এখানে বাংলাগান রচনাকৌশল নিয়ে প্রকাশিত পর্ব গুলো এক সাথে করে দিলাম।
প্রথম পর্ব
---------
আজ ছন্দ নিয়ে কিছু বলবো।
ছন্দের প্রথম পাঠই হলো মাত্রা গণনা শেখা। কী ভাবে মাত্রা গণনা হবে তা নির্ভর করে শব্দাংশ ( সিলেবল ) বোঝার উপর। এই শব্দাংশ আবার উচ্চারণের উপর নির্ভরশীল । দুটি শব্দ নিয়ে দেখা্ যাক - ''বিশৃঙ্খল'' এবং ''বিশৃঙ্খলা'' । শব্দ দুটির উচ্চারণ যথাক্রমে, ''বিস-স্রিঙ-খল'' ও বিস-স্রিঙ-খ-লা''।
দেখা যাচ্ছে বিশৃঙ্খল শব্দটাতে তিনটি শব্দাংশ আছে। ১) বিস ২)স্রিঙ ৩) খল। শব্দাংশ আবার দুই ধরণের। মুক্ত এবং বদ্ধ। আমরা এখানে প্রথম শব্দটাতে যে শব্দাংশগুলো পেয়েছি তা কেমন দেখা যাক। ''বিস'' বলবার পরে কি আর টেনে রাখা যায়? স্রিঙ'' বলবার পরে? ''খল'' বলবার পরে? যায় না। তাই এগুলো বদ্ধ শব্দাংশ।
এবার ''বিশৃঙ্খলা'' শব্দটা দেখা যাক। ''বিস-স্রিঙ-খ-লা'' শব্দটাতে, ''বিস'' এবং ''স্রিঙ'' তো আমরা আগেই দেখেছি, দুটোই বদ্ধ। কিন্তু ''খ''? আমরা ইচ্ছে করলেই খঅঅঅঅ এই ভাবে যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণ টেনে রাখতে পারি। তাই এটা
মুক্ত। ''লা''ও তাই লাআআআআআআ যতক্ষণ খুশি টেনে রাখতে পারি। তাই এটাও মুক্ত। অর্থাৎ যে শব্দাংশ উচ্চারণের পর থেমে যেতে বাধ্য হতে হয়, সেটাই বদ্ধ শব্দাংশ।
কেন থেমে যেতে বাধ্য হতে হয়?
স্বরবর্ণের কথা আলাদা। সব সময়ই মুক্ত। অঅঅঅ বা আআআআআ বা ইইইইই -- উউউউউউ, এএএএএএএ, ওওওওওও এই সবগুলোই যতক্ষন ইচ্ছা টেনে রাখা যায়।
এরা স্বাধীন। কিন্তু ব্যঞ্জনবর্ণ স্বাধীন নয়। স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া উচ্চারিত হতে পারে না। ''ক'' বলতে গেলে অ যোগ করতেই হয়। তখন আমরা কঅঅঅঅঅঅ এই ভাবে টেনে যেতে পারি। অ-এর সাহায্য ছাড়া আমরা কখনোই ''ক'' উচ্চারণ
করতে পারবো না।
যখন কোনো শব্দাংশ উচ্চারণের পর স্বরবর্ণের সাহায্য পাওয়া যায় না, তখন থেমে যেতেই হয়। যে শব্দাংশে এই ভাবে থেমে যেতে হয় সেটাই বদ্ধ শব্দাংশ। যেমন ''একটা'' এই শব্দটাতে দুটি শব্দাংশ আছে। ''এক'' এবং ''টা'' । ''এক'' বলার পর আমাদের থেমে যেতেই হয়। কিছুতেই ওকে টেনে রাখা যাবে না। কিন্তু ''টা'' বলার পর 'টাআআআআআআআআআআআআআ'' শ্বাস বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত টেনে রাখা যায়। কারণ এই শব্দাংশটি স্বরবর্ণের সাহায্য পেয়েছে।
দ্বিতীয় পর্ব
----------
শব্দাংশ কী ভাবে নির্ণয় করা হয়
-----------------------------
আমরা স্বরবর্ণ - ব্যঞ্জনবর্ণ যেটাই উচ্চারণ করতে যাই, তার সঙ্গে ফুসফুস থেকে নির্গত বাতাসের সাহায্য লাগে। ''আ'' আমরা স্বাধীন ভাবে টানতে পারি। কিন্তু কতক্ষণ? চেষ্টা করে দেখুন। এক সময় আপনাকে থামতেই হবে। কারণ দম ফুরিয়ে যাবে। দম নিয়ে আবার শুরু করা যাবে। এ থেকে বোঝা গেলো যে, ফুসফুস থেকে নির্গত বাতাসের সাহায্য ছাড়া আমরা কিছুই উচ্চারণ করতে পারিনা। যে কোনো শব্দ উচ্চারণের সময় প্রতিটি অংশে একেকটি চাপ পড়ে সেই নিঃশ্বাসের বাতাসে। যেমন 'আ''মি'। এখানে এক চাপে 'আ' উচ্চারিত হয়েছে, 'মি' উচ্চারিত হয়েছে আর এক চাপে। আবার, 'আম''রা(আমরা)। এখানে 'আম' উচ্চারিত হয়েছে এক চাপে, 'রা' উচ্চারিত হয়েছে আর এক চাপে। শব্দ উচ্চারণের সময় এই প্রতিটি চাপে শব্দের যেটুকু অংশ উচ্চারণ করা যায়, সেটুকুই একেকটি শব্দাংশ।
আর একটি শব্দ দেখা যাক, ''রাত্রি''। ঊচ্চারণ অনুযায়ী ভেঙে লিখলে হয়, 'রাত''ত্রি'। এর প্রথম শব্দাংশ 'রাত'। দ্বিতীয় শব্দাংশ 'ত্রি'। 'রাত' বদ্ধশব্দাংশ। কারণ 'রাত' উচ্চারণের পর আর একদমই টেনে রাখা যায় না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, 'রা' তো টেনে রাখা যায়। হ্যা যায়। কিন্তু ''রাআআআআআআআআআআআ---------'' টেনে যদি নিঃশ্বাস শেষ করে ফেলি তাহলে কি রাত বলার মতো করে ত উচ্চারণ করা যাবে? না, তা যাবে না। কারণ তখন 'ত' আর হসন্তঅন্ত থাকবে না। হয়ে যাবে রা-ত। অর্থাৎ র+আ এবং ত+অ । তাই রাত নিঃশ্বাসের একটা চাপেই বলতে হবে। এবার দেখা যাক 'ত্রি'। একটি হ্রস্বইকার এবং একটি রফলা যুক্ত হবার পরও, ত্রি মুক্ত শব্দয়াংশ। কারণ ত্রিইইইইই যতক্ষণ শ্বাস আছে,
টেনে রাখা যায়।
আরো একটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, তা হলো, বদ্ধশব্দাংশ সব সময় দ'টি বর্ণ দ্বারা গঠিত। তার প্রথম বর্ণে অকার-আকার-ইকার-উকার-একার-রিফলা, রফলা ইত্যাদি যুক্ত থাকতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় বর্ণে এসব কিছুই যুক্ত থাকবে না। আর, মুক্তশব্দাংশ সব সময় একটি বর্ণে গঠিত, তার সঙ্গে অকার-আকার-ইকার-উকার-একার-ওকার-রিফলা-রফলা-যফলা এইসবের এক বা একাধিকটা যুক্ত থাকতে পারে।
