কবিতার সঙ্গে দূরত্ব
রমেন আচার্য
আমাদের সঙ্গে কবিতার এতো দূরত্ব কেন? ছাত্রাবস্থায় বাধ্য হয়ে কবিতা পড়তে হয়েছিল, তার পরবর্তী সময়ে কি কবিতার সঙ্গে কোনো মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, অর্থাৎ প্রিয় হয়ে ওঠেনি কোনো কবিতা? ছেলে-মেয়েদের আবৃত্তির প্রয়োজনে খোঁজ পড়েছে মঞ্চসফল কবিতার। ঘরে ঘরে এই তাগিদটুকুই শুধু চোখে পড়ে। অথচ ছাত্রাবস্থায় নিশ্চয়ই যোগ্য শিক্ষকের কবিতাবিষয়ক আলোচনায় কবিতার নানা সম্পদের কথা সামনে এসেছিল, তবু কেন আমরা কবিতাবিমুখ?
কথাসাহিত্যে অর্থ ও জনপ্রিয়তা পেয়েও কোনো কোনো সাহিত্যিক তাঁদের সব চেয়ে প্রিয় বিষয় হিসেবে কবিতার কথাই বলেন। গদ্যে যা প্রকাশ করা যায় না, কবিতায় সেই সূক্ষ্ম অনুভব প্রকাশ করা সম্ভব, শুধু কি এই কারণে, নাকি অন্য জাদু আছে কবিতায়, সে জন্য?
মনে হয়, আমাদের ভিতরে পড়ে থাকা মনোবীণা, যা জন্মকাল থেকেই আমাদের অজ্ঞাতে স্পর্শহীন হয়ে পড়ে থাকে, ফলে ক্রমে তার সংবেদী তারে মরচে ধরে ও দেহের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে একই চিতায় ভষ্মীভূত হয় অচেনা সেই বীণা। তবু এমনও কেউ থাকেন, যাঁর স্পর্শে হঠাৎ অশ্রুত বীণার ঝংকারে জেগে ওঠে মনপ্রাণ। তখনই যেন জন্ম হয় এক সৃজনশীল মানুষের, এভাবেই হয়তো তিনি ক্রমে শিল্পী, লেখক বা সংবেদী পাঠক হয়ে ওঠেন।
‘কবিতার সঙ্গে দূরত্ব’ কথাটা শুনে কেউ বলবেন মঞ্চে মঞ্চে তো কবিতা শুনতে ভিড় কম হয় না। এটাই যেন একটা ধাঁধা। সাধারণত সূক্ষ্ম ও গভীর কবিতা মঞ্চসফল হয় না, একবার মাত্র শুনেই তার ভিতরের সম্পদ উন্মোচিত হয় না বলে। আবৃত্তিকার নির্বাচন করেন এমন কবিতা যা শোনামাত্র শ্রোতাদের বোধগম্য হয় ও তাদের আলোড়িত করে। শুধু শ্রোতা নয়, অনেক পাঠকও এরকম সহজ সরল ছন্দ-মিলযুক্ত কবিতা পছন্দ করেন। কবিতায় পাশাপাশি এরকম বহমান দুটি প্রবাহকে দেখি। একটি ধারা আবৃত্তিমঞ্চে সমাদৃত, অন্য ধারার কবিতা জনারণ্যে নয়, নিভৃত নির্জনে পাঠের জন্য, বার বার পাঠের জন্য। যাদের কবিতার প্রতি আকর্ষণ আছে, সেই খুব অল্প সংখ্যক মানুষের ভিতরও আছে শ্রেণী-বিভাগ। তাদের অপেক্ষাকৃত বড় অংশের পছন্দ এমন কবিতা, যা ছন্দ-মিল যুক্ত, কাহিনিপ্রধান, আবেগমণ্ডিত কবিতা। যদি শুধু পাঠকের পছন্দের কথা ভাবি, তাহলেও তা প্রায় এরকমই। অথচ এমন বিষয়ও আছে যা সূক্ষ্ম, জটিল ও ভাষাতীত কোনো অনুভব, যা সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। স্বাভাবিক কারণেই কবি যখন কবিতার নানা গুণপনা নির্মাণে যুক্ত করে পাঠককে সূক্ষ্ম অনুভবে অনুরণিত করতে চান, তখন সূক্ষ্মতার কারণেই সেই কবিতা জটিল হয়ে ওঠে।
