( bangle kabita.com-এর কয়েকজন পাঠকের ভালো লেগেছিল আমার কবিতাবিষয়ক আলোচনা । তারা এখানে এরকম আরও কিছু আলোচনা দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। আমার ‘কবিতার শিল্পকলা’ ও ‘কবিতার অন্দরমহল’ বই দুটিতে প্রকাশিত আলোচনা এখানে দেওয়া যাবে না বলে এখানে অগ্রন্থিত কিছু লেখা দেবো যদি তা আপনাদের ভালো লাগে। হয়তো তাতে আমার একই রকম ভাবনা বার বার সহ্য করতে হবে আপনাদের, কারণ নানা পত্রিকার নতুন নতুন এমন পাঠকের কথা ভেবে লেখা যারা আমার লেখা আগে পড়েননি। )
কবিতার চেনা ও অচেনা দিক
রমেন আচার্য
‘কবিতা কী?’
ছোট্ট একটা প্রশ্ন। এতো দিন লেখালেখি করার পরেও প্রশ্নটা শুনে চুপ করে থাকতে হল কিছুক্ষণ। না, আগে নিজেকে তো এ প্রশ্ন করিনি কখনো! ভিতর থেকে আসা একটা ধারণা নিয়েই তো কবিতা লেখার শুরু। নানা সময়ে গুণীজনদের মুখে শোনা কথাটা বলতে হলো তাকে – ‘কবিতার কোনো সংজ্ঞা হয় না।’
কবিতা কীঃ অন্ধের হস্তিদর্শণ
এই কথাটাই একমাত্র ঢাল যার আড়ালে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়। অথচ জানি, কবিতার এত রকমের সংজ্ঞা হয় যে তা থেকে মাত্র একটি তুলে ধরে কবিতার সংজ্ঞা বলে চালানো যায় না। এ যেন অন্ধের হস্তিদর্শন – যে এসে হাতির পা ধরেছে, তার কাছে হাতি থামের মতো, আর যে শুধু কান ধরেছে, তার কাছে হাতি ঠিক কুলোর মতো --- ইত্যাদি ইত্যাদি। সকল দৃষ্টিহীনের দেখাকে যদি পর পর জোড়া দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো তার অবয়ব কিছুটা অন্তত অনুমান করার চেষ্টা করা যেতো। কবিতা আসলে কী – এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়া আমার অন্যায় হয়েছে। ‘কবিতা’ শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে যার মুখে সে তো একশো জনের মধ্যে মাত্র একজন স্বতন্ত্র বোধের মানুষ! তাঁকে অবজ্ঞা করা আমার উচিত হয়নি। আজ এই প্রবন্ধের সূচনা সেই অনুতাপবোধের কারণে।
কবিতা কী – এ প্রশ্নে কেন নির্বাক ছিলাম, স্পস্ট বুঝিনি বলে? হঠাৎ মনে হল কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তো খুব কম কথা বলেননি ! সেই কথাগুলির উপর নিজের বোধের আলো ফেলে দেখি না কবিতার স্বরূপ স্পস্ট হয় কিনা।
ছন্দোবদ্ধ সজ্জা
কবিতা কী – এটা বুঝতে গিয়ে কবিতার সঙ্গে সংলগ্ন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যে বিষয়গুলিকে টেনে আনা দরকার, তার মধ্যে বিতর্কিত বিষয় হলো ছন্দমিল-এর প্রসঙ্গ । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – ‘এখন তর্কের বিষয় এই যে, কাব্যের স্বরূপ ছন্দোবদ্ধ সজ্জার ’পরে একান্ত নির্ভর করে কি না। কেউ মনে করেন করে, আমি মনে করি করে না।’