তৃতীয় পর্ব
---------
মাত্রা
-----
মাত্রা একটি বহুমাত্রিক শব্দ। বহু ধরনের অর্থ হয় এই শব্দটির।
এখানে আমরা মাত্রা বলতে বুঝবো, কবিতার শব্দের প্রতিটি অংশের উচ্চারণকালের পরিমাপ কে। এতেও ভুল বোঝার অবকাশ আছে। যে কেউ বলতে পারেন, ''পা-নি'' এই দুটো শব্দাংশকে তো আমরা যতোটা খুশী লম্বা করে বলতে পারি। যেমন, পাআআআআআআআআআআআ নিইইইইইইইইইইইই ----। তাহলে কতটুকুকে পরিমাপ বলে ভাববো? ততোটুকু, যতোটুকু স্বাভাবিক ভাবে উচ্চারণ করতে লাগে। বিশেষ কারণে, যেমন জিহ্বায় মরিচের আকস্মিক প্রবল আক্রমণ হলে কেউ
চেচিয়ে উঠতে পারে, পাআআনিইইইইই। সেটা স্বাভাবিক অবস্থা নয়। '' নদীর পানি বেশ ঘোলা।'' এটা বলতে ''পা-নি'' শব্দাংশ দুটি পাশাপাশি উচ্চারণে যে মাপ স্বাভাবিক ভাবে লাগে সেটাই পরিমাপ।
শব্দাংশ শেখার সময় আমরা জেনেছি যে, শব্দাংশ দুই ধরণের। মুক্ত ও বদ্ধ। এখন জানে নেবো, কোন শব্দাংশ কোথায় কত মাত্রা হিসেবে গণ্য হয়। মুক্ত শব্দাংশ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। প্রতিট মুক্ত শব্দাংশ যে কোনো ছন্দের শব্দে, যেখানেই থাকুক না কেন, তা ১মাত্রা বলেই গন্য হবে। যেমন :-- ''অনবরত''। এই শব্দে পাঁচটি শব্দাংশ আছে, অ-ন-ব-র-ত। পাঁচটিই মুক্ত। এর প্রতিটি ১মাত্রা। শব্দের শুরুতে, মাঝখানে বা শেষে যেখানেই হোক ১মাত্রা। তাই ছন্দ নির্ণয়ের জন্যে মুক্ত শব্দাংশ কোনো ভাবেই প্রভাব বিস্তার করে না।
যতো ঝমেলা বদ্ধ শব্দাংশ নিয়ে। বরং বলা যায়, বদ্ধ শব্দাংশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মাত্রা হবার কারণেই, ছন্দের ভেদ ঘটে। এটা বুঝে নেবার জন্যে আমরা একটি শব্দ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারি। '' মুক্তাঞ্চল'' এই শব্দটা উচ্চারণ অনুযায়ী ভেঙে লিখলে হয় :-- '' মুক-তান-চল''। এখানে তিনটি বদ্ধ শব্দাংশ আছে। এবার ছন্দ অনুযায়ী দেখা যাক,
স্বরবৃত্ত ছন্দ :-- মুক = ১মাত্রা, তান = ১মাত্রা, চল= ১মত্রা। ১+১+১ = তিন মাত্রা।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ :-- মুক = ২মাত্রা, তান = ২মাত্রা, চল = ২মাত্রা। ২+২+২ = ছয় মাত্রা।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ :-- মুক = ১মাত্রা, তান = ১মাত্রা, চল = ২মাত্রা।১+১+২ = চার মাত্রা।
এতে আরেকটা কথা জানা গেলো, তা হলো, স্বরবৃত্তে বদ্ধ শব্দাংশও সর্বত্রই ১মাত্রা। মাত্রাবৃত্তে, বদ্ধ শব্দাংশ সর্বত্রই ২মাত্রা হয়। কিন্তু অক্ষরবৃত্ত ছন্দে বদ্ধ শব্দাংশ, শব্দের শুরুতে থাকলে ১মাত্রা হবে। শব্দের মাঝখানে থাকলেও ১মাত্রা হবে। কেবল শব্দের শেষে থাকলে হবে ২মাত্রা। কারণ এই ছন্দে শব্দ উচ্চারণে শেষে এসে একটু এলিয়ে দেয়া হয়।
আমরা জেনেছি এবং এখানেও দেখলাম, বদ্ধ শব্দাংশ দুটি বর্ণ দ্বারা গঠিত। এই দুটি বর্ণ মিলে যে শব্দাংশ, তার উচ্চারণের পরিমাপের ভিন্নতার কারণে ছন্দের গতি বা চলন নির্ধারিত হয়। স্বরবৃত্ত ছন্দে সর্বত্র দুটি বর্ণকে ১মাত্রা পরিসরের মধ্যে উচ্চারণ করতে হয় বলেই, এই ছন্দের চলন একটু দ্রুত। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সর্বত্রই বদ্ধ শব্দাংশের দুটি বর্ণকে ২মাত্রা ব্যপী এলিয়ে দিতে
হয় বলেই, এই ছন্দের চলন একটু শ্লথ। আর অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের শুরুতে, মাঝে ১ মাত্রা করে হয় শেষে ২ মাত্রা হয় বলে এর চলন অসমান। আধুনিক কবিতায়, কবিরা নির্দিষ্ট দোলা থেকে মুক্ত হয়ে একটু গদ্য ভঙ্গী আনতে চান বলেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বেশী পছন্দ করেন। অকবিরা অবশ্য এটাও জানেন না। তাদের কথা থাক। আমরা বলতে পারি স্বরবৃত্তের চাল হরিণ-শাবকের নৃত্যের মতো। মাত্রাবৃত্তের চাল রাজহংসের মতো। অক্ষরবৃত্তের চাল পাথুরে নদীর মতো। উচ্ছ্বাস যেমন আছে, বাধাও তেমন আছে। উদাহরণ দিয়ে বুঝালেই এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
চতুর্থ পর্ব
---------
'' ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা
চৌপর দিনভর দেয় দূর পাল্লা। ''
এই পঙক্তি দুটি নিয়েই শুরু করি। এটা স্বরব্রিত্ত ছন্দে লেখা।
প্রশ্ন আসতে পারে, এটা যে স্বরবৃত্তই, অন্য কোনো ছন্দ নয়
তার প্রমাণ কি? অন্য ছন্দ কেন নয়?