পাঠকের ভিতর যাঁদের সংবেদী, কল্পনাপ্রবণ ও সৃজনশীল পাঠক বলে ভাবা হয়, তাঁদের কাছে কাব্যরসই প্রধান বিবেচ্য। তাঁরা জানেন যে, অক্ষমতার কারণে নয়, কবিতার প্রয়োজনেই কবি ছন্দ-মিল গ্রহণ বা বর্জন করেন। প্রাচীন কাহিনিতে যেমন আছে মন্ত্রপূত তীরের কথা, যা লক্ষ্যভেদে অমোঘ, তেমনি কবিতার লক্ষ্যভেদেও কবির প্রয়োজন হয় অমোঘ শব্দ ও কবিতার নানা সম্পদের যথার্থ প্রয়োগের। কবিতার নানা সম্পদের সঙ্গে পাঠকের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হলে, তা কবিতার কাব্যরস গ্রহণের ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়। ফলে পাঠক হিসেবে বেশি প্রাপ্তি ঘটে সেই পাঠকের। ছন্দ-মিলকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন কবিতার ‘বহিরাবরণ’, তা কবিতা নয়। ফলে কবিতার এই বাইরের আবরণ সরিয়ে কবিতার অন্দরমহলের বন্ধ দরজা খুলে কাব্যরসের সন্ধান করতে হয় পাঠককে।
অনেক সময় দেখা যায় আবৃত্তির অনুষ্ঠানে এসে যে শ্রোতার কবিতার প্রতি ভালোবাসার জন্ম হল, তিনি বিখ্যাত কবির কাব্যগ্রন্থ কিনে দেখলেন যে সেই কবিতার ভিতরে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। কারণ কবিতার এই
1
দ্বিতীয় ধারাটি সূক্ষ্ম ও গভীর অনুভবে সমৃদ্ধ, যার ভিতরে প্রবেশের জন্য পাঠককে যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। এরকম কবিতা যেন ভিন্ন জাতের কবিতা, শুধু মাত্র একবার পাঠ করলেই যা বোঝা যায় না, বার বার পাঠ করার পরে রহস্যের জটিলতা সরে যেতে থাকে। কবি ইচ্ছে করে কি কবিতাকে এরকম জটিল করেন? না, অনেক সময়ই কবিতা নিজের ভিতরে কোনো অধরা মাধুরীকে ধারণ করতে গিয়েই জটিল ও রহস্যময় হয়। পাঠক নিজের বোধে যখন তার গভীর স্বাদ পান, তখন কবিতার ভিতরের নানা সম্পদ ও জাদুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটতে থাকে ও তার সম্মোহনে জড়িয়ে একসময় ওই পাঠকই হয়তো কবিতাপ্রেমী হয়ে ওঠেন। কবিতা ও পাঠকের ভিতর এটা যেন ভিন্ন রকমের প্রিয় এক খেলা।
রবীন্দ্রনাথ কবিতার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ স্পর্শ করেও শিশু কিশোর ও সাধারণ মানুষের জন্য লিখেছেন। অন্য দিকে জীবনানন্দ কবিতায় স্থির ও মগ্ন থেকেছেন একই উচ্চতায় থেকে। ফলে জীবনানন্দ দাশকে বুদ্ধদেব বসু পাঠকসমাজে পরিচিত করানোর পরেও তাঁর কবিতার সঙ্গে পাঠকের দূরত্ব থেকেই গেছে। কবির সঙ্গে পাঠকের এরকম দূরত্ব কি অনিবার্য?
