আমেরিকান সিনকেইন বা সিঙ্কেইন (Cinquain) কাব্য-কাঠামো সরল শব্দের কৌশলী সেলাই
রহমান মুজিব
উৎসর্গ: বন্ধুকবি ড. প্রীতিশ চৌধুরী
পাখি সুন্দর। পাখির বাসাও সুন্দর। কিন্তু সেই বাসা যদি বাবুই পাখির হয়; আপনার শৈল্পিক মন তার সৌন্দর্যের জালে আটকা পড়বে আর ভাবনার জগতে তুলবে তোলপাড়। তেমনি ভাবে কবিতার রচনালগ্নে কবিমন সুন্দর, তাঁর ভাবনা সুন্দর, তাই কবিতা সুন্দর। আর সেই কবিতা যদি হয় সুনিপুণ রূপপ্রকল্প বা কাঠামোবদ্ধ (Form) তাহলে তার শৈলী দেখে আপনার বাবুই পাখির নীড়ের চিত্র চোখে ভাসবে। আপনার শিক্ষিত কাব্যরসিক মন দেখবে শব্দের কৌশলী সেলাই। কথাগুলো মনে হলো আমেরিকার বিখ্যাত কবি অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে (Adelaide Crapsey 1878-1914) প্রবর্তিত সিনকেইন বা সিঙ্কেইন (Cinquain) কাব্য ফর্ম নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে।
অন্তর্জাল ঘেটে সিনকেইন বা সিঙ্কেইন (Cinquain) এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, এটি পাঁচ লাইনের কবিতা। পাঁচ লাইনের কবিতাটি যেন পাঁচটি বাদ্যযন্ত্রের সমন্বিত সুর বা পাঁচজনের কোরাস। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় এর প্রচলন থাকলেও এটি মূলতঃ মধ্যযুগীয় ফরাসি কবিতা। ইংরেজি ভাষার ষোল ও সতের শতকের কবি জর্জ হারবার্ট, এডমন্ড ওয়েলার, জন ডান সহ অরো অনেকে ‘সিনকেইন’ চর্চা করতেন। তাদেঁর রচিত সিনকেইনগুলোতে কয়েকটি মিল বিন্যাস মানা হতো। এগুল হচ্ছে “ababb, abaab or abccb.” । জর্জ হারবার্ট একটি সিনকেইন নিম্নরূপ-
The World
George Herbert
Love built a stately house, where Fortune came,
And spinning fancies, she was heard to say
That her fine cobwebs did support the frame,
Whereas they were supported by the same;
But Wisdom quickly swept them all away.
তা যাই হোক। আমাদের আগ্রহের বিষয় অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে (Adelaide Crapsey 1878-1914) প্রবর্তিত সিনকেইন বা সিঙ্কেইন (Cinquain) । তিনি এ পঞ্চপদির গুণ, মান ও আকৃতিগত পরিবর্তন এনে একে জনপ্রিয় করে তুলেন, যা তাঁকে প্রবর্তকের মর্যাদা এনে দেয়। ক্র্যাপসে প্রবর্তিত সিনকেইন দুটি ধাপে উন্নতি লাভ করে। প্রথম ও মৌলিক স্তরটি ছিল শ্বাসাঘাত প্রধান , যার মধ্যে (stresses) ঝোঁক ( ধ্বনিপ্রধান শব্দাংশ) থাকত যথাক্রমে ১,২,৩,৪,১ টি করে। পরে তিনি একে উক্ত (stresses) ঝোঁক এর সাথে সিলেবল যুক্ত করেন, যা যথাক্রমে ২,৪,৬,৮,২ সিলেবল (দল/অক্ষর) হবে। ফলে এটি ছন্দ নির্ভর হয়। এ ক্ষত্রে তিনি ( Iambic feet) প্রয়োগ করেছিলেন। দু সিলেবলের শব্দে (stresses) পড়ে দ্বিতীয় সিলেবলে।
সিনকেইন বা সিঙ্কেইন (Cinquain) এর সংজ্ঞা ও চরিত্র খুঁজতে গিয়ে দেখতে পাই- “A cinquain – which, by the way, is pronounced “sin-cane,” not “sin-kwane” – is a form of poetry that is very popular because of its simplicity. It was created by American poet Adelaide Crapsey.”… “the best cinquains tell a small story. Instead of just having descriptive words, they may also have an action (something happening), a feeling caused by the action, and a conclusion.” “A cinquain is an example of shape poetry.” নিম্নে অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে রচিত দুটি ‘সিনকেইন’ উদ্ধৃত করা হলো। প্রথমটি (stresses)স্ট্রেসপ্রধান। দ্বিতীয়টি পরিবর্তিত ধাপের। লক্ষ করুন দ্বিতীয়টির আকার ও গঠন।
November Night
Adelaide Crapsey
Listen...