এই পঙক্তি দুটি বেছে নেবার কারণও সেটাই। একে মাত্রাবৃত্ত
ছন্দেও বিভাজন করা যায়। তার পরও এটা যে মাত্রাবৃত্ত নয়,
স্বরবৃত্তই সেটা বোঝার জন্যে, পর্ব বিভাজন করা যাক :
ছিপখান তিন দাঁড় / তিনজন মাল্লা /
চৌপর দিনভর / দেয় দূর পাল্লা / ।
স্বরবৃত্ত ছন্দ অনুযায়ী মাত্রা গণনা করলে দেখা যায়,
ছিপ=১, খান=১, তিন=১, দাঁড়=১মাত্রা। ১+১+১+১ = ৪মাত্রা।
তিন=১, জন= ১, মাল= ১, -লা= ১মত্রা। ১+১+১+১ = ৪মাত্রা।
অর্থাৎ প্রতিটি পর্ব ৪মাত্রার। পরের পংক্তি দেখা যাক :
চৌ=১, পর=১, দিন=১, ভর=১মাত্রা। ১+১+১+১ = ৪ মাত্রা।
দেয়=১, দূর=১, পাল=১, -লা=১মাত্রা। ১+১+১+১ = ৪মাত্রা।
স্বরবৃত্তের চঞ্চল চলন হিসেবে এই বিভাজনই ঠিক। স্বরবৃত্ত ৪
মাত্রার দ্রুত চলনের ছন্দ। অর্থাৎ চতুর্মাত্রিক ছন্দ। এখানে যতি পড়েছে ৪ মাত্রা পর পর। যেমন ''ছিপখান তিন দাঁড় / তিনজন মাল্লা/ । এটি শ্বাস যতি নয়, পাঠ যতি। এই পাঠ যতিকে আরো বিভাজিত করা যায়। যেমন :-- ছিপখান/ তিন দাঁড়/ তিনজন/ মাললা/ । পণ্ডিতেরা একে অর্ধ-যতি সম্পন্ন উপ-পর্ব বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি উপপর্ব ২মাত্রা বিশিষ্ট। এই দুই মাত্রার উপপর্বে ভাগ করা যায় বলেই কেউ কেউ এই দুই মাত্রাকে চার মাত্রা ধরে একে চার মাত্রার মাত্রাবৃত্ত বলে ভুল করেছেন।
মাত্রাবৃত্তে বদ্ধ শব্দাংশ দুই মাত্রা বলে, তারা ধারণা করেছেন,
ছিপ=২মাত্রা, খান=২মাত্রা। অতএব ''ছিপখান''= ২+২= ৪মাত্রা। একই ভাবে তিনদাঁড়=৪ মাত্রা। মাললা= ৩মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ।
''ছিপখান/ তিনদাঁড়/ তিনজন/ মাল-লা
চউপর/ দিনভর/ দেয় দূর/ পাললা ।''
এখানে মাল্লা, চৌপর, পললা এই শব্দগুলি উচ্চারণ অনুযায়ী ভেঙে লিখেছি। ফলে, মাত্রাবৃত্ত হিসেবে, স্বরবৃত্তের অর্ধযতি গুলো এখানে পূর্ণযতি হয়ে গেছে। প্রতি পর্বের শেষে পূর্ণযতি দিয়ে পাঠ করতে গেলে, পাঠের গতি পালটে যায়, যা এই পঙক্তিদ্বয়ের জন্যে
বে মানান। তা ছাড়া, মাত্রাবৃত্তের মতো এলায়িত ভঙ্গিতে পড়তে
উচ্চারণভঙ্গী হয়ে যাবে :-- ছিইপ খাআন/ তিইন দাঁআড়/
তিইনজঅন/ মাআললা/, অনেকটা এমন। কিন্তু কবিতার গতি
তা চায় না। বরং বদ্ধ শব্দাংশগুলোর প্রতিটির দুই বর্ণকে এক মাত্রায় আনলে যে গতি আসে, সেটাই এই পঙক্তি দুটির স্বাভাবিক
গতি। তাই এটি অবশ্যই ৪ মাত্রার পূর্ণপর্ববিশিষ্ট ( দুই মাত্রার উপপর্ব মেনে নিয়েও) স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত।
পঞ্চম পর্ব
----------
''ছিপখান তিন দাঁড়'' এর পরের অংশ
-----------------------------------
আলচনা এগিয়ে নেবার আগে দেখা যাক এ পর্যন্ত আমরা কী কী শিখলাম।
১) নিঃশ্বাসবায়ুর সাহায্য ছাড়া আমরা শব্দ, শব্দাংশ, ধ্বনি - কোনো কিছুই উচ্চারণ করতে পারি না।
২) স্বরবর্ণের সাহায্য ছাড়া ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণ করতে পারি না। যেমন ''ক'' বলতে গেলে ''অ'' যোগ না করে বলা সম্ভব নয়।
৩) একাধিক বর্ণে গঠিত শব্দের যেটুকু নিঃশ্বাসবায়ুর এক চাপে উচ্চারণ করা যায়, তাকেই বলে শব্দাংশ ( সিলেবল)। যেমন :-- ''একটা''। এতে ২টি শব্দাংশ আছে। ''এক'' এবং ''টা''।
৪) শব্দাংশ ২ ধরণের। ''মুক্ত'' এবং ''বদ্ধ''।
৫) যে শব্দাংশ উচ্চারণের শেষে স্বরবর্ণের সাহায্য পেয়ে, যতক্ষণ খুশী টেনে রাখা যায়, সেটাই মুক্ত-শব্দাংশ। যেমন, "টাআআআআআআআআ''।
৬) স্বরবর্ণের সাহায্য পায় না বলে যে শব্দাংশ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই থেমে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না, সেটা বদ্ধ-শব্দাংশ। যেমন :-- ''এক''।