একজন প্রতিভাবান কবি নিজের সাধনায় কবিতার যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন, আমরা কি চাইবো কবি সেই উচ্চতা থেকে সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার সমতলে নেমে এসে কবিতা রচনা করুন? যে কবি সময় থেকে এগিয়ে আছেন, তাঁকে পেছনে টেনে না ধরে, পাঠককেই এগিয়ে যাওয়ার সাধনা করতে হবে। সেই সাধনা কেমন? আমরা জানি শিল্পী ও লেখক সৃজন করেন, পাঠকও কিন্তু প্রায় ওই রকমই সৃজন করেন। একথা শুনতে অদ্ভূত লাগলেও কবিতার ক্ষেত্রে কথাটা সঠিক। কারণ কবিতার শব্দ ও বাক্যের মধ্যে গোপন থাকে অনেক না-বলা কথার বীজ, থাকে ইঙ্গিত ও সংকেত। তাই বচনাতীত কোনো অনুভব কবি এক পঙ্ক্তিতে প্রকাশ করলেও তাকে গদ্যে প্রকাশ করতে বহু বাক্যব্যয় করতে হয়। এই অদ্ভূত জাদু যেমন আকর্ষণ করে কবিকে, তেমনি পাঠকও এই ধাঁধার সমাধানে ঘর্মাক্ত হলেও অবশেষে গভীর তৃপ্তি লাভ করেন। কারণ নিজের বোধে ওই না-বোঝা কবিতাকে, কবিতার এক একটা শব্দকে অর্থময় করে তুলতে চান পাঠক। এই পদ্ধতিই পাঠকের নিজের ভিন্ন এক সৃজন হয়ে ওঠে। এভাবেই কবিতার ভিতরের অধরা মাধুরীকে আবিষ্কার করার খেলা ও সেই খেলার আকর্ষণই তো আলাদা। আবিষ্কার করার এরকম সাফল্যে তাই তৃপ্তি পান পাঠক। কবিতা পাঠের এই অসামান্য তৃপ্তি ও সম্মোহন বিস্ময়কর। গল্প-উপন্যাস একবার পড়ে সরিয়ে রাখা যায়, কিন্তু কবিতার কাছে বার বার ফিরে যেতে হয়, নানা সময়ে যেন কবিতার রঙ বদল হয় পাঠকের বোধে ও সৃজনে। তাই অংকের মতন একই উত্তর হয় না কবিতার, নানা জনের সৃজনে নানা রূপ ফুটে উঠে নান্দনিক তৃপ্তি দেয় কবিতা! কবিতার শব্দকে শব্দবীজ বলা হয়, কারণ বীজ থেকে উদ্ভিদ যেমন ফুল ফল পাতায় বিকশিত ও প্রসারিত হয়, তেমনি বিকশিত ও প্রসারিত হওয়ার গুণ গুটিয়ে থাকে শব্দের ভিতর। জলসেচে বীজ থেকে যেমন উদ্ভিদের জন্ম ও বৃদ্ধি, তেমনি পাঠকের কল্পনা যেন এই জলসেচের কাজ করে। ফলে পাঠকের কল্পনায় কবির না-বলা কথা বা সংকেত উদ্ভাসিত হয়। সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেছেন – ‘সকলেই কবিতার পাঠক নয়, কেউ কেউ কবিতার পাঠক।’ কথাটা কবিতার ক্ষেত্রে সঠিক, কারণ শব্দবীজকে কল্পনায় প্রসারিত করার গুণ সব পাঠকের থাকে না। এটা যেন ভিন্ন এক যোগ্যতা।
আমরা জেনেছি জীবনানন্দ দাশ একজন বিখ্যাত কবির নাম। কিন্তু এই জানা কতটা লোকমুখে শুনে ও পত্রপত্রিকায় পড়ে, আর কতটা কবিতার ভিতরে নিজে প্রবেশ করে সেই কবিতার রস ও উচ্চতা নিজের বোধে আবিষ্কার করে, এ প্রশ্নটি নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা খুব জরুরী। আর তাহলেই হয়ত স্পষ্ট হতে পারে কবিতার সঙ্গে আমাদের দূরত্বের বিষয়টি।
এবার বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে এই প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন তা শোনা যাক –
‘--- অনেকে বর্ণান্ধ হয়ে জন্মায়, তেমনি অনেকে জন্মায় কবিতাবধির হয়ে – দুঃখের বিষয় দ্বিতীয় শ্রেণীর সংখ্যা বেশি। কবি বারবার আমাদের কল্পনাকেই স্পর্শ করেন, তাই খানিকটা কল্পনাশক্তি থাকতেই
২
হবে পাঠকের। তারপর শিক্ষা, চর্চা ও সংস্কৃতির ফলে উপভোগের ক্ষমতা ক্রমশই ব্যাপক ও গভীর করে তোলা যায়, একথা বলাই বাহুল্য।’