With faint dry sound,
Like steps of passing ghosts,
The leaves, frost-crisp'd, break from the trees
And fall.
Snow
Adelaide Crapsey
Look up…
From bleakening hills
Blows down the light, first breath
Of wintry wind…look up, and scent
The snow!
জনাবা অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে প্র্রবর্তিত ‘সিনকেইন’ এর গঠন খুবই সরল। এ সারল্য গুণেই কাব্য ফর্মটি খুব জনপ্রিয় হয়। ক্র্যাপসে’র তিরোধানের এক বছর পর ১৯১৫ সালে ২৮টি সিনকেইন এর সমন্বয়ে “Verse” নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। মাত্র তিনটি নিয়ম মেনেই সিনকেইন বা সিঙ্কেইন (Cinquain) রচনা করা যায়। যেমন –
১) একটি সিনকেইন এ পাঁচটি লাইন থাকবে। এর একটা শিরোনাম থাকবে। এটিকে একটি পঞ্চপদি স্তবকবন্ধ কবিতাও বলা যায়।
২) এতে মোট সিলেবল থাকবে ২২ টি।
১ম লাইন =২ সিলেবল, ১ ঝোঁক । এখানে কবিতার বিষয় থাকবে।
২য় লাইন =৪ সিলেবল, ২ ঝোঁক । এখানে বিষয়ের বর্ণনা থাকবে।
৩য় লাইন =৬সিলেবল, ৩ ঝোঁক । এখানে ক্রিয়া নির্ভর বাক্য থাকবে।
৪র্থ লাইন =৮ সিলেবল, ৪ ঝোঁক। এতে থাকবে অনুভূতির ব্যাপারটা।
৫ম লাইন =২ সিলেবল, ১ ঝোঁক। এখানে উপসংহার থাকবে।
মনে রাখার সুবিধার জন্য এর সিলেবল সংখ্যাক্রম ২৪৬৮২ এই পাঁচটি সংখ্যা মুখস্ত রাখা যেতে পারে। আমরা বাংলায় ভাষায় যখন সিনকেইন রচনা করব তখন ঝোঁক বা শ্বাসাঘাত এর ব্যাপারটা এড়িয়ে যাব। কেননা স্বরবৃত্ত/দলবৃত্ত ছাড়া এটি প্রয়োগ ঝামেলাপূর্ণ হবে। আমরা সবকটি বনেদি বাংলা ছন্দে সিনকেই চর্চা করতে চাই।
৩) এর নির্দিষ্ট কোন মিল বিন্যাস নাই। অর্থাৎ অন্ত্যমিল ঐচ্ছিক।
উল্লেখিত নিয়মগুলো মেনে আপনার পছন্দ-অপছন্দ, পারিপ্বার্শিক দেখা ও ঘটনা ইত্যাকার যে কোন বিষয়ে আপনি সিনকেইন বা সিঙ্কেইন (Cinquain) লিখতে পারেন। একটা স্বার্থক সিনকেইন এ জাপানি হাইকু ,তানকার মতো একটা ছবি থাকবে। অর্থাৎ এতে একটা চিত্রময় গল্প থাকবে। এটি বর্ণনাত্বক হয়ে থাকে। শেষ লাইনে একটা উপসংহারও টানতে হয়।ইচ্ছে করলে এখানে মজা (Fun) করা যেতে পারে। একে সাজালে একটা চমৎকার আকার পাওয়া যায়।
জনাবা অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে’র ‘সিনকেইন’ এর (variations) রূপভেদ বা ভিন্নতা লক্ষ করা যায় যেমন
ক) রিভার্স সিনকেইন বা উল্টোক্রম সিনকেইন: পাঁচ লাইনের ছন্দবদ্ধ স্তবক ২,৮,৬,৪,২ সিলেবল বিশিষ্ট।
খ) মিরর সিনকেইন বা আরশি সিনকেইন: দুইটি সিনকেইন নিয়ে একটি মিরর সিনকেইন রচিত হয়।প্রথমটি সাধারণ সনকেইন এবং পরেরটি রিভার্স সিনকেইন এই দুয়ের সমন্বয়ে মিরর সিনকেইন রচিত হয়ে থাকে।
