দিন টা ১২ ই মার্চ,
দুটি ছেলে ও মেয়ে মুখোমুখী;
পড়ন্ত বিকেলে কনে দেখা আলো,
দু'জনের চারটি চোখে সমান্তরাল দৃষ্টি ।
২১ শে মার্চ,ছেলেটির মোবাইলে রিং টোন বাজছে -
"আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে"-
অন্য প্রান্তে,- 'আমি সুবর্ণা বলছি '।
হ্যা৺ নমস্কার বলুন হঠাৎ কি মনে করে ?
-কেন , বিরক্ত হচ্ছেন; যদি বলেন -
- না না আপনি বলুন, বলুন আপনি।
কি হলো, কিছু বলছেন না যে ?
আপনি জানেন, আমার বাবা - মা,
দাদা - দিদি, ভাইপো - ভাইঝি
বন্ধু - পরিজন, সকলেই আছেন।
তবে তারা সারা দিনে একটি বার ও
কেউ ফোন করে না, কখনো।
কেউ জানতে চায় না, কেমন আছি আমি ?
আমি কি করছি, খেয়েছি কি খাইনি,
ঠিক সময়ে স্নান করেছি কিনা ;
ঘুমানোর সময় বিছানা, ঝাড়া হয়েছে কি না -
মশারীর ধার গুলো, গোঁজা হয়েছে তো ,
দরজায় খিল দিয়েছি তো ?
এক নিঃশ্বাসে এতো সব বলার পর ছেলেটি বলে -
দেখুন তো, কোথায় আপনার কথা শুনব
তা না করে, নিজেই বকে চলেছি ।
মেয়ে টি বলে-
আজ থেকে আমি কিন্তু, জানতে চাইব সব ।
৩১ শে মে, মেয়েটির মোবাইল বাজছে,
রিসিভ করল চেপে,- হ্যালো করতেই -
ও প্রান্তে- ছেলেটি বলে-
আমি শঙ্খদীপ বলছি, আপনি কি ব্যস্ত ,
একটু কথা বলতে পারি ?
স্বাগ্রহে মেয়েটি বলে- ঠিক আছে বলুন।
কি হলো, কিছু বলছেন না যে !
ছেলেটি বলে - ভীষণ আপনাকে মনে পড়ছিল তাই।
- ও শুধুমাত্র তাই জন্য ফোন করলেন ?
তা আমার কথা এতো দেরি করে মনে আসলো?
- না না, আপনার কথা সব সময় মনে হয় ।
- আপনি মিথ্যে বলছেন, তা কখন মনে পড়ে?
- কখন আবার, এই ধরুন না-
যখন ভালো কিছু খাই ।
মেয়ে টি বলে -
ও শুধু ভালো কিছু খেলেই-
আমার কথা ভাবেন !
ছেলেটি লজ্জায় আর কথা খুঁজে পায়না।
১৩ ই জুন, ছেলেটির অনুরোধে ,
'বনগা'-র ত্রিকোণ পার্কে রবীন্দ্র মূর্তির পাদদেশে -
এক সন্ধ্যায় মিলিত হয় তারা।
কত সেকেন্ড কত মিনিট;
এমন কি, দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা কাটলো!
দুজনে দাঁড়িয়ে আছে -
কারও মুখে কোন কথা নেই।
পৌরসভার নিয়ন বাতির আলোর সাথে,
পূর্ণিমার আলোক ছটায়, দুটি মুখ আজ রঙিন।
হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে, মেয়েটি বলে-
কিছু বলবেন না ?
- এর পরও কিছু বলতে হবে !
দুটি বুকে যেন ঝড় উঠলো সেদিন।
১৫ ই জুলাই, শঙ্খদীপ ফোনে বলে-
জানতো সুবর্ণা, কাল সারারাত ,
তুমি আমার কাছে ছিলে ।
মাপ করবেন, তুমি বলে ফেললাম।
সুবর্ণা বলে - আবার মাপ চাওয়া কেন ?
আপনার মুখে তুমি থাক আমার খুব পছন্দ।
তবে, কাল সারারাত আমি কিন্তু ঘুমিয়েছি।
শঙ্খদীপ বলে- সত্যি বলছি;
কাল সারারাত আমার প্রথম কবিতা সংকলন,
'ইছামতির চোখে জল ' পড়েছি ।
তখন তুমি তো আমার পাশেই ছিলে ,
সকল কবিতার শিরোনামে ছিলে তুমি,
সকল কবিতার ছন্দে ও ছিলে তুমি ;
এমন কি অন্তরা তেও তুমি ছিলে ।
সুবর্ণা বলে - আপনি কবিতা লেখেন,
তা আমাকে আগে কখনো বলেননি তো ?
- শুধু কবিতা নয়, প্রবন্ধ, ছোট গল্প উপন্যাস;
যখন যা মনে চায়, তাই লিখি।
সুবর্ণা বলে,আপনার কবিতা শুনবো,বলুন শোনাবেন
শঙ্খদীপ বলে- শোনাতে পারি, যদি --
- যদি কি ?
- যদি আমাকে, আপনি টা - তুমি করে দাও।
১৬ ই আগষ্ট, রাত ১১টা ১৫,
বাইরে মুসলধারে বৃষ্টি পড়ছে ,
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে;
মেঘের গুড় গুড় শব্দে,
সমস্ত আকাশ মুখরিত হচ্ছে,
ছেলেটি ঘুমাতে যাবেন; এমন সময় -
মোবাইল বেজে উঠল, অন্য প্রান্তে সুবর্ণা বলে -
এখন তোমার কবিতা শুনবো।
শঙ্খদীপ বলে-আমি শুধুই লিখি, আবৃত্তি জানিনা।
তাছাড়া যা , কর্কশ গলা আমার!
- হেয়ালি না করে, কবিতা বলো
আমাকে আশাহত করোনা।
শঙ্খদীপ 'ইছামতির চোখে জল ' এর
একটির পর একটি কবিতা পড়ে চলেছে -
ও দিকে সুবর্ণা, অবাক বিস্ময়ে নিরব !
কবিতা পড়া শেষ হয়নি তখনো;
সুবর্ণার দু'চোখ দিয়ে জল পড়ছে অবিরত !
যেন এক অন্য ইছামতী, বহিছে তার চোখে।
পর সুবর্ণা তার বান্ধবীকে
এতো সব বলে একে একে।
সব শুনে বান্ধবী বলে- কবিতা, উপন্যাস?
এই কম্পিউটার যুগে বেমানান অর্থহীন,
তাতে ভাত জোটে না;
আজকের এই দ্রুতগতির পৃথিবীতে, অর্থ না থাকলে
প্রতিষ্ঠা না পেলে, জীবনটাই মুল্যহীন ।
সে আরো পরামর্শ দেয় , ও সব ভুলে না ;
এত সুন্দর দেখতে তোর , শিক্ষিতা -
তুই কেন জীবনটা বিষর্জণ দিবি !
তার চেয়ে আমার দাদার কথা ভাব ,
বড়ো অফিসে চাকরি করে, মোটা অংকের বেতন --
১৯ শে অক্টোবর, আবার দেখা করে তারা
সেই ত্রিকোণ পার্কে দা৺ড়িয়ে সুবর্ণা বলে -
জানো শঙ্খ, তোমার কবিতা গুলো খুবই সুন্দর
কিন্তু আমার বান্ধবী বলছিল -
সাহিত্য কর্মের কোনো ভবিষ্যৎ নেই ;
তুমি বরং চাকরির চেষ্টা করো ,
লেখা-লেখির ভুত মাথা থেকে ছাড়ো ।
সুবর্ণার কথায়, ভীষণ আঘাত পায় শঙ্খ
মুখে বলে- চলো আজ যাওয়া যাক ।
২২ শে অক্টোবর, কঠিন অসুখে পড়ে শঙ্খদীপ,
তার অসুখের কথা জানায় নি সুবর্ণা কে ।
তবু বাতাসে ভেসে ভেসে
দুঃসংবাদটি পৌঁছে যায় সুবর্ণার কাছে ;
এক মুহুর্ত দেরি না করে চলে আসে সে ।
বিছানায় শুয়ে থাকা শঙ্খদীপ কে দেখে -
অস্থির হয়ে সুবর্ণা বলে, কী হয়েছে তোমার?
- তেমন কিছু নয়,
রাত জেগে পড়াশোনা আর লেখা-লেখি করি বলে
সামান্য জ্বর হয়েছে।
ডাক্তার বলেছে ভাইরাস সংক্রমণ ;
অল্প কিছু অসুধ আর বিশ্রাম নিলেই
সব ঠিক হয়ে যাবে। আর -
রক্ত টা পরীক্ষা করার কথা বলেছে ।
সুবর্ণা শঙ্খদীপের পাশে বসে বলে-
তোমার এত অসুখ, আমাকে বলো নি কেন ?
- এই বলা হয়নি আর কি ।
- আমাকে না তুমি ভালোবাসো।
তাহলে বলবে না কেন ?
- ভালোবাসি যখন, ভালো থাকার কথাই বলবো;
কষ্টের কথা কেন বলবো ?
সুবর্ণা বলে - আচ্ছা শঙ্খ
আমার কাছে তুমি কি চাও ?
- কী আবার, চাই না তো কিছু !
- ভালোই যদি ভালো , কিছু চাইবে না কেন ?
শঙ্খদীপ বলে- তোমার সাফল্য কামনা করি;
আর বড়ো হও তোমার নিজের পরিচয়ে ।
সুবর্ণা বলে - আমার একটা কথা রাখবে ?
- আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।
- তুমি লেখা-লেখি ছেড়ে দাও ;
শঙ্খদীপ বলে- লেখা-লেখি আমার জীবন
আমার বাঁচার সকল উপকরণ !
আমি তা ছাড়ি কি করে ?
সুবর্ণা বলে - তা না পারলে, আমাকে ছাড়তে হবে।
- তোমাকে ধরে রাখেনি তো কখনো !
পরদিন সকালেই সুবর্ণা শ্রাবণী কে বলে -
তোর দাদা কে বলে, আমার ওই প্রস্তাবে মত আছে,
শঙ্খদীপ খুব একগুঁয়ে ,
আমার কোনো কথাই শোনে না।
এক মাস পর শঙ্খদীপের -
রক্তের রিপোর্ট এলো নেগেটিভ !
রক্ত জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত,
সে রোগ আর সারবার নয় ।
প্রায় তিন মাস পর, ১৪ ই ফেব্রুয়ারি -
জ্যোৎস্না আলোকিত রাতে, শুভক্ষণে - শুভ লগ্নে ;
শুভ বিবাহ শু-সম্পন্ন হলো সুবর্ণার ।
সেই রাতে ১১ টা ৪৫ মিনিট এ
অনন্ত শয্যায় শায়িত হলো শঙ্খদীপ !
পরদিন সকালে বিচিত্র ফুলে সজ্জিত গাড়িতে
শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে
সুবর্ণা যখন শশুর আলয়এ যাচ্ছে ;
শঙ্খদীপ তখন চিতার আগুনে দাহ হচ্ছে।
গাড়ির কাঁচ এর ভেতর থেকে, সুবর্ণা দেখলো-
চিতা হতে অগ্নি শিখা আকাশে উড়ে যাচ্ছে।
গত রাতে অনুষ্ঠান বাড়ির
নিমন্ত্রিত অভ্যাগতদের হাসি উল্লাসে,
সানাইয়ের সুর মূর্ছনায় অনুরিতা সুবর্ণা -
জানতে ও পারেনি, ওই অগ্নি শিখার রথে চড়ে
শঙ্খদীপ না ফেরার দেশে পাড়ি দিচ্ছে।
বিবাহ কার্য আদি শেষ হয়েছে প্রায় তিন মাস,
সুবর্ণা এখন আর মেয়ে নয় ; গৃহবধূ-
সুখের দাম্পত্য জীবনে এক স্বর্ণালী সন্ধ্যায়;
নবদম্পতি অনুষ্ঠান দেখছে দূর দর্শনে -
এবছরের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার বিতরণ
এবং সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, ডি ডি বাংলা -
সরাসরি সম্প্রচার।
সঞ্চালক একটি ডায়েরি পড়ে শোনাচ্ছে -
" আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে
এবছর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারে
ভূষিত করা হয়েছে আমাকে।
আমি কৃতজ্ঞ সেই পাঠক বর্গের কাছে,
সেই সব গুনি ব্যক্তি মহোদয়ের নিকট ;
যারা আমার লেখা মন দিয়ে পড়েছেন ,
হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন,
যাদের জন্য আজ আমার এই মহান স্বীকৃতি।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে -
আমি যদি উপস্থিত থাকতে না পারি ;
কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো,
তাঁরা যেন পুরস্কারের অর্থ ও স্মারক
আমার সুবর্ণার কাছে পাঠিয়ে দেয় ।
'সুবর্ণা' কে ভালোবেসে দিতে পারেনি কিছুই !
তবে ক্ষমা করবেন,
সুবর্ণার ঠিকানা আমার জানা নেই।
নমস্কার অন্তে- শঙ্খদীপ।
ডায়েরি পড়া শেষ হলে -
সঞ্চালক ঘোষণা করছেন ;
এবছর মরণোত্তর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার
পাচ্ছেন - শঙ্খদীপ দাশগুপ্ত, তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি -
'ইছামতির চোখে জল '- কবিতা সংকলনের জন্য।
বইটি তিনি উৎসর্গ করে গেছেন -
তাঁর বেঁচে থাকার উপকরণ 'সুবর্ণা'কে।
সঞ্চালকের ঘোষণা শুনতে শুনতে -
মনে পড়ে সুবর্ণার, শঙ্খদীপ তাকে বলেছিলো ;
তাঁর বেঁচে থাকার উপকরণ লেখালেখি।
তবে সেদিন সে কেন মিথ্যে বলেছিলো তাকে !
এখন সে বোঝে, আসল সত্যটা -
জানার চেষ্টা করেনি সে কোন দিন;
আসল সত্যটা কেউ জানালো না
কেউ কেউই, জানবে না কোনো দিন !
---------