কবিতাকে চিনে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই বুঝে নিতে হয় নির্ভুল ছন্দ-মিলে লিখলেই তাকে আমরা কবিতা বলবো কিনা। ছন্দ ও অন্ত্যমিলের দক্ষতা তো কবির একটা গুণ, তার রম্যতায় স্মরণযোগ্য হয়ে মনে স্থায়ী হয়ে থাকে কবিতার পঙ্ক্তি। তবু মাত্র সেই জন্যই তা কবিতা নয়। কবিতার প্রকৃত সম্পদ তার কাব্যরস। কাব্যরসহীন রচনা পদ্য মাত্র, যেন বিগ্রহহীন কারুকার্যশোভিত শূন্য মন্দিরের মতো। কবিতার ভাব অনুযায়ী কবি মোহমুক্ত হয়ে ছন্দ অথবা ছন্দহীনতাকে বেছে নেন। একদা আমাদের বিভ্রম ঘটিয়েছিল বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গদ্য রচনা, যাকে লাইন ভেঙে কবিতার মতো করে সংকলনে স্থান দিয়েছিলেন সম্পাদক। কেন? কারণ তা ছিল কাব্যরসের গুণে আদতে কবিতাই। ছন্দ-মিলে কিছু লেখা হলেই তা কবিতা – একথা এখনো বহু মানুষ মনে করেন বলে তাঁদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য দিয়েই এই প্রসঙ্গ শেষ করা ভাল। রবীন্দ্রনাথ বলেন –
‘ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা
আছে রসে, ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় তার আনুষাঙ্গিক হয়ে।’
সেকালের সঙ্গে একালের যোগসূত্র ঘটাতে এসময়ের বিশিষ্ট কবি মণীন্দ্র
গুপ্তের লেখার একটি অংশ তুলে দেওয়া যাক –
‘কবিতায় গদ্য ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। উনি বলেছেন, কবিতার বাহন হিসেবে পদ্য অপেক্ষা গদ্যই বোধ করি বেশি উপযোগী। আমি সর্বান্তকরণে বঙ্কিমচন্দ্রের সমর্থক। ভবিষ্যতের অধিকাংশ কবিতাই লেখা হবে গদ্যে।’
এরপর তো কবিদের সতর্ক থাকার পালা। কেউ যাতে বলতে না পারেন – ‘ছন্দ-মিলে ঢাকছো দুর্বলতা’ ।
কাব্যরসঃ দেহ নয়, আত্মা
রবীন্দ্রনাথ বার বার কাব্যরসের কথা বলেছেন খুব স্বাভাবিক কারণেই। কারণ কাব্যের নির্যাসই কাব্যরস। কাব্যরস ছাড়া কবিতা প্রাণহীন শরীর মাত্র। কবিতার ভিতর থেকে উঠে আসা এই কাব্যরস এমন এক অপার্থিব আস্বাদন যা ব্যাখ্যা করা কঠিন। একমাত্র রসিক হৃদয় তার সুকুমার বোধে কাব্যরসকে শনাক্ত করে তৃপ্তি লাভ করে থাকে।
কল্পনাঃ মিথ্যের সৌন্দর্য
কবিতার সম্রাজ্ঞী বলে যদি কাউকে ভাবা হয়, তাহলে তা কল্পনা। কবিতায় এই উচ্চাসন তারই প্রাপ্য। কল্পনা হল যা নেই বা যা নয় তারই সৃজন। অর্থাৎ মিথ্যে। অথচ এই মিথ্যেই হলো কবিতার জাদুদণ্ড। অত্যন্ত দ্রূতগামী অশ্বকেও পরাজিত ও তুচ্ছ করতে পারে যা, তা হলো কল্পনায় আঁকা পক্ষীরাজ ঘোড়া। মনে হয় এই মিথ্যের সৌন্দর্যের জন্যই রোবট-সভ্যতার মুখোমুখি হয়েও কবিতা জ্যোতির্ময় হয়ে থাকবে। কল্পনার সম্মোহন এমনই যে তা পাঠকের মনোজগতকে অতি সংবেদী করে তোলে, আর তখনই খসে পরে তার বিজ্ঞানমনস্কতা বা বাস্তবতার শৃঙ্খল। সহসা সে দুটি ডানার অস্তিত্ব অনুভব করে নিজের মধ্যে – কল্পনার ডানা, যা কবিতার সঙ্গী হয়ে কবিতাকে করে তোলে বাঁধাবন্ধহীন, সর্বত্রগামী। অগম্য শৃঙ্গে কবিতার বিজয় পতাকা স্থাপন করে আসে কল্পনা। কবির দেখায় তাই সত্য হয়ে ওঠে –
‘ তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে
যেন আমায় স্মরণ করে ।’
যতই মিথ্যে হোক, তবু কল্পনায় কি অপরূপ হয়ে উঠেছে ভাবনা ! অনেক বিখ্যাত পঙ্ক্তিই এই মিথ্যের ঐশ্বর্যে সজ্জিত হয়ে সুন্দর। কিন্তু কী দেয় এই কল্পনা ? দেয় কবিতার বিস্তার, মনের আরোগ্য, জীর্ণ কবিতার শরীরে আনে যৌবনের দীপ্তি। কল্পনাকে যতই মিথ্যে বলে হেয় করা হোক, তার অলীক বা রূপকথার জগৎ পাঠককে নান্দনিক আনন্দ দেয়।
মানবরসঃ জড়ের বুকে ইচ্ছে বপন
অবোধ শৈশব ও রূপকথার জগৎ যখন অভিন্ন মনে হয়, তখন আমরা মিথ্যেকে নিন্দে করি না, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই এমন এক জাদুতে, যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –‘মানবরস’। জীবজন্তু, প্রাণী-অপ্রাণী বা জড় বস্তু ইত্যাদির মধ্যে ‘মানবরস’ যুক্ত করলেই যেন মানুষের মতই অবিকল বোধসম্পন্ন হয়ে ওঠে তারা! ফলে কবি তখন আর নিজের মুখে নিজের কথা না বলেও তাদের দিয়ে নিজের ও অন্যদের কথা বলাতে ভালবাসেন। যেমন – ‘পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ।’ পর্বতের মতো প্রাণহীন নিরেট পাথর কি কথা বা ইচ্ছেকে প্রকাশ করতে পারে ? অথচ ‘মানবরস’ যুক্ত হয়ে পাথর আমাদের বদ্ধ অসহায় জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করলো কত সুন্দর ভাবে ! একথা হয়তো কবির মুখে শুনলে এমন অসাধারণ হয়ে উঠতো না।
শব্দঃ কবিতার সম্রাট
শব্দ হল চাবি, যা দিয়ে খোলা যায় কবিতার সম্পদ ভাণ্ডার। আবার শব্দবীজও বলা
যায় তাকে। কারণ মহীরুহ হওয়ার শক্তি ও সম্ভাবনা সঞ্চিত থাকে ছোট্ট ওই বীজের গর্ভে। কল্পনা সম্রাজ্ঞী হলে শব্দই ওই সাম্রাজ্যের সম্রাট। কেউ বলেন – শব্দই কবিতা। এত সব কথা, এত বন্দনা নিবেদিত হয় শব্দের বেদীতে, কারণ প্রকৃতপক্ষে তার কাছেই ব্রক্ষ্মাস্ত্র প্রার্থনা করেন কবি, অর্থাৎ চান এমন সব অমোঘ শব্দ, যা দিয়ে গভীর ভাবনাকে প্রকাশ করা সম্ভব।
অনেক সময় পাঠক কবিতাকে শব্দ ও বাক্যে রচিত একটি দেয়াল মনে করেন, দুর্ভেদ্য মনে করেন তাকে। তখন যদি এক একটা শব্দকে জানালা ভেবে তার পাল্লা খুলে দেখতে চাই তার ভেতরের সম্পদ, তাহলে কবিতার অন্তরমহল স্পস্ট হতে পারে। তাই শব্দ নির্বাচন কবির কাছে খুব জরুরী, যাতে পাঠক ওই জানালা খোলার খেলা থেকে কবিতাপাঠের তৃপ্তি পান। এছাড়া কবি কৌশলে শব্দের আড়ালে যে না-বলা কথা গুঁজে দেন, তা আবিষ্কারের ভিতর দিয়েই পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠেন কবি ও তৎসহ কবিতা। এভাবেই পাঠক কবিতাপাঠের সময় নিজের সৃজনশীলতার গুণে যে সৃজনের স্বাদ আস্বাদন করেন তা যেন প্রায় কবিরই মতন।
জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি এখন আমাদের চোখের সামনে এসেছে। সেখানে দেখি একটি শব্দের কত রকম বিকল্প খোঁজার চেষ্টা হয়েছে ক্ষত-বিক্ষত পাণ্ডুলিপিতে! মনে হয় এভাবেই – কবির অতৃপ্তি থেকেই – আহত ও রক্তাক্ত হতে হতে ক্রমশঃ সুন্দর হয়ে উঠেছে কবিতা।