৭) মুক্ত-শব্দাংশ সাধারণত ১ বর্ণে গঠিত। তার সঙ্গে অকার-আকার-ইকার-উকার-একার-ওকার-ঋকার-যফলা-রফলা, ইত্যাদি যুক্ত থাকতে পারে। যেমনঃ-- ও, ক, কা, কি, কী, কু, কূ, কৃ, কে, কো,ক্য, ক্রি - ইত্যাদি।
৮) বদ্ধ-শব্দাংশ দুটি বর্ণে গঠিত। যেমনঃ-- এক, পথ, হাত, মুখ, শখ, পিঠ, পেট, দূর - ইত্যাদি।
৯) প্রতিটি মুক্ত-শব্দাংশ ১ মাত্রা।
১০) প্রতিটি বদ্ধ-শব্দাংশ, স্বরবৃত্ত ছন্দে ১মাত্রা। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ২মাত্রা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে, শব্দের শুরুতে হলে ১মাত্রা, শব্দের মাঝখানে হলে ১মাত্রা, শব্দের শেষে হলে ২মাত্রা।
এর আগে, আলোচনা শেষ করেছিলাম, উদাহরণ দেবার কথা বলে। ''ছিপখান তিন দাঁড়'' তো স্বরবৃত্ত ছন্দ তা আমরা দেখেছি। অন্য কিছু উদাহরণও দেখা যাক, এবং কেন সেটা স্বরবৃত্তই, অন্য ছন্দ নয় তাও দেখে নেয়া যায়। এই দেখতে গেলেই অন্য একটি প্রসঙ্গ এসে যাবে। তা হলো ''পর্ব''বিভাজন। যে কোনো ছন্দবদ্ধ পঙক্তি পড়তে গেলে নিজের অজান্তেই একটি দোলা এসে যায়। ওই দোলা পূর্ণ হলেই সেটা একটি ''পর্ব''। সেটা পূর্ণপরব। এ ছাড়াও আছে, ''অতিপর্ব'' এবং ''অপূর্ণপরব''। সে গুলো
যখন এসে যাবে, তখন আলোচনা করবো।
''বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম
তবু) একটা কিছু হয়েছি যে তাতেই আমি ধন্য হলাম ।।''
কেন এটা স্বরবৃত্ত ছন্দ? সেটা বোঝার জন্যে পঙক্তি দুটির যুক্তাক্ষর গুলো ভেঙ্গে উচ্চারণ অনুযায়ী লেখা যাক।
''বোনধু হোতে চেয়ে তোমার শোতত্রু বোলে গোননো হোলাম
তবু) একটা কিছু হোয়েছি যে তাতেই আমি ধোননো হোলাম ।।''
এবার স্বরবৃত্তের চালে ও নিয়মে মাত্রা গণনা করা যাক। আমরা জানি স্বরবৃত্তে বদ্ধশব্দাংশ ১ মাত্রা। আর মুক্ত শব্দাংশ তো সব ছন্দেই ১ মাত্রা। তাই,
"বোন=১ + ধু=১ + হো=১ + তে=১ + চে=১ + য়ে =১ + তো=১ + মার=১ + শোত=১ + ত্রু=১ + বো=১ + লে=১ + গোন=১ + নো=১ + হো=১ + লাম=১।
এবার দেখা যাক পঙক্তিটি কতো মাত্রার। ১মাত্রা ১মাত্রা করে যোগ করলে দেখা যাচ্ছে মোট ১৬ মাত্রা হয়। এখন এই ষোলো মাত্রাকে পঙক্তিটি পড়ার নির্দিষ্ট দোলায় দোলায় ভাগ করা যাক।
বোন/ধু/ হ/তে/ = ১+১+১+১ = ৪মাত্রা। চে/য়ে/ তো/মার/ = ১+১+১+১ = ৪মাত্রা । শোত/ত্রু/ বো/লে/ = ১+১+১+১ = ৪মাত্রা । গোন/নো/ হো/লাম/ = ১+১+১+১ = ৪মাত্রা। আমি
ভালো ভাবে বুঝে নেবার জন্যে প্রতিটি মাত্রার শেষে ''/'' এই চিহ্ন দিয়েছি। আসলে লেখার নিয়ম হলো, ''বোনধু হতে/ চেয়ে তোমার/ শোতত্রু বোলে/ গোননো হোলাম/''---- এই ভাবে। মূল শব্দ যথাযথ লিখলে, '' বন্ধু হতে/ চেয়ে তোমার/ শত্রু বলে/ গণ্য
হলাম/'' এই ভাবে। আমরা যখন পড়ি তখন ঠিক এমনি দোলায় ভাগ করে করেই পড়ে থাকি। এইযে পড়ার একেকটি ভাগ একেই বলা হয় ''পর্ব''। পর্ব ৩ ধরণের হয়। অতিপরব, পূর্ণপর্ব, অপূর্ণপর্ব। মাত্রা গণনা করতে করতেই পর্বের বিষয়ও এসে যাবে।
এখন বরং পরের পংক্তিটির বিচার করা যাক। এই পঙক্তিতে এক্টাই যুক্তাক্ষর আছে, ধোননো = ধন্য। আগে প্রতি মাত্রায় ভাগ করি। এক/টা/ কি/ছু/ = ১+১+১+১ = ৪মাত্রা। হো/য়ে/ছি/ যে/ = ১+১+১+১ = ৪মাত্রা। তা/তেই/ আ/মি/ = ১+১+১+১ = ৪মাত্রা । ধোন/নো/ হো/লাম/ = ১+১+১+১ = ৪মাত্রা। মূল শব্দ যথাযথ লিখলে, ''একটা কিছু/ হয়েছি যে/ তাতেই আমি/ ধন্য হলাম/ --- এমন হবে। এখানেও দেখা যাচ্ছে প্রতিটি পর্ব ৪মাত্রার। স্বরবৃত্ত ছন্দের পূর্ণপর্ব সব সময় ৪মাত্রার হয়। অপূর্ণ বা অতিপর্ব ১-২ বা ৩মাত্রার হতে পরে। অর্থাৎ পূর্ণপর্বের চেয়ে ছোট। আমি দ্বিতীয় পঙক্তিটা লিখতে যে ফাঁকি দিয়েছি, ওটাই অতিপর্ব। ''তবু) একটা কিছু হয়েছি যে তাতেই আমি ধন্য
হলাম'' । এটা ছিলো দ্বিতীয় পঙক্তি। বিশ্লেষণের সময় ''তবু'' টা আমি লিখিনি। কারণ, ওটা নির্দিষ্ট দোলার মধ্যে পড়ে না। দোলা শুরু হবার আগে ওটা বলে নিতে হয়। এটাকেই বলে "অতিপর্ব''। পূর্ণপর্ব যে দোলায় দোলায় চলে, তার আগে দোলার বাইরে পূর্ণপর্বের চেয়ে কম মাত্রার যে শব্দ বলে নিতে হয়। তাকে বলে অতিপর্ব। অতি বা অপূর্ণপর্ব সম্পর্কে পরে আলোচনা করবো। এর পর দেখে নেবো, এই পঙক্তি দুটি অন্য কোনো ছন্দে পড়ে কি-না।
৬ষ্ঠ পর্ব
--------
''বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গন্য হলাম
তবু) একটা কিছু হয়েছি যে তাতেই আমি ধন্য হলাম ।।''
এটা যে স্বরবৃত্ত তার প্রমাণ আমরা পেলাম। এখানে দ্বিতীয় পঙক্তিতে ''তবু'' যে অতিপর্ব সেটাও জেনে রাখলাম। পরে এ নিয়ে বিস্তৃতভাবে জানার অপেক্ষায়। কিন্তু এই পঙক্তিদ্বয় যে স্বরবৃত্তই, অন্য কোনো ছন্দ নয়, তাও তো প্রমান করতে হবে।
প্রথমেই দেখা যাক, এটাকে কোনোভাবে মাত্রাবৃত্তে বসানো যায় কি-না।
উচ্চারণ অনুযায়ী লিখলে দাঁড়ায়:
''বোনধু হোতে/ চেয়ে তোমার/ শোতত্রু বোলে/ গোননো হোলাম/
তবু) একটা কিছু/ হোয়েছি যে/ তাতেই আমি/ ধোননো হোলাম/ ।''
আমরা জেনে এসেছি যে, বদ্ধ শব্দাংশ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে শব্দের শুরুতে, মধ্যে বা শেষে যেখানেই থাকুক, ২মাত্রা বলে ধরা হবে। সেই ভাবে গণনা করা যাক:
বোন=২,ধু=১, হো=১,তে=১ মাত্রা। অর্থাৎ ২+১+১+১= ৫ মাত্রা।
চে=১, য়ে=১, তো=১, মার=২ মাত্রা। অর্থাৎ ১+১+১+২ = ৫ মাত্রা।
শোত=২,ত্রু=১, বো=১,লে=১ মাত্রা। অর্থাৎ ১+১+১+২ = ৫ মাত্রা।
গোন=২,নো=১ হো=১,লাম=২ মাত্রা। অর্থাৎ ২+১+১+২ = ৬ মাত্রা।
পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত হয়। তাই এই পঙক্তির ১ম, ২য়, ৩য় পর্বগুলো পাঁচ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত হিসেবে পাঠ করা গেলেও, ৪র্থ পর্বে এসে তা আর থাকেনি। ওখানে ৬মাত্রা হয়ে গেছে। অথচ নিয়ম হলো স্বরবৃত্ত অথবা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে, সবগুলো পূর্ণপর্ব সমান মাপের হতে হবে। যাকে বলে সমমাত্রিক। অতএব প্রথম পংক্তিতেই আমরা বুঝে গেলাম, এটা ৫ মাত্রার পূর্ণপর্বের মাত্রাবৃত্ত নয়।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, ৪ মাত্রার, ৫মাত্রার, ৬ মাত্রার এবং ৭মাত্রার পূর্ণপর্বে রচিত হতে পারে। এই পঙক্তি দুটি তার কোনোটাতেই স্বাচ্ছন্দ্যে বিভাজন করা যায় না। অতএব এটি মাত্রাবৃত্ত নয়।
একই ভাবে এটা যে অক্ষরবৃত্তও নয়, তা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আলোচনার সময় বোঝা যাবে।
আমরা এটুকু নিশ্চিত হলাম যে, স্বরবৃত্ত ছন্দ ৪মাত্রার পূর্ণপর্বে গঠিত। এর আগে ''অতিপর্ব'' এবং পরে ''অপূর্ণপর্ব'' থাকতে পারে। এটা মনে রাখতে হবে যে, পঙক্তিতে ছন্দের নির্দিষ্ট দোলা শুরু হবার আগে যদি পূর্ণপর্বের চেয়ে কম মাত্রার কোনো শব্দ থাকে, সেটাই অতিপর্ব। এবং পঙক্তির শেষে নির্দিষ্ট দোলার পরেও যদি, পূর্ণপর্বের চেয়ে কম মাত্রার কোনো শব্দ বা শব্দাংশ অবশিষ্ট থাকে, সেটাই অপূর্ণপর্ব। যেমন:
তুমি) এমনি জাল/ পেতেছো সং/-সারে । এটাও স্বরবৃত্ত ছন্দ।
এখানে তু=১, মি=১। ১+১ = দুই মাত্রার অতিপর্ব।
এ=১, ম=১, নি=১, জাল =১, অর্থাৎ ১+১+১+১ = ৪ মাত্রার পূর্ণপর্ব ; পে=১, তে=১, ছো=১, সং=১, অর্থাৎ ১+১+১+১ = ৪ মাত্রার পূর্ণপর্ব। এবং -সা=১,রে=১। এই দুই মাত্রার অপূর্ণপর্ব।
এখানে আর একটি মজার ঘটনা ঘটে গেছে। ''সংসারে'' শব্দটার পেট কেটে দুই ভাগ করা হয়েছে। যার প্রথমাংশ পড়েছে পর্ব পূর্ণ করতে। আর শেষাংশ পড়েছে অপূর্ণপর্বে। শব্দের মধ্যে এই যে ছেদ আনা হয়, একে বলে মধ্যখণ্ডন। '' মধ্যখণ্ডন'' নিয়ে পরে আলোচনা করবো।
সপ্তম পর্ব
----------
একটি সম্পূর্ণ গানের কবিতা উদ্ধৃত করে এই পর্ব শুরু হোক।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু পরিচিত, জনপ্রিয় এবং নন্দিত গানঃ--
আমার) সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করবো নিবেদন
আমার) ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন ।।
যখন বেলা-শেষের ছায়ায় পাখিরা যায় আপন কুলায়-মাঝে
সন্ধ্যাপূজার ঘন্টা যখন বাজে,
তখন আপন শেষ শিখাটি জ্বালবে এ জীবন ---
আমার) ব্যথার পূজা হবে সমাপন ।।
অনেক দিনের অনেক কথা, ব্যাকুলতা, বাঁধা বেদন-ডোরে
মনের মাঝে উঠেছে আজ ভ'রে ।
যখন পূজার হোমানলে উঠবে জ্বলে একে একে তারা
আকাশ-পানে ছুটবে বাঁধন-হারা,
অস্তরবির ছবির সাথে মিলবে আয়োজন ---
আমার) ব্যাথার পূজা হবে সমাপন ।।
আমরা, কবিতাটি লেখার সাথে সাথে তার পর্ব বিভাজনও করে নিয়েছি। কয়েকটি কারণ বিবেচনায় রেখে এই বিশেষ গানের কবিতাটি বেছে নেয়া হলো।
১) বিভিন্ন বিবেচনায়, একমাত্র নজরুল ছাড়া, কেউই গানের কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের তুল্য নয় এখন পর্যন্ত।
২) এই গানের কবিতায়, অতিপর্ব, পূর্ণপর্ব, অপূর্ণপর্ব সবই আছে।
৩) পূর্ণপর্বের সংখ্যার বৈচিত্র্য আছে ।
৪) মধ্যখণ্ডন আছে ।
৫) স্বরবৃত্তের বিশুদ্ধ মাত্রাগণনা কেমন, এটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
আমরা এবার (১) কোনটা অতিপর্ব, কোন পংক্তিতে কতগুলো পূর্ণপর্ব (২) কোনটা কোনটা অপূর্ণপর্ব তা দেখে নেবো।
এই গানটি যারা শুনেছেন, এবং যাদের তালজ্ঞান আছে, তারা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, অতিপর্ব ''আমার'' সব সময়ই সম-এর আগে ধরা হয়েছে। সম-এ পড়েছে, সকল, ব্যথার এই শব্দগুলির উপর। ছন্দের ক্ষেত্রেও ''আমার'' অতিপর্ব হিসেবে এসেছে। গান হিসেবে শোনা এবং কবিতা হিসেবে পড়ার ক্ষেত্রে নির্ধারিত দোলা, আমরা যে ভাবে পর্ব বিভাজন করেছি, সে ভাবেই। আমরা ছাপার অক্ষরে গীতবিতানে দেখতে পারি। সেখানে আমাদের মতো বন্ধনী দিয়ে নয়, অতিপর্ব দেখানো হয়েছে মার্জিন শুরুর বাইরে, বেশ ফাঁক রেখে। মার্জিন থেকে এসেছে, সকল দুখের ----, ব্যথার পূজা -----, যখন বেলা ----, সন্ধ্যাপূজার -----, তখন আপন ----- ইত্যাদি। গানে সম-ও পড়েছে এই শব্দগুলির উপর।
এবার আগে ''অপূর্ণপর্ব'' গুলো দেখে নিতে পারি। এখানে আস্থায়ী এবং দুটি সেতুবন্ধ পঙক্তিতেই যেমন মধ্যখণ্ডন আছে, তেমনি অপূর্ণপর্ব হিসেবে এসেছে খণ্ডনের পরের অংশ। যার সব গুলো বদ্ধশব্দাংশ এবং ১ মাত্রা। -দন।,-পন, -বন,-জন। আমরা তো জানি বদ্ধশব্দাংশ স্বরবৃত্তে ১ মাত্রা।
এবার পঙক্তি ধরে আসি প্রথম থেকেঃ