বোঝা গেল, শুধু কবির নয়, পাঠকের মধ্যেও কল্পনা না থাকলে কবিতার বন্ধ দরজা খোলে না। অন্য ক্ষেত্রে কল্পনা মিথ্যে ও অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও, কবিতার ক্ষেত্রে কল্পনা একটা বড় সম্পদ। কবির কল্পনার একটি ডানার সঙ্গে যখন যুক্ত হয় পাঠকের আর একটি কল্পনার ডানা, তখন ওই দুটি ডানার যুগ্ম প্রয়াসে কবিতা অসীমে যাত্রা শুরু করে। আর এভাবেই পাঠকও কবিতার উচ্চতাকে স্পর্শ করতে পারেন।
চারপাশে তাকালে কী দেখি? নানা রকম লেখায়, এমনকি গভীর প্রবন্ধের ভিতরও দু’এক পঙক্তি কবিতার উদ্ধৃতি! কেন জটিল প্রবন্ধেও কবিতার পঙ্ক্তি যুক্ত করার প্রয়োজন হয়? কারণ কবিতা অনেক সূক্ষ্ম, গভীর কথাকেও ধারণ করতে পারে যা গদ্যে সহজে সম্ভব হয় না। এরকম সূক্ষ্ম বোধ ও ভাবনা পাঠকের গভীরে গিয়ে সূক্ষ্ম অনুভবে অনুরণিত করতে পারে বলে। কবিতা তাই এখনও সূক্ষ্মতম শিল্পমাধ্যম। তাই কবিতাকে শুধু ছন্দ-মিলের রম্যতায় সীমাবদ্ধ না রেখে কবি তাকে কবিতার উচ্চতায় পৌঁছে দিতে চান কবিতার নানা গুণপনা কবিতা নির্মাণে যুক্ত করে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘বিষয়ের বাস্তবতা উপলব্ধি ছাড়া কাব্যের আর-একটা দিক আছে সে তার শিল্পকলা।’ কবিতার বিষয় হয়তো পাঠককে যথার্থ ভাবে সঠিক উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছে, পাঠক তাতে মুগ্ধ, কিন্তু এরকম ‘বিষয়’ ছাড়াও কবিতার যে আর একটি দিকের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সেই ‘শিল্পকলা’ বিষয়টি যে কী, তাই তো স্পষ্ট নয় বহুজনের কাছে। ‘শিল্পকলা’ বিষয়টি সম্পর্কে গভীর কোনো আলোচনা কোথাও প্রকাশিত হয়েছে কিনা তা জানা নেই। রবীন্দ্রনাথের এই কথাটিকে কি তাহলে গুণীজন সজ্ঞানে উপেক্ষা করলেন? জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কবিতার কথা’ বইটি শুরু করেছিলেন একটি বিস্ফোরক বাক্য দিয়ে –‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।’ কেন? জীবনানন্দ কি এতটাই ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছিলেন কিছু কিছু কবিতা পড়ে? নাকি অন্য কারণে? কবিদের কাছে কথাটা যেন বজ্রাঘাতের মতো। কবিতার আর একটি দিক –‘শিল্পকলা’-র দিক, সেই দিকটি উপেক্ষিত হতে দেখে কি ব্যথিত ছিলেন জীবনানন্দ? জানা যাবে না। তবে জীবনানন্দের শিল্পকলা সমৃদ্ধ কবিতা দেখে, তার পাশাপাশি অন্য অনেক কবিতাই আমাদেরও হতাশ করে। যথার্থ কবিতার কাছে পৌঁছতে কবি ও পাঠক উভয়কেই এই বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই গভীর ভাবে ভাবতে হবে।
কবিতা কেন রহস্যের আড়াল পছন্দ করে? কবিতা কি তাহলে নিজেই তার চারপাশে বৃত্তাকারে পরিখা খনন করে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চায়? একটি কবিতার ভিতরে কয়েকটি স্তর থাকে। উপরের স্তরের যে প্রাপ্তি, তাকেই অনেক সময় আমরা কেউ কেউ কবিতার সামগ্রিক প্রাপ্তি মনে করি। অথচ তা যেন হিমশৈ্লের মতো, যার সামান্য অংশ মাত্র জলের উপরে দৃশ্যমান, আর বেশি অংশই জলের গভীরে আমাদের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে থাকে। অনেক সময় এরকমই ঘটে এক একটা কবিতার ক্ষেত্রে। না-দেখা অংশ বা কবির না-বলা কথাকে তাহলে আমরা কী ভাবে পাবো? এই