প্রসারণ গুণঃ বীজ থেকে উদ্ভিদ
কবিতায় প্রতিটি পঙ্ক্তিই যেন আক্ষরিক অর্থের অতিরিক্ত কথা বহন করে থাকে। তার এক পঙ্ক্তির ভাবনা গদ্যে ওই কয়েকটা শব্দের সীমায় বদ্ধ না থেকে যেন বহু
লাইনে ছড়িয়ে প্রসারিত হতে চায়। এই প্রসারণ গুণ কবিতার একটা বড় সম্পদ। যে কবিতায় আক্ষরিক অর্থের অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা নেই, সে কবিতা বন্ধ্যা। একটা শুকনো ছোলা, যার শরীরে প্রায় ধাতবকাঠিন্য, অথচ ভিজে নমণীয় হলে বিকশিত হয়ে ডানা মেলে ডাল ও পাতায় প্রসারিত হতে পারে সেই ছোট্ট বীজ। কবির সুনির্বাচিত শব্দে ও কবিতায় থাকে এরকমই প্রসারণ গুণ। এই প্রসারণ ঘটে পাঠকেরও মনে তার নিজের কল্পনা ও সৃজনশীলতার গুণে।এই কল্পনা ও সৃজনশীলতার নির্যাসে বীজের মতোই ডানা মেলে সে। এই তৃপ্তিই বার বার পাঠককে রহস্যময় কবিতার কাছে নিয়ে যায়।
কবিতার শিল্পকলা
গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, চিত্রশিল্প বা কবিতা কোনো ক্ষেত্রেই বিষয় গুণে তার উচ্চতা বা শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় না। যদি তাই হতো তাহলে জনসাধারণের হৃদয় উদ্বেলিত করে এমন আবেগযুক্ত বিষয় নিয়েই সৃস্টিকর্ম চলতে থাকতো জনপ্রিয় হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। ব্যবসা বা আর্থিক প্রয়োজনে এমন প্রবনতা দেখা গেলেও এখনো সূক্ষ্ম ও গভীর সৃজনকর্মে অনেকে যুক্ত আছেন বলেই সৃজনক্ষেত্র অপবিত্র হয়ে যায়নি।
অন্যান্য সৃজনক্ষেত্র ছেড়ে শুধু কবিতার প্রসঙ্গে এসে দেখি তার বিচিত্র সব বিষয়ের মধ্যেও মনোহর হয়ে ওঠার বাসনায় কবিতার সূক্ষ্মতা অবহেলিত হচ্ছে। কাব্য সমালোচনার ক্ষেত্রেও দেখি, কবি কী বলছেন তার কথা ও দৃষ্টান্তই বেশি। কিন্তু কী ভাবে কবি তা বলছেন, সেই শিল্পকলা উপেক্ষিত। যেন কবিতাটি দাঁড়িয়ে আছে শুধু তার ভাব ও বক্তব্যের জোরে। যদি কবির নির্মাণশিল্পের কৌশল ও দক্ষতাকে তুলে ধরে আলোচনা হয় তাহলে নিশ্চয় কবিতার জগতে ‘শিল্পকলা’ ক্রমশঃ সমাদৃত হবে।
কবিতা কী – এটা না বোঝার কারণেই কি এই বিচ্যুতি? রবীন্দ্রনাথের সতর্কবাণী
তো বহু আগেই ( সম্ভবত তখন কবির চারপাশে এরকম কবিতার প্রাবল্য দেখে ) উচ্চারিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই তো আমরা দেখেছি দুরকম রবীন্দ্রনাথকে। যে রবীন্দ্রনাথ কবিতায় অভাবিত উচ্চতা দিতে গিয়ে বিশিষ্টজনের কাছেও বহুবার
নিন্দিত হয়েছিলেন, আর অন্য এক রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের উচ্চতা থেকে পাঠকের
বোধগম্যতার সমতলে নেমে এসে শিশু, কিশোর ও সাধারণ মানুষের জন্য কবিতা
লিখেছেন। আমরা তো প্রায়ই এই দুই রবীন্দ্রনাথকে মিশিয়ে ফেলি। অথচ এরকম ঘটেনি জীবনানন্দের ক্ষেত্রে। কারণ বাক্সবন্দি অহঙ্কার ও অবমাননা অন্ধকারেই ফেলে রেখে গেছেন কবি। এখনো কি দুই কবিকে আমরা যথার্থ ভাবে চিনেছি?
