কোথা রাত্রি , কোথা দিন , কোথা ফুটে চন্দ্র সূর্য তারা ,
কে বা আসে কে বা যায় , কোথা বসে জীবনের মেলা ,
কে বা হাসে কে বা গায় , কোথা খেলে হৃদয়ের খেলা ,
কোথা পথ , কোথা গৃহ , কোথা পান্থ , কোথা পথহারা !
কোথা খ ‘ সে পড়ে পত্র জগতের মহাবৃক্ষ হতে ,
উড়ে উড়ে ঘুরে মরে অসীমেতে না পায় কিনারা ,
বহে যায় কালবায়ু অবিশ্রাম আকাশের পথে ,
ঝর ঝর মর মর শুষ্ক পত্র শ্যাম পত্রে মিলে !
এত ভাঙা এত গড়া , আনাগোনা জীবন্ত নিখিলে ,
এত গান এত তান এত কান্না এত কলরব —
কোথা কে বা , কোথা সিন্ধু , কোথা ঊর্মি , কোথা তার বেলা —
গভীর অসীম গর্ভে নির্বাসিত নির্বাপিত সব !
জনপূর্ণ সুবিজনে , জ্যোতির্বিদ্ধ আঁধারে বিলীন
আকাশমণ্ডপে শুধু বসে আছে এক ‘চিরদিন’ ।
২
কী লাগিয়া বসে আছ , চাহিয়া রয়েছ কার লাগি ,
প্রলয়ের পরপারে নেহারিছ কার আগমন ,
কার দূর পদধ্বনি চিরদিন করিছ শ্রবণ ,
চিরবিরহীর মতো চিররাত্রি রহিয়াছ জাগি !
অসীম অতৃপ্তি লয়ে মাঝে মাঝে ফেলিছ নিশ্বাস ,
আকাশপ্রান্তরে তাই কেঁদে উঠে প্রলয়বাতাস ,
জগতের ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে টুটে কোথা যায় ভাগি !
অনন্ত আঁধার – মাঝে কেহ তব নাহিক দোসর ,
পশে না তোমার প্রাণে আমাদের হৃদয়ের আশ ,
পশে না তোমার কানে আমাদের পাখিদের স্বর ।
সহস্র জগতে মিলি রচে তব বিজন প্রবাস ,
সহস্র শবদে মিলি বাঁধে তব নিঃশব্দের ঘর —
হাসি , কাঁদি , ভালোবাসি , নাই তব হাসি কান্না মায়া —
আসি , থাকি , চলে যাই কত ছায়া কত উপছায়া !
৩
তাই কি ? সকলি ছায়া ? আসে , থাকে , আর মিলে যায় ?
তুমি শুধু একা আছ , আর সব আছে আর নাই ?
যুগযুগান্তর ধরে ফুল ফুটে , ফুল ঝরে তাই ?
প্রাণ পেয়ে প্রাণ দিই , সে কি শুধু মরণের পায় ?
এ ফুল চাহে না কেহ ? লহে না এ পূজা – উপহার ?
এ প্রাণ , প্রাণের আশা , টুটে কি অসীম শূন্যতায় ।
বিশ্বের উঠিছে গান , বধিরতা বহি সিংহাসনে ?
বিশ্বের কাঁদিছে প্রাণ , শূন্যে ঝরে অশ্রুবারিধার ?
যুগযুগান্তের প্রেম কে লইবে , নাই ত্রিভুবনে ?
চরাচর মগ্ন আছে নিশিদিন আশার স্বপনে —
বাঁশি শুনি চলিয়াছে , সে কি হায় বৃথা অভিসার !
বলো না সকলি স্বপ্ন , সকলি এ মায়ার ছলন —
বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে , সে স্বপন কাহার স্বপন ?
সে কি এই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকার ?
৪
ধ্বনি খুঁজে প্রতিধ্বনি , প্রাণ খুঁজে মরে প্রতিপ্রাণ ।
জগৎ আপনা দিয়ে খুঁজিছে তাহার প্রতিদান ।
অসীমে উঠিছে প্রেম শুধিবারে অসীমের ঋণ —
যত দেয় তত পায় , কিছুতে না হয় অবসান ।
যত ফুল দেয় ধরা তত ফুল পায় প্রতিদিন —
যত প্রাণ ফুটাইছে ততই বাড়িয়া উঠে প্রাণ ।
যাহা আছে তাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠে দীনহীন ,
অসীমে জগতে একি পিরিতির আদান – প্রদান !
কাহারে পূজিছে ধরা শ্যামল যৌবন – উপহারে ,
নিমেষে নিমেষে তাই ফিরে পায় নবীন যৌবন ।
প্রেমে টেনে আনে প্রেম , সে প্রেমের পাথার কোথা রে !
প্রাণ দিলে প্রাণ আসে , কোথা সেই অনন্ত জীবন !
ক্ষুদ্র আপনারে দিলে , কোথা পাই অসীম আপন —
সে কি ওই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকারে !
(কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ)