মায়া অ্যাঞ্জেলোউ প্রধানত একজন সাহিত্যিক যিনি বিখ্যাত হয়েছেন মূলত জীবনীকার হিসেবে। সাতটি আত্মজীবনী লিখে তিনি রীতিমত তোলাপাড় করেন সাহিত্যাঙ্গন। এই জীবনীগুলোতে তিনি তার শৈশব আর যৌবনের প্রথম দিককার সময়টা তুলে এনেছেন।
জীবনী ছাড়াও তিনি লিখেছেন তিনটি রচনামূলক বই আর বেশ কয়েকটি কবিতার বই। এছাড়া তিনি অনেকগুলো নাটক, সিনেমা ও টেলিভিশন স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সাহিত্যিক পরিচয়ের বাইরেও তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, প্রযোজক, পরিচালক, স্ক্রিপ্ট লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী। তিনি আজীবন সমতা, সহনশীলতা ও শান্তির জন্য সংগ্রাম করে গেছেন।
এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক দামী পুরস্কারের পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন প্রায় পঞ্চাশটি সম্মানজনক খেতাব।
কিন্তু এই মহান আর সফল নারীর জীবন মোটেই মসৃণ ছিল না। কবি ও সাহিত্যিক হয়ে ওঠার আগে তাকে প্রায় সব ধরনের পেশার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে যা জানলে শিউরে উঠতে হয়। প্রথম জীবন ও জীবনের উঠতি সময়গুলোতে তিনি ছিলেন একজন বাবুর্চি, নাইটক্লাবের নর্তকী, সাংবাদিক ও অপেরা কর্মী। এমনকি তাকে গণিকাবৃত্তিও করতে হয়েছে সমাজে টিকে থাকার লড়াইয়ে জেতার জন্য।
আফ্রো-আমেরিকান এই মহান নারীর জন্ম মিশৌরির সেন্ট লুই-এ ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল। ৮৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান ২৮ মে ২০১৪ সালে।
নিচের সাক্ষাতকারটি প্রকাশিত হয়েছে প্যারিস রিভিউ-এ। সাক্ষাতটি গ্রহণ করেছেন জর্জ প্লিমটন। সাক্ষাতকারটিতে লেখালেখির বাইরেও মায়া অ্যাঞ্জেলোউর জীবনের অন