রবীন্দ্রনাথ কবিতার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ অথচ উপেক্ষিত দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন –
‘বিষয়ের বাস্তবতা উপলব্ধি ছাড়া কাব্যের আর একটা দিক
আছে সে তার শিল্পকলা।’
হয়তো কথাগুলি সকলের কাছে স্পষ্ট হয়নি। কথাগুলির উপর একবার চোখ বুলিয়ে পাঠক সরে যেতে চাইলে তার পথরোধ করে দাঁড়ায় ‘শিল্পকলা’ শব্দটি। আমরা তো জানি যে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যম, যেমন সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদির মধ্যে সেই মাধ্যমের নিজস্ব শিল্পকলাই যুক্ত হয়ে থাকে, তাকে আঙুল তুলে চিহ্নিত করা কঠিন। কবিতার বিষয় উপলব্ধি করে তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাঠক যেমন তৃপ্তি পান তেমনি কবির নির্মাণে যে শিল্পীসুলভ মুন্সিয়ানা কবি কবিতায় যুক্ত করেন তার নৈপুণ্য দীক্ষিত পাঠককে মুগ্ধ করে। তখন তাঁরা কবিতার আঙ্গিকে শিল্পকলার প্রয়োগ-সাফল্যে তৃপ্তি পেতে চান। দেখা যাক কবিতার ক্ষেত্রে আমাদের বোধ কী ভাবে শিল্পকলাকে চিনে নেয়।
বচনাতীতঃ অধরা মাধুরী
আমরা যে ভাষায় পরস্পর বার্তা বিনিময় করি, অথবা গল্প উপন্যাসে যে ভাষা দেখা যায়, তার চেয়ে ভিন্ন ভাষা থাকে কবিতায়। কারণ কবিতাকে সাধারণত গভীর ভাব ধারণ করতে হয় খুব অল্প পরিসরে। এই গভীর ভাব যখন গভীরতর বা সূক্ষ্ম থেকে
সূক্ষ্মতর হতে থাকে তখন কবিতার পক্ষেও তাকে ধারণ করা হয়ে ওঠে সাধ্যাতীত। এই সাধ্যাতীত ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘ভাষাতীত’ বা ‘বচনাতীত’। ভাষাতীত বা বচনাতীত কথাটা কবিতার সামনে একটা বড় চ্যলেঞ্জ। কবিতার দর্প চূর্ণ করতেই যেন এই অধরা মেঘনাদের মতো মেঘের আড়াল থেকে কবিতাকে দুয়ো দিয়ে চলেছে! রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – ‘যা আমাকে বচনাতীতের আস্বাদ দেয় তা গদ্য বা
পদ্যরূপেই আসুক তাকে কাব্য ব’লে গ্রহণ করতে পরাঙ্মুখ হব না।’
বচনাতীতের প্রকাশসাফল্য কি এতই, যা গদ্য ও পদ্যের সীমান্ত সহজেই ভেঙে দিতে পারে ! বচনাতীতের প্রকাশ সাফল্য হল কবিতার উচ্চতম শৃঙ্গ স্পর্শ করার মতোই অসাধারণ সাফল্য। আমরা হারানো জিনিস খুঁজি কী ভাবে? হারানো জিনিসের একটা আকৃতি আগে থেকেই চোখে নিয়ে তাকে খুঁজি, তাতে খুঁজে পেতে সুবিধে হয় বলে। শব্দের ভিতর ছবি দেখতে চাইলে চোখকে ছবির জন্যই সেভাবেই তৃষ্ণার্ত রাখতে হবে। এভাবেই যেন সংবেদী পাঠকের ভিন্ন এক যোগ্যতা অর্জন।