আমার / (অতিপর্ব) আ=১মাত্রা+মার=১মাত্রা, মোট ২মাত্রা। পূর্ণপর্বঃ-- স=১মাত্রা +কল=১মাত্রা+ দু=১মাত্রা+ খের=১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। প্র=১মাত্রা+ দীপ=১মাত্রা+ জ্বে=১মাত্রা+ লে=১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা।দি=১মাত্রা+ বস=১মাত্রা+ গে=১মাত্রা+ লে=১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। কর=১মাত্রা+ ব=১মাত্রা+ নি=১মাত্রা+ বে=১মাত্রা, মোট ৪ মাত্রা। এরপর খণ্ডন হয়ে এসেছে অপূর্ণপর্ব /দন=১মাত্রা। অর্থাৎ এই পঙক্তিতে ২মাত্রার অতিপর্ব, ৪মাত্রা করে ৪টি পূর্ণপর্ব এবং ১মাত্রার অপূর্ণপর্ব। --- এর পর আবার অতিপর্বঃ--- আ=১মাত্রা+ মার=১মাত্রা। মোট ২মাত্রা পূর্ণপর্বঃ--- ব্যা=১মাত্রা+থার=১মাত্রা+ পূ=১মাত্রা+ জা=১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। হয়=১মাত্রা+ নি=১মাত্রা+ স=১মাত্রা+ মা=১মাত্রা, মোট ৪ মাত্রা। এরপর খণ্ডন হয়ে এসেছে অপূর্ণপর্ব /পন=১মাত্রা। এই পংক্তিতে ২মাত্রার অতিপরব, ৪মাত্রার দুটি পূর্ণপর্ব এবং ১মাত্রার অপূর্ণপর্ব আছে।
কেউ কেউ এই দুই পঙক্তির পর্ব বিভাজন এই ভাবে করার কথা বলেছেনঃ
''আমার সকল/ দুখের প্রদীপ/ জ্বেলে দিবস/ গেলে করব/ নিবেদন''।
রবীন্দ্রনাথ কি এতোই অবোধ যে, তাঁর বক্তব্য প্রকাশকে পর্বে পর্বে এমন অর্থহীন করে ফেলবেন? তাঁর বক্তব্য হলো, আমার যত দুঃখ আছেসে সব দুঃখের প্রদীপ জেলে, দিন যাবার পর
(সন্ধ্যায়) নিবেদন করবো। সেটাকে, বিশেষ করে, জ্বেলে দিবস - গেলে করব - নিবেদন, এমন ভাবে বিভাজিত করবেন? ''জ্বেলে দিবস'' - ''গেলে করব'' এভাবে শুনতে কানেই
তো খটকা লাগে। এটা যে রবীন্দ্র নির্মাণকলার সংগে কোনো ভাবেই যায় না, সে তো প্রাথমিক ধারণার বিষয়।
যাক, এই বিভ্রান্তি রেখে, আমরা অন্তরার পর্ব বিভাজনের দিকে এগিয়ে যাই।
প্রথম অন্তরাঃ য = ১মাত্রা + খন = ১মাত্রা + বে= ১মাত্রা + লা = ১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। -শে = ১মাত্রা + ষের = ১মাত্রা + ছা = ১মাত্রা + য়ায়= ১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। পা = ১মাত্রা + খি = ১মাত্রা + রা = ১মাত্রা + যায় = ১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। আ=১মাত্রা+পন=১মাত্রা+কু=১মাত্রা+লায়=১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। -মা=১মাত্রা+ঝে=১মাত্রা, ২মাত্রার অপূর্ণপর্ব। এখানে দেখা যাচ্ছেঃ--- ৪মাত্রা করে ৪টি পূর্ণপর্ব এবং ২মাত্রার অপূর্ণপর্ব। কোনো অতিপর্ব নেই।''
দ্বতীয় পঙক্তিঃ সন=১মাত্রা+ধা=১মাত্রা+পূ=১মাত্রা+জার=১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। ঘণ=১মাত্রা+টা=১ মাত্রা+য=১মাত্রা+খন=১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। বা=১মাত্রা+জে=১মাত্রা, মোট ২ মাত্রার অপূর্ণপর্ব। অর্থাৎ ৪মাত্রা করে ২টি পূর্ণপর্ব এবং ২মাত্রার অপূর্ণপর্ব। কোনো অতিপর্ব নেই।
এবার সেতুবন্ধ পঙক্তি। ( অন্তরার শেষের যে পঙক্তিটি আস্থায়ীর অন্ত্যমিলের সাথে মিল সৃষ্টি করে, আস্থায়ীতে ফিরবার তাগিদ দেয়, সেটার নাম দিয়েছি আমরা ''সেতুবন্ধ পঙক্তি'' )। এখানেও দেখা যাকঃ ত = ১মাত্রা + খন = ১মাত্রা + আ = ১মাত্রা + পন = ১মাত্রা, মোট ৪ মাত্রা। শেষ = ১মাত্রা + শি = ১মাত্রা + খা = ১মাত্রা + টি = ১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। জ্বাল=১মাত্রা+বে=১মাত্রা+এ=১মাত্রা+জী=১মাত্রা, মোট ৪মাত্রা। এর পর খণ্ডিত হয়ে এসেছে, বন=১মাত্রার অপূর্ণপর্ব। ৪ মাত্রা করে ৩টি পূর্ণপর্ব এবং ১মাত্রার অপূর্ণপর্ব।
এর পর কবি আস্থায়ীর শেষ পংক্তিতে ফিরেছেন, শুধু একটি শব্দ পরিবর্তন করে। ''হয় নি'' এর বদলে লিখেছেন হবে। এখানেও আস্থায়ীর মতন অতিপর্ব রেখেছেনঃ--- আমার /(অতিপর্ব) ব্যাথার পূজা/ হবে সমা/ -পন ।। অর্থাৎ ২মাত্রার অতিপর্ব, ৪ মাত্রার ২টি পূর্ণপর্ব এবং ১মাত্রার অপূর্ণপর্ব।