গ) বাটারফ্লাই সিনকেইন বা প্রজাপতি সিনকেইন: নয় লাইনে ছন্দবদ্ধ স্তবক ২,৪,৬,৮,২,৮,৬,৪,২ সিলেবল বিশিষ্ট।
ঘ) ক্রাউন সিনকেইন বা মুকুট সিনকেইন: এটি পাঁচটি সিনকেইনের একটি পরম্পরা। অথাৎ ৫টি সিনকেইন মিলে একটি বড় কবিতা।
ঙ) গার্ল্যান্ড সিনকেইন বা মালাকার সিনকেইন: এটি ছয়টি সিনকেইনের ৩০ লাইন বিশিষ্ট একটি মালা। এটি ক্রাউন সিনকেইনের মতোই শুরু হয়। ৬ নম্বর সিনকেইনটি হয় একটা বিশেষ নিয়মে। তা হচ্ছে ১নং সিনকেইনের ১ম লাইন হবে ৬নং এর ১ম লাইন। ২নং এর ২য় লাইন হবে ৬ নং এর ২য় লাইন। ৩নং এর ৩য় লাইন হবে ৬ নং এর ৩য় লাইন।৪নং এর ৪র্থ লাইন হবে ৬ নং এর ৪র্থ লাইন। ৫ নং এর ৫ম লাইন হবে ৬ নং এর ৫ম লাইন।
এছাড়া আরও দুধরণের সিনকেইন প্রচলিত আছে। এগুলো শিশুদের ক্ষেত্রে জনপ্রিয়। এগুলো শব্দ গননা করে হয়। এখানে সিলেবল এবং স্ট্রেস হিসেবে আসে না। এদের একটি হলো
১) (Didactic cinquain) ডিডাকটিক সিনকেইন। এটিও পঞ্চপদি এবং ক্র্যাপসের সিনকেইনের মতোই। লাইনে শব্দক্রম ১,২,৩,৪,১ শব্দ। এখানে প্রথম লাইনটি এক শব্দের কাব্য শিরোনাম এবং বিষয়। ২য় লাইনে দুটি বিশেষণ শব্দ এটি বিষয়ের ব্যাখ্যা। ৩য় লাইনেথাকবে তিনটি শব্দ যা বিষয়ের অধিকতর তথ্য প্রকাশ করবে। ৪র্থ লাইনে থকিবে চারটি শব্দ যা বিষয় সম্পর্কে অনুভুতিটুকু প্রকাশ করবে। ৫ম লাইন হবে এক শব্দের। এটি প্রথম লাইনকে বস্তিার করবে।এর একটি নমুনা নিচে দেয়া হলো-
Insect
Hidden, hungry
Preening, searching, stalking
Waits as if praying
Mantis.
২)দ্বিতীয় যে ধারা পাওয়া যায় এটি প্রায় প্রথমটির মতই। কেবল ৪র্থ লাইন একটি পরিপূর্ণ বাক্য হবে। এখানে চার শব্দের অধিক শব্দও থাকতে পারবে। একটি নমুনা-
Penguins
White, black
Waddling, swimming, eating
They are playing in the water
Emperors.
এবার অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে’র রীতে মেনে এ প্রবন্ধকারের রচিত বিভিন্ন প্রকারের
আটটি সিনকেইন আপনাদের বিবেচনার জন্য সংযুক্ত করা হলো-
মালি
মালি
চারা থেকে
সাজায় ফুলের ডালি।
অবজ্ঞাতে ক্যান তাঁরে দাও
গালি?
(স্বরবৃত্ত)
বাতি
বাতি
আগরের
জ্বেলে পাবে ঘ্রাণ।
ওতে চন্দ্রালো চেয়ো না
সাথি।
(অক্ষরবৃত্ত)
জাল
জাল
যে বিছাবে
বিষাক্ততার
তারে ধরে দাও তুলে
ছাল।
( মাত্রাবৃত্ত)
(রিভার্স সিনকেইন বা উল্টো ক্রম সিনকেইন)
পঙ্খি
পঙ্খি
ঝড়ে জায়গা কোথায় পাবে
যদি বন্ধ করো
খিড়কি দুয়ার
ঘরের।
(মিরর সিনকেইন বা আরশি সিনকেইন)
নাগর
নাগর
আগড় বাগড়
চলবি-বলবি কতো !
