই পাঠ করেছেন বোধ করি।
এ কবি বিজ্ঞানমনস্ক। তাই বিজ্ঞান থেকে তথ্য এনেই ভ্রমের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘুর্ণন গতি সেকেন্ডে তিন হাজার কিলোমিটার। যেহেতু আমরা টের পায় না বা ছিটকে পড়ি না সেহেতু আমাদের মগজ ওটা ভাবতে চায় না। কবি আমাদের ভ্রমের বিষয়টা আরো খোলাসা করেন এভাবে,
‘সেকেন্ড তিনহাজার কিলোমিটার স্পীডে ধাবমান তুমি পৃথিবীর সাথে
অথচ তোমার মগজ সেটা কখনো চায় না ভাবতে…
তোমাদের ধারণায় অস্তাচলে সূর্য ডোবে কিংবা হয় উদয়…
না তো সূর্য কখনো ডোবে, না উদয় হয়…’।
সূর্যের উদয়-অস্ত নাই। পৃথিবী এবং সূর্য নিজ নিজ কক্ষপথে বিচরণ করে। এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। পৃথিবী অনড় নয়, সূর্যের চারপাশে ঘুরে। এ কথা বলতে গিয়ে মহান বিজ্ঞানী কোপারনিকাসকে বিরোধের সম্মুখিন হতে হয়। আর তাঁর সমর্থক আরেক মহান বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে পড়তে হয় তৎকালীন ধর্মবেত্তাদের রোষানলে । এ ইতিহাস আমাদের জানা।
মানুষের এই যে ভ্রম, এর ফলে কি রকম ব্যত্যয় ঘটে কবির রাডারে তাও ধরা পড়েছে। পৃথিবী নিরপেক্ষ। তাই পৃথিবীর দৃষ্টিতে সবাই সমান। কিন্তু আমরা আদম সন্তানেরা পক্ষপাতদুষ্ট। আমরা ভালবেসে কেবল বসন্ত চাই। অর্থাৎ সজনপ্রীতিতে পক্ষ নিই আবার স্বার্থে অন্ধ হয়েও পক্ষ নিই। সুতরাং ‘মস্তিষ্ক উন্নত তোমার, অথচ মন উড়ে/ ভ্রান্তি বিলাসে…’। এভাবে কবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ভুলের বেড়াজালে আমরা কতটা বাস্তব বিবর্জিত। শিল্পবোদ্ধা কবি কোনো নসিহতনামা হাজির করেননি। সিদ্ধান্তটা আমাদেরকেই নিতে হবে– কোন পথে যাব। পাঠক আপনি হয়তো বলবেন, “এ কবিতায় কবি জড়পৃথিবী এবং মননশীল মানুষকে এক করে ফেলেতে চেয়েছেন। চিরদিন কারো সমান যায় না । এ কথা মানুষ জানে । তাই বলে কি মানুষ বসন্ত তথা সুখ চাইবে না? প্রেমাষ্পদের ঠোঁটে মদিরা থাকে, থাকতে পারে জীবাণুও তাই বলে কি মানুষ মদিরা থেকে বঞ্চিত থাকবে ?”
কবিতো নিষেধ করেননি । বরং প্রেমাষ্পদ আর বসন্তের রূপকে জীবনের অন্যসব ঋতুগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একপেশে দৃষ্টিকে প্রসারিত করে বাস্তববাদী হতে, আত্মসার্থে পক্ষপাত না করতে এবং নেতিবাচক সজনপ্রীতি থেকে দূরে থাকতে পরোক্ষে উৎসাহিত করেছেন। বোধ করি এটাই এ কবিতার মূলসুর বাকিসব আশ্রয়মাত্র।
কবিতায় বর্ণিত চিন্তার বিষয়টা জটিল কিন্তু কবি বলেছেন সহজভাবে। এখানেই কবির মুনশিয়ানা। শব্দচয়ন, বাক্যবন্ধ, পর্বে পর্বে হেঁটে ছন্দে প্রবাহমানতা বজায় রাখা, খুব বেশী অলঙ্কারিক শব্দ এনে কবিতার মাথায় চাপিয়ে না দেয়া– এসব গুণে কবিতাটি সমৃদ্ধ।
কবিতাটি পাঠকরে ঠকতে হয়নি । তাই কবিকে প্রাণঢালা অভিনন্দন।