সঞ্চারীটি বিশ্লেষণ করলেও আমরা দেখতে পাবো, প্রথম পংক্তিতে ৪মাত্রা করে ৪টি পূর্ণপর্ব এবং ২মাত্রার অপূর্ণপর্ব। দ্বিতীয় পঙক্তিতে, ৪মাত্রা করে ২টি পূর্ণপর্ব এবং ২ মাত্রার অপূর্ণপর্ব। দুটি পঙক্তিতেই অতিপর্ব নেই। আভোগ(দ্বিতীয় অন্তরা)টি, প্রথম অন্তরার মতোই বিভাজন করা যায় সহজেই।
এতে অনেকের অনেক প্রশ্নের উত্তরও এসে গেছেঃ--- পূর্ণপর্বের সংখ্যা বিভিন্ন পঙক্তিতে কম বেশী করা যায়। এখানে আমরা ৪টি পূর্ণপর্বের পঙক্তি পেয়েছি যেমন তেমনি ২টি এবং তিনটি পূর্ণপর্বের পঙক্তি পেয়েছি। আবার অপূর্ণপর্বের মাত্রাসংখ্যা কম-বেশী করাও দেখেছি। অতিপর্বের মাত্রাসংখ্যাও কম-বেশী করা যায়। মনে রাখতে হবে অতি বা অপূর্ণপর্বের মাত্রাসংখ্যা অবশ্যই পূর্ণপর্বের মাত্রাসংখ্যার চেয়ে কম হতে হবে। পাঠের সময় শ্রবণে যেন ধাক্কা না লাগে, অর্থাৎ স্বাচ্ছন্দ্যে পড়া যায় যেন।
স্বরবৃত্ত ছন্দে শব্দের মাত্রা গণনায় কিছু ব্যতিক্রমও আছে। ৩মাত্রার শব্দকে বা ৫মাত্রার শব্দকে ৪ মাত্রা হিসেবে গণ্য করা হয় যেখানে। এ বিষয়ে, কবি আবিদ আনোয়ারের ইতোমধ্যে দেয়া বিশ্লেষণগুলো ভালো করে দেখে নিতে অনুরোধ করছি। তবে এমন গণনা, অত্যাবশ্যক ক্ষেত্রে ছাড়া, না করাই ভালো। আমাদের এই সব আলোচনা যাদের পড়া নেই, তারা, বিশেষ করে নতুন হলে, বিভ্রান্ত হবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এর বাইরেও কিছু শব্দ নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। যেমনঃ--- স্ত্রী - স্ত্রৈণ - স্তব্ধ - স্কুল - স্ফীত - তৃণ - প্লীহা - ম্লান ইত্যাদি। স্ত্রী -- এই শব্দটাতে অনেকগুলি বর্ণের সংযোগ আছে। স-ত-র(রফলা আকারে) ঈ(দীঘইকার আকারে)। তার পরও এটি একমাত্রা। কারণ ''স'' এখানে পূর্ণভাবে উচ্চারিত নয়। ইংরেজী S ধ্বনি এখানে কোনো স্বরবর্ণের সাহায্য না পাওয়ায় অনেকটা চাপা শিস-এর মতো সূক্ষ্ম আওয়াজ স্পর্শ করে যায় মাত্র। তাই এটি কোনো মাত্রা হয়ে ওঠে না। এমনি তেই শিস ধ্বনি কোনো বর্ণ নয়, তাই তার লিখিত বা শ্রুত রূপের কোনো মাত্রা নির্ণয় করা যায় না। সেই চাপা শিস স্পর্শ করেছে ''ত্রী''কে। ত্র - ত্রা - ত্রি - ত্রী - ত্রু -ত্রূ - তৃ - ত্রে- ত্রো - ত্রৈ - ত্রঔ (ত্র-এর সংগে ঔকার টাইপে না আসায় এই ভাবে লেখা) সবই স্বরবৃত্তে ১মাত্রা। তাই স্ত্রী=১মাত্রা। স্ত্রৈণ-তে স্ত্রৈ=১মাত্রা+ণ=১মাত্রা, মোট ২মাত্রা। স্তব্ধ-তে, স্ত=১মাত্রা (শিস কোনো মাত্রা নয় বলে)। ফলে শব্দটি ''স্তব'' হলে, ব যুক্ত হবার পরেও ১মাত্রাই হতো। কিন্তু এখানে স্তব=১মাত্রা+ধ=১মাত্রা, মোট ২মাত্রা। স্তব - এর মতোই স্কুল=১মাত্রা। স্ফী=১মাত্রা+ত=১মাত্রা, মোট ২মাত্রা। তৃ=১মাত্রা+ণ=১মাত্রা, মোট ২মাত্রা। প্লীহা - এই শব্দটিতে ''প'' কোনো স্বরবর্ণের সাহায্য না পেয়েই ''ল''এর সাথে যুক্ত ''প'' কে টানা যাচ্ছে না - কিন্তু প্লীইইইই যথেচ্ছা টানতে পারি। তাই প্লী মুক্তশব্দাংশ হিসেবে ১মাত্রা+হা=১মাত্রা, মোট ২মাত্রা। ''ম্লান'' এর ক্ষেত্রেও ''ম্লা''=১মাত্রা। কিন্তু সঙ্গে যেই স্বরবর্ণের সাহায্যহীন ''ন'' যুক্ত হলো, ম্লা আর মুক্ত থাকলো না। ''ম্লান'' হয়ে গেলো ১মাত্রার বদ্ধশব্দাংশ।
মজার ব্যাপার হলো, স্ত্রী এক মাত্রা, চাপা শিস ধ্বনি ত্রী-এর সংগে যুক্ত বলে। কিন্তু, সস্ত্রীক-এ, ত্রী-এর সঙ্গে যুক্ত শিস ধ্বনিটা চলেযাচ্ছে স-এর সংগে। হয়ে যাচ্ছে '' সস্ ত্রীক। সস্ = ১মাত্রা+ ত্রীক=১মাত্রা, মোট ২ মাত্রা। এ সবই কিন্তু স্বরবৃত্তের বিচারে। অন্য ছন্দে কিছু কিছু অন্য রকম হতেও পারে।