বচনাতীতকে উপেক্ষা করেই তো হাজার হাজার কবিতা লেখা চলছে ও আবৃত্তি মঞ্চে করতালিতে অভিনন্দিত হচ্ছে, তাহলে এই ‘বচনাতীত’ শব্দটা জনসমক্ষে টেনে এনে কবিকে বিব্রত করা কেন? সূক্ষ্মতম মাধ্যম বলে গর্বিত যে কবিতা, তার প্রসঙ্গে বচনাতীতের বিষয় এনেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। কারণ তিনি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সক্ষম বলে? যদি তাই হয়, তাহলে তিনি কী ভাবে প্রকাশ করেছেন এই ভাষাতীতকে? এবার আমরা তার সন্ধানে যেতে চাই।
চিত্ররূপময়তাঃ তাকিয়ে দেখার আনন্দ
ভাষাতীতকে প্রকাশ করা ভাষায় সম্ভব না হলে কবিতা তাকে কী ভাবে প্রকাশ করবে? কবিতার ব্রক্ষ্মাস্ত্র যে শব্দ, সেই শব্দ ছাড়া লক্ষ্যভেদে অমোঘ আর কী হতে পারে? রবীন্দ্রনাথ নিজে পথনির্দেশ করলেও আমরা তাকে উপেক্ষা করে চলেছি ! তিনি বলেছেন –
‘ ভাষার মধ্যে এই ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য সাহিত্য
প্রধানত ভাষার মধ্যে দুইটি জিনিস মিশাইয়া থাকে, চিত্র ও সংগীত।
কথায় যাহা বলা চলে না ছবির দ্বারা তাহা বলিতে হয়। সাহিত্যে এই
ছবি আঁকার সীমা নাই।’
নিজের লেখায় এই সাফল্য থেকেই রবীন্দ্রনাথ সহজে জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘চিত্ররূপময়’ বলে। শব্দে আঁকা যে ছবিকে বলি চিত্ররূপময় তার জাদুতেই বচনাতীত বিষয় পাঠকের মনশ্চক্ষে ফুটে উঠে ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’ দেয়। গান শুনে মুগ্ধতার কথা বলতে গিয়ে অনেকে বলেন – গানের কথার সঙ্গে দৃশ্যগুলিও যেন চোখের সামনে ভেসে চলে। কবি যখন বলেন – ‘চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা’ – তখন ‘বাঁকা’ শব্দটি অনেকের কাছে হাসির খোরাক হয়ে ওঠে। কারণ জল তো তরল, তাকে যে পাত্রে রাখা হবে, তার আকৃতি হবে সে রকম। তাহলে অকারণে তাকে বাঁকা বলা কেন? যিনি শব্দের দিকে তাকিয়ে ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’ পান, তিনি দেখবেন ‘বাঁকা জল’ বলতেই শরীরে বক্রতা নিয়ে চারপাশে চঞ্চল হয়ে উঠল ঢেঊ। কবিতার শরীরে এরকম দৃশ্যের সংযোজন কবিতাকে সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করে। ভাষা যখন শুধু মাত্র বার্তা বহন করে আর যখন
সেই ভাবনাকে ছবির মতোন চোখের সামনে মেলে ধরে – এই দুয়ের প্রাপ্তির মধ্যে বিপুল পার্থক্য ঘটে। আর তা ঘটে কবির নির্মাণের শিল্পকলায়। এমন সূক্ষ্ম কৌশলে তা ঘটে যে কবির এই কৃতিত্ব পাঠকের চোখ এড়িয়ে যায়।
অনুভবচিত্রঃ না-বলা বাণীর ঘন যামিনী
আমরা এবার বচনাতীতের আর এক দুরুহ দিক নিয়ে ভাববো, যা চিত্ররূপমতার মতোই আর এক চিত্র, যা সূক্ষ্ম পার্থক্য নিয়ে কিছুটা ভিন্ন। এরা যেন যমজ দুই সহোদরা। চিত্ররূপময়তার সহোদরাকে আমরা ‘অনুভবচিত্র’ বলতে চাই। অনুভব কী ভাবে চিত্র হতে পারে ! সে তো স্নায়ুর আঁধারে না-দেখা এক স্পন্দনের মতো দেহহীন অবয়বহীন। যে দেহহীন, সে কী করে চিত্রিত হবে? যার দেহ আছে তাকে চিত্রশিল্পী ও কবি দুভাবে চিত্রিত করেন – একজন রঙে, অন্যজন শব্দে। এটা বোঝা গেলেও দুর্ভেদ্য হয়ে রইলো অনুভবকে চিত্রিত করার প্রসঙ্গটি। আমরা বাংলা কবিতায় এরকম আশ্চর্য সব দৃষ্টান্ত দেখেছি, তবু তাকে অভিনন্দিত করতে পারিনি, অনুভবচিত্র দেখার চোখ ছিল না বলে। ‘নিস্তব্ধতা’ তো দেহহীন, তাহলে কী ভাবে দেখলাম – ‘--- উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা’-কে ? ‘কথা’ বা ‘নিমেষ’ - এর শরীর নেই, তবু অনুভবে মনশ্চক্ষে তো ফুটে উঠতে দেখলাম অমর এক অনুভবচিত্র –
‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চির চঞ্চল গতি।’
দেহহীনকে তো ছবিতে আঁকা যায় না, কিন্তু কবি তাকে যেন অনুভবের তুলিতে এঁকে জাদুবলে মনশ্চক্ষে ফুটিয়ে তুললেন ! আমরা যদি কবির এই শব্দের জাদুবিদ্যার
অসম্ভব নৈপুণ্যকে অনুভব না করে, তারিফ না করে শুধু পঙ্ক্তিগুলির উপর চোখ বুলিয়ে চলে যাই, তাহলে পাঠক হিসেবে কি অপরাধী হব না ? ‘অনুভবচিত্র’ শব্দটি কবিতার জগতে এমন এক আলোড়নহীন সংযোজন যা নিশ্চিত ভাবে কবি ও কবিতাকে সমৃদ্ধ করবে।
রহস্যময়তাঃ অবগুন্ঠন খোলো
কবিতার শব্দকে জানালা বলা হয়েছে, জানালা খোলার কৌশল জানা থাকলে কবিতার অন্দরমহলের সম্পদ দেখা সম্ভব – এ কথাটা রহস্যময় কবিতার ক্ষেত্রে ঠিক নয়। তাহলে কি অদ্ভূত রহস্যময় কুয়াশার আড়াল থাকে বলে কি তাকে প্রত্যাখ্যান করবো ? হতে পারে কবিতাটি বন্ধ্যা, অথবা আমাদের অজ্ঞানতায় বন্ধ্যা মনে হচ্ছে তাকে। হয়তো ওই রহস্যময় আড়াল সরালেই তার সম্পদ আবিষ্কৃত হতে পারে। কবি যেন গুপ্তধনের সাংকেতিক নকশা লুকিয়ে রাখেন শব্দের ভাঁজে, পাঠক নিজের যোগ্যতায় খুঁজে পাবেন বলে। রহস্যময় কবিতার আকর্ষণ তাই এত বেশি।
তাছাড়া কবিতার বিষয় যদি হয় সূক্ষ্ম ও গভীর স্তরের ভাবনা বা অনুভব, তাহলে স্বাভাবিক কারণেই তা সহজ সরলভাবে প্রকাশ্যে আসে না। জটিলতার আবরণ সরে গেলেই তার ঐশ্বর্য উন্মোচিত হবে – এই বিশ্বাসে পাঠক বার বার সেই কবিতার কাছে যান। বাস্তববোধ দিয়ে যদি তার দরজা খোলা না যায়, তাহলে কল্পনার চোখে অদৃশ্যকে দেখতে চান পাঠক। এভাবেই রহস্যময় দরজার চাবি নির্মিত হয় পাঠকের কল্পনায় ও সৃজনশীলতায়। ফলে এক একজন এক এক রকম ভাবে কবিতার না-বোঝা অবয়ব সৃজন করে তৃপ্তি পান। অংকের মতো কবিতার একই উত্তর হয় না। কারণ কবিতা তখন আর একা কবির নয়, তাতে যুক্ত হয় পাঠকেরও সৃজন। বোধের বহুরূপী আলোয় নানা মুহূর্তে তার বর্ণ বদল করে পাঠককে অবাক করে দেয় কবিতা।
কবিতা কী – এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এসে কবিতার গুণপনার দীর্ঘ তালিকা তৈরীর কাজে যুক্ত হয়ে গেলাম। হস্তিদর্শনের মতো চেনা ও অচেনা কিছু খণ্ড অংশ জড়ো করার চেষ্টা হল। কোনো একটি কবিতার মধ্যে এত সব গুণ একসঙ্গে থাকা
কি সম্ভব? কবিতাকে চিনতে এসে আমরা প্রথমেই সরিয়ে রেখেছি কবিতার ভাব ও বিষয়কে। কবিতার যে দিকটা উপেক্ষিত হয়ে আছে, সেই শিল্পকলাকে চিনতে এসে শিল্পকলার সহায়ক বিষয়গুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। কোনো বিশেষ ছাঁচে বা রসায়নে শিল্পকলা তৈরী হয় না। মুহূর্তে মুহূর্তে তার রঙ বদল হয় শিল্পীর হাতে। শুধু মাত্র পাঠকের সচেতনতা ও তৃষ্ণা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষায় এই আলোচনা।
কবিতা কী – তার অনুসন্ধান হয়তো অন্য ভাবে অন্য প্রান্ত থেকেও শুরু হতে পারে, ভিন্ন একটা পথ ভিন্ন কোনো কথা শোনাতে পারে আমাদের। বোধের লাঙলে মনোভূমি কর্ষণে উর্বরতা বৃদ্ধি পায়, তাই চাষ-আবাদ করলে সোনার ফসল পাওয়া সম্ভব। কবিতার কাছে আমাদের প্রত্যাশা বৃদ্ধির পাশাপাশি কি কবিতার উচ্চতা বৃদ্ধিরও সম্ভাবনা থাকে? কবিতার শিল্পকলার নানা গুণপনার জন্যই হয়তো পদ্য থেকে কবিতাকে উচ্চতর আসনে বসাতে পারবো আমরা। আমরা অন্তত এই আশাই করবো।
আলোচনায় যেখানে এসে পথের নানা জটিল জটে বিভ্রান্ত মনে হয়, তখনই হাত পাতি রবীন্দ্রনাথের কাছে, তাই এই আলোচনায় বহুবার উচ্চারিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কবিতাকে নিয়ে ভাববার যদি উৎসাহ ও অবসর থাকে তাহলে কি আগামীতে নানা ভাবনা যুক্ত হবে কবিতায়, খুলে যাবে অচেনা আরও দিক? তখনো কি আধুনিক ও অপরিহার্য হয়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ? নাকি কবিতাবিচ্ছিন্ন শিক্ষিত সমাজের অবসর গিলে খাবে বিনোদন ও সিরিয়ালের বিশাল হাঁ মুখ ?
....................................................................
‘প্রতীতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত