চাঁদ-চাদেঁর আলো, বিশ্ব সাহিত্য তথা বাংলা সাহিত্যেরে কবিতা, ছড়া, পদ্যে একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে বসে আছে। বাংলা সাহিত্যে এমন কবি পাওয়া দুষ্কর, যিনি চাঁদকে বিষয় কিংবা অনুষঙ্গ হিসেবে কবিতায় ব্যাবহার করেননি। এ বিষয়ে গবেষণা করলে অনেক বড় গ্রন্হ হতে বাধ্য। আপনারা হয়তো বলবেন, হঠাৎ চাঁদ নিয়ে পড়লেন কেন? আসরের কবি রণজিৎ মাইতির চার লাইনের “অনুকাব্য 21” নিয়ে খানিকটা অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়েই পড়লাম এ মধুর ঝামেলায়। Twinkle twinkle little star সহ অনেক কাব্যাংশ মিছিল নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। কাকে রেখে কাকে ধরবেন । এই যে দেখুন…
“আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা…” (লোকজ।)
“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি” (সুকান্ত ভট্টাচার্য্য।)
“আমার ভাঙ্গা ঘরে ভাঙ্গা চালা ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে
অবাক জোছনা ঢুইকা পরে হাত বাড়াইয়া ডাকে” (হুমায়ূন আহম্মদ।)
প্রথম মানব-মানবী পৃথিবীতে এসে যে চাঁদ দেখেছিলেন, আজো আমরা তা-ই দেখছি। পৃথিবীর সর্বশেষ মানুষটিও হয়তো এ চাঁদকে দেখেই বিলয় হবে। একটামাত্র চাঁদ কোটি কোটি মানুষের অন্তরে অবাক জোছনা হয়ে ঢুকে পরে কত রকমে, কত ভাব নিয়ে যে ধরা দেয় আর দেবে তার শেষ কথাটি কে বলবে?
এবার আসুন আলোচনার শিরোনামকে নিচের কবিতাটি কতটা প্রতিষ্ঠিত করে, তা নিয়ে ভাবা যাক।
“সাধ্য সাধনা করে/ পাইনি যে স্বাদ
ভাতের থালায় দেখি/ আধখানা চাঁদ
ঘর আলোকিত হলো/ মনও প্রসন্ন
অন্য চিন্তা ভুলি/য়ে দিল আলোচালের /অন্ন” (রণজিৎ মাইতি)
ক) একটা জীবন–প্রাণান্ত সাধ্য সাধনা করে দুমুঠো আহার যোগার করতেই গলদঘর্ম হচ্ছে। তার ভাঙ্গা ঘরের ভাঙ্গা চালার ফুটোপথ গলে অবাক জোছনা ঢুকে পড়ছে। এই জোছনা ঢুকার সাথে সাথে ওই জীবনটার দুঃখ-যাতনা- কষ্টগাথাও আমাদের হৃদয়ের কোমল কাঠামোয় আঘাত করছে।
খ) “পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি” ভাবার মতো নাঙ্গা অভার আর ক্ষুধা কাতর যে জীবন সে জীবনে আনন্দের অনুষঙ্গ খুব কমই আসে। ভাত যোগার করতেই যে কাৎ হয়ে পড়ে, সে জীবনে চাঁদের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ কোথায়? এখানে পেটের জ্বালা ও মনের জ্বালা দুটোরই খবর মেলে। মনে পড়ে শরৎ বাবুর কথা । তিনি শ্রীকান্ত উপন্যাসে ‘ওই চাঁদটাও কিছু না, মেঘটাও কিছু না। আসল, মনটা যখন যা কিছু দেখায়।’ এ ধরণের একটা দার্শনিক উক্তি করেছিলেন বোধ করি।
গ) আবার যখন আলোচালের অন্নের থালায় চাদেঁর জোছনা এসে “ঘর আলোকিত হলো মনও প্রসন্ন” তখন আর অন্য চিন্তা থাকে না। ভাতের থালায় চাঁদের কিরণ– সোনায় সোহাগা হয়ে মনকে নাচিয়ে এক আনন্দ প্লাবনে ভাসিয়ে দেয়।এখানেই দর্শন উঠে আসে। ক্ষুধার্থ মানুষের প্রথম প্রয়োজন খাদ্য। খাদ্য না পেলে বাদ্য বাজবে না।
সুতরাং রণজিৎ মাইতির “অনুকাব্য 21” হর্ষ-বিষাদের বিমিশ্র চিত্রে একটা দর্শন নির্দেশ করে। সুন্দর এ কবিতার জন্য কাবকে শুভেচ্ছা।
কবির প্রতি:- কবিতাটিতে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ৮/৬ চাল রক্ষিত হয়েছে দেখা যায়। কেবল শেষ চরণের ছন্দ কষ্টকল্পিত। ৮/৮/৩ ভাগ করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে আছে ৬/৫/৫/৩ । এখানে ইচ্ছে করলে কাজ চলতে পারে।