যে বলা হলো ‘কবির না-বলা কথা’, তা কবি না বললে কি কোনো দিনই আর জানা যাবে না? কবিতার যে জাদুর কথা বলা হয়, তা হলো – কবির রচিত কিছু সংকেত-চিহ্ন ও শব্দের ছদ্মবেশ, যা কবির নির্মাণে সুচিন্তিত ভাবে যুক্ত করেন কবি, কবিতারই শিল্পকলার প্রয়োজনে। তা থেকেই শব্দছক-এর মতো আমাদের কল্পনা ও সৃজনশীলতা নিয়ে সংকেত-চিহ্ন ও শব্দের ছদ্মবেশে সরিয়ে কবিতার আত্মার কাছে পৌঁছতে হয় আমাদের। এ খেলায় যে সংবেদী পাঠক একবার যুক্ত হয়ে যান তাঁর পক্ষে কবিতার এই অদ্ভূত জাদু ও তার সম্মোহন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া খুব কঠিন।
আসলে কবিতা যদি শুধু মাত্র সংবাদপত্রের মতো বার্তাবাহী হতো, তাহলে একবার পাঠ করার পরে তাকে বাসি কাগজের মতো সরিয়ে রাখা যেতো। ভালো কবিতা শুধুমাত্র বিষয় বা ছন্দ-মিলের রম্যতা নিয়ে নয়, এসব ছাড়াও কবিতা অমরত্ব পায় কাব্যরস ও নির্মাণের শিল্পকলার গুণে। না হলে ‘লক্ষ্মীর পাঁচালী’ শ্রেষ্ঠ কাব্য বলে আমাদের বইয়ের পাশে সগৌরবে স্থান পেতো। এসব কথা এলো এই জন্য যে, কবিতার ভিতরের
৩
জগৎ বা অন্দরমহল, তা নানা সম্পদ নিয়ে অনেক সময় পাঠকের কাছে দূর্ভেদ্য হয়ে থাকে, তা তো পাঠকের বোধেই জ্যোতির্ময় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে যা বলেছিলেন, তা যেন কোনো দেশে ও সময়ে ঘুঁচে যাওয়ার নয়, সে কথাটি হলো –‘সূক্ষ্মদৃষ্টি জিনিসটা যে রস আহরণ করে সেটা সকল সময় সার্বজনিক হয় না। সাহিত্যের এটাই হল অপরিহার্য দৈন্য।’ স্বাভাবিক কারণেই এমন হয়, বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে। কারণ কবিতাই সূক্ষতম প্রকাশ মাধ্যম। রবীন্দ্রনাথের ‘দৈন্য’ কথাটি আমাদের দীনতাকে স্পষ্ট করে। সূক্ষ্মতার ক্ষেত্রে এমনই ঘটে থাকে। তবু পাঠক হিসেবে আমাদের কাজ ক্রমে ক্রমে রস গ্রহণের যোগ্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করা।
বিদেশে পুরস্কৃত হওয়ার আগে ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটি দেশের প্রেক্ষাগৃহ থেকে মাত্র কয়েক দিন পরেই বিদায় নিয়েছিল, দর্শকের প্রত্যাখ্যানে। অথচ অনেক বানিজ্যিক চলচ্চিত্রই চলে বহু সপ্তাহ অতিক্রম করে! জনসাধারণের গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য তাহলে কি শিল্পীকে সাধারণের বোধগম্যতার সমতলে নেমে আসতে হবে? যে কঠোর সাধনার ফলে এই উচ্চতা অর্জন করেছেন শিল্পী, তা তো তাহলে অর্থহীন হয়ে যায়! সব শিল্পের মতো কবিতার ক্ষেত্রেও এই প্রশ্ন আমাদের ভাবিত করে। আমরা পাঠকরা বরং চেষ্টা করে, দ্রুত হেঁটে কবির সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারি। সেটাও তো একটা সাধনা, কঠোর সাধনা। কবিতায় বিষয়ের পাশাপাশি কবির নির্মাণের কলাকৌশল ও শিল্পকলার মুনশিয়ানা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কবি ও কবিতার উচ্চতা বোধগম্য হবে, আর তখনই কাব্যরস বা কবিতার যে অমৃত, তার সন্ধান পাবো আমরা।
আমাদের একথা মনে রাখা জরুরি যে, কবিতাকে সরিয়ে রেখে যে সুখী গৃহকোন, তা সভ্য মানুষের কাছে নিশ্চয় সুখের নয়, বরং লজ্জার। কাব্য সুধার জন্য, কবিতার অধরা মাধুরীর জন্য অন্ধকারে বোধের আলো ফেলে, আসুন আমরা কবিতার তীর্থে যাত্রা শুরু করি।
০০০