সব ছেড়ে তোর জলদি হবে
ফিরতে;
ময়না
উড়াল দিলে কুড়াল মেরে
আর কি কভু ফেরে?
দেখবি চোখে
সাগর।
(বাটারফ্লাই সিনকেইন বা প্রজাপতি সিনকেইন )
শূন্য
খসলে
ফুলের পাপড়ি
ফুলদানি সে পায় কি?
কী রায় দেবেন আচার-বিচার
বসলে
মাজরা পোকায় ধান কেটেছে
হিসেব কষে লাভ কি?
উদাম গুদাম
শূন্য।
(ক্রাউন সিনকেইন বা মুকুট সিনকেইন)
কারবালা দেয় দীক্ষা
ঠুকছে
কপাল ফুরাত
ফুঁসছে রুষ্ট তরঙ্গ
জলের জন্য নবীর বংশ
ধ্বংস!
হোসেন
পুত্র আসগর
শিশু, তৃষ্ণা কাতর!
দুনিয়া ব্যাকুল দুনিয়ার ফুল
টলছে!
জনক
আগলে কনক
রিক্ত- আঁজল পাতলো
এজিদের দল জ্বাললো অনল
বক্ষে ।
অটল
ইমানের বল;
লড়লো অসার রুখতে
রণ আমরণ নিঃশেষে প্রাণ
দানলো।
অন্যায়
হলে সংগ্রাম –
কারবালা দেয় দীক্ষা,
ত্যাগ-মহিমায় ইসলামে রই
জিন্দা।
(গার্ল্যান্ড সিনকেইন বা মালাকার সিনকেইন )
বাংলা
বাংলা
প্রাণের ভাষা
কৃষ্টি কলা গানের
ভাষা-শহিদানের; আশা
মায়ের।
আমার
দেশের মাটি
ফুল ফসল আর বীরের
খাঁটিঁ শ্যাম বরনের হীরের
ঘাটি।
পাকা
ধানের ক্ষেতে
কণায় কণায় সোনা
কৃষাণ বধুর মধুর সপ্ন
বোনা।
মাঠের
পাশে নদী
নদীর পাড়ে হাঁটি
রূপরে বাংলা আমার জীয়ন
কাঠি।
গাছের
শাখায় শাখায়
হাজার পাখির নাচন
থামলে এ নাচ ঘটবে সুরের
মরণ।
বাংলা
দেশের মাটি
কণায় কণায় সোনা
রূপের বাংলা আমার জীয়ন
মরণ।
যেভাবে শেষ টানতে চাই: জনাবা অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে’র ‘সিনকেইন’ হবে আমাদের চর্চার বিষয়। বাংলাছন্দের রীতি মেনেই তা হবে।শ্বাসাঘাতের ব্যাপারটা ঐচ্ছিক রাখব। সব বনেদি বাংলাছন্দেই আমরা লিখব। অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে’র ‘সিনকেইন’ এর গঠনগত চিন্তাটুকু যদি ধরতে যাই, তো আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রথম লাইনকে একক ধরেছেন। ১ম লাইন এর দ্বিগুন ২য় লাইন, তিনগুন ৩য় লাইন এবং চারগুন ৪র্থ লাইন। ৫ম লাইন আবার প্রথম লাইনের সম ওজনের। এ যেন জীবন। কোথাও থেকে আসা, ক্রমান্বয়ে বর্ধণ অতঃপর যেখান থেকে আসা আবার সেখানে ফিরে যাওয়। এটকু বলা ও জন্য যে, কেউ যদি প্রথম লাইনে দুই সিলেবল এর ম(আমরা বাংলায় মাত্রা মনে করব) বেশি ওজনের এক শব্দদিয়ে কবিতা শুরু করতে চান তিনি যেন অ্যাডিলেড ক্র্যাপসে’র ‘সিনকেইন’ এর মূল চিন্তাটুকু মাথায় রাখেন । এবার আসুন নেমে পড়ি, সুন্দরের সন্ধানে।
তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল।