কবিতাকে যে ভাবে খুঁজেছি
রমেন আচার্য

কবিতা কী – এই প্রশ্নের উত্তর না পেলে সারা জীবনের কাব্যচর্চা লক্ষ্যহীন ও ব্যর্থ হয়ে যায়। কবিতা কী – এই প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের নিজের বোধেই তৈরী হতে থাকে, নাকি এই প্রশ্নকে উপেক্ষা করে আমাদের কাব্যচর্চা চলে? কবিতাকে যে ভাবে খুঁজেছি তা বলতে এসে জানাই যে, কবিতাকে চিনতে গিয়ে নিজের ভিতরেই জেগেছিল কবিতা নিয়ে নানা রকম সংশয় ও জিজ্ঞাসা, আর তার সন্ধান করতে এসে কিছু প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি। সেইসব বিষয়গুলো যদি সামনে আনা যায়, তবে তাকে ফিরে দেখার মধ্য দিয়ে কবিতাকে চেনা ও কবিতাভাবনা গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি বোঝা যাবে।
জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতার কথা’ বইটি শুরু হয়েছে একটি বিস্ফোরক বাক্য দিয়ে – ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি।’ কবিতা লিখতে লিখতে হঠাৎ এই কথাটির ধাক্কায় থেমে যায় আমার কলম! যে কবিতা বিষয়ের গুণে, ছন্দ-মিলের রম্যতায় কবি ও তার পাঠকবন্ধুরা মুগ্ধ, সেই কবিকেও কি আজ কবি হয়ে ওঠার পরীক্ষা দিতে হবে? অল্প বয়সে পড়েছিলাম একটি কথা, যা প্রায় এরকম –‘যে বাক্যবন্ধ থেকে নিতান্ত আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই লভ্য নয়, তা কাব্য বলে গণ্য হতে পারে না।’
তার অর্থ কি এই যে, কবিতার প্রায় প্রতিটি পঙ্‌ক্তির গভীরে থাকবে এমন ভাবনার বীজ, যা ওই কথাটির আক্ষরিক অর্থকে অতিক্রম করে প্রসারিত ও বিকশিত হবে! এমন প্রসারণ গুণের জন্যই  কি কবিতার  এতো অহংকার? আমি জীবনানন্দের ওই  বিস্ফোরক বাক্যটিরও উত্তর খুঁজেতে চেয়েছি। খুঁজেছি রবীন্দ্রনাথের এই কথাটির মধ্যে –‘বিষয়ের বাস্তবতা উপলব্ধি ছাড়া কাব্যের আর-একটি দিক আছে সে তার শিল্পকলা।’ কথাটির অর্থ হয়তো এই যে, কোনো একটি কবিতার বিষয় আমাদের আলোড়িত ও মুগ্ধ করতে পারে, তার কথা বা বক্তব্য অনেক সময় স্মরণযোগ্য বাণীও  হয়ে  ওঠে,  কিন্তু  সেই  কবিতারও  যে  আর-একটি দিক  থাকে,   সেই  ‘শিল্পকলা’-র  দিকটি  উপেক্ষিত হলে  সে  লেখাটি  কবিতার  উচ্চতা অর্জন  করে না। ক্রমশ  জেনেছি যে, কবিতা উচ্চতা অর্জন করে কবিতারই অমোঘ সম্পদে আর তার আঙ্গিকের সাফল্যে ও শিল্পকলার গুণে।
রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ও পরবর্তী বিশিষ্ট কবিদের মধ্যে দিয়ে কবিতার যে সূক্ষ্ম ও গভীর ধারাটি প্রবাহিত হয়ে চলেছে, বর্তমানে তা যেন দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বিপরীত দুটি দিকে প্রবাহিত। তার একটি বেগবান ধারা গেছে আলোকিত মঞ্চের দিকে, যেখানে একবার কবিতা শুনেই আলোড়িত হয়ে শ্রোতারা করতালিতে অভিনন্দিত করেন কবিকে। আবার বিপরীতমুখী অন্য যে ধারা, সেই ধারার কিছু কবি কবিতার সূক্ষ্ম ও ভাষাতীত অনুভবকে  শব্দবন্ধনে  ধারণ  করার কঠিন এক তপস্যায় নির্জনে মগ্ন! অথচ এই কবিরাও জানেন যে এরকম কবিতার পাঠক সর্বকালে ও সর্বদেশে খুবই নগণ্য। কবিতাজগতের এরকম নানা বিষয়, নানা চিন্তার তরঙ্গ ও তার বিভ্রান্তির মধ্যে থেকেও কবিকে নিজের কাব্যবোধ ও পথকে বেছে নিতে হয়। ভাবতে হয় মঞ্চসফল কবিতা লিখতে গিয়ে কবিতার ক্ষতি হচ্ছে কিনা।
কবিতার তূণে আছে লক্ষ্যভেদী নানা রকমের আয়ুধ। কবিতা লিখতে এসে সেই সব সম্পদ, যা আমরা সহজে চিনেছি, তা নিয়ে এখানে আর আলোচনা নয়। বরং যে সম্পদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা খুব বেশী, তাদের কথা বলতে এসে বলি – শব্দ তো আসলে শব্দবীজ, বীজ থেকে বৃক্ষ হয়ে প্রসারিত হওয়ার যে শক্তি থাকে এক একটি সুনির্বাচিত শব্দের ভিতর, তা কবিতাকে সমৃদ্ধ করে। শব্দ তখন আর আক্ষরিক অর্থে সীমাবদ্ধ থাকে না, বহু বাক্যে প্রসারিত হয়ে যায়। এই শব্দ যদি হয় কবিতার সম্রাট, তাহলে ‘কল্পনা’ তার সম্রাজ্ঞী। যে কবি মাটির কাছাকাছি থেকে জীবনযন্ত্রণা ও বাস্তবতাকে তীক্ষ্ণ ও অমোঘ করতে চান কবিতায়, তিনিও কল্পনার কাছে হাত পাতেন, কিন্তু কেন? কারণ জীবনযন্ত্রণাকে বা যে কোনও বিষয়কে আরও তীক্ষ্ণ ও তীব্র করার জাদুদণ্ড আছে কল্পনার হাতে। রূপকথা বা জাদুবাস্তবতার যে জগৎ গড়ে ওঠে কল্পনায়, পাঠক যখন তার সঙ্গে একাত্ম হতে চান, তখন আর পাঠকের বাস্তববোধ বা বিজ্ঞানমনস্কতা একাত্ম হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয় না। এরকম দৃষ্টান্ত বিখ্যাত কবিদের লেখাতেই আছে।
যে সব সম্পদে জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে কবিতা তা কবিতা চর্চা করতে করতে জানা হয়ে যায়, কিন্তু যে সম্পদের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে তার অলৌকিক জাদু নিয়ে আজ পর্যন্ত গভীর ভাবে আলোচনা হল না, সেই ‘চিত্ররূপময়তা’-কে চেনাবেন কে? শব্দটি রবীন্দ্রনাথের বানানো শব্দ, তাই অভিধানে খুঁজে পাই না বলে উপেক্ষিত হয়ে থাকবে কবিতার এই লাজুক সম্পদ? যে অনুভব ভাষাতীত, ‘স্নায়ুর আঁধারে’ স্পন্দিত হয় মাত্র, কবি তাকে পাঠকের মনশ্চক্ষে ছবি বা অনুভবের ছবি হয়ে ফুটে ওঠে যে জাদুতে, তার নামই ‘চিত্ররূপময়তা’। ফলে ‘নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে’ এমন অনুভব মনশ্চক্ষে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। কবিতা পত্রিকায় ‘মৃত্যুর আগে’ নামক এই কবিতাটি ‘কবিতা’ পত্রিকায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে লিখেছিলেন – ‘জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে।’ চিত্ররূপময়  কবিতার ভিতরে এমন দৃশ্য দেখার আনন্দই ‘তাকিয়ে দেখার আনন্দ’। জীবনানন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যায়ন নিয়ে বিশেষ আলোচনা ও চর্চা হয়নি বলে কবিতার খুব বড় এক সম্পদ চোখের আড়ালে থেকে গেছে। অথচ কবিতায় ভাষাতীত অনুভব, যাকে বলা হয় ‘অধরা মাধুরী’, তাকে কবিতায় প্রকাশ করাই তো কবিতার সর্বোচ্চ সাফল্য ও প্রায়  অলৌকিক এক প্রাপ্তি বলে জানি। তাই চিত্রশিল্পের শিক্ষা নিয়েও আমি কবিতার এই জাদুবিদ্যায় মগ্ন থাকতে চেয়েছি ।
কবি অনেক সময় প্রাণী অপ্রাণী জড়বস্তুর মধ্যে স্থাপন করেন তার আত্মাকে, আর এভাবেই তাদের মুখ দিয়ে নিজের ভাবনা  বলিয়ে  নেন। পরাবাস্তবতার  হাত  ধরে  কবিতা  যখন জড়ের হৃৎস্পন্দন স্পষ্ট করে তোলেন,  তখন  মনে হয় এযেন আর এক জাদুবিদ্যা। উপেক্ষিত যে কবি, তিনি যদি পদদলিত ধূলিকণার মুখ দিয়ে তার উপেক্ষা ও যন্ত্রণার কথা বলেন তাহলে তা বেশী সত্য ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এরকম নানা ছদ্মবেশে কবির নানা অনুভব প্রকাশ করার এই খেলা আমারও খুব প্রিয়।
সময়ের নানা তরঙ্গ এসে যখন কবিকে আঘাত করে, হাওয়া-মোরগের মতো কবির মনও তখন জ্যোৎস্না-ভেজা রজনীগন্ধা থেকে হঠাৎ ছিট্‌কে পড়ে রক্তপাতের দৃশ্যে। এভাবেই আপন হতে বাহির হয়ে কবিকে দাঁড়াতে হয় সময়ের মুখোমুখী। রহস্যময় কবিতার আয়ু বেশী এই ধারণায় ইচ্ছে করে কবিতাকে জটিল করা নয়, কবিতাকে  চিত্ররূপময় ও  অনুভবচিত্র  করে  বোধের কাছে পৌঁছে দেওয়ার  সাধনা করেছি।   যে  লেখা কিছু  রম্যতা ও তৃপ্তি  দিয়ে  তুবড়ির  মতো  একবার  আলো  ছড়িয়েই চিরকালের জন্য নিভে যায়, এমন স্বল্পায়ু নয় কবিতা।
কবিতার ভিতর ফেলে রাখা শূন্যতা বা শব্দ-সংকেত যেন পাঠককে আহ্বান করে তার রহস্যময় অন্দরমহলে। আর তখনই শব্দের সংকেতকে অনুসরণ করে কবিতার গভীরে গিয়ে শুরু হয় নিজের বোধ, কল্পনা ও সৃজনশীলতা নিয়ে পাঠকের সৃজন। কবিতার ভিতরে এমন এক বিচিত্র জগতের সন্ধান পেয়ে, তাকে ফেলে আমি আর মঞ্চসফল কবিতা রচনার সাধনা করিনি। জানি  
কবিতার সংজ্ঞা দেওয়ার মতোই কঠিন কবিতার কাব্যরস ও শিল্পকলাকে আঙুল তুলে চিহ্নিত করা। নিজের নান্দনিক বোধেই তা অনুরণিত  হতে  পারে।  কবিতার ভিতরে  যে কবির  না-বলা কথার বীজ বাক্যের মধ্যে লুকিয়ে রাখার কৌশল ও দক্ষতা, তা কবির একরকমের শিল্পকলা, এর ফলে কবিতার আকর্ষণ সহসা শেষ হয় না। এরকম কবিতা এমন এক সম্পদ, যাকে পাঠ করার পরেই বাসি কাগজের স্তূপে সরিয়ে রাখা যায় না। এসব নিয়েই আমার নির্মাণের শিল্পকলা। অল্প কিছু অংশ জলের উপরে ভাসমান, বাকি বিশাল অংশই থাকে জলের গভীরে চোখের  আড়ালে, সেই আড়ালকে দেখার তৃষ্ণা আমার কবিতার বাক্য সংবেদী পাঠকের বোধে স্পন্দিত হওয়ার তৃপ্তিই আমার পুরস্কার বলে ভাবি। যে কবিতা হিমশৈল বা আইসবার্গ-এর মতো, যার সামান্য শব্দের মধ্যে বপন করতে চাই। এতো সব চাওয়ার তালিকা দীর্ঘ, অথচ প্রাপ্তি থাকে নাগালের বাইরে। তবু এভাবেই রচিত আমার জৌলুসহীন আটপৌরে শব্দ ও বাক্য, যা পাঠকের হাতে কোনো একদিন  উন্মোচিত হবে বলে ফেলে রাখা। অল্প কথায় জটিল আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, শুধু বিষয়গুলো পাঠকের সামনে টেনে আনা হলো ভেবে দেখার জন্য। আমি মনে করি কবিতার সর্বোচ্চ সাফল্য  হলো  সূক্ষ্ম ও  ভাষাতীত  যে অনুভব, তাকে শব্দ-বন্ধনে প্রকাশ করার সাফল্য। এজন্যই কবিতা এখনও সূক্ষ্মতম শিল্পমাধ্যম। উচ্চতা ও সাফল্য নিয়ে বাংলাকবিতা একদিন বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে – এই স্বপ্নই দেখি।



( কেদারনাথ সম্পাদিত ‘ইচ্ছেকুসুম’ পত্রিকায় প্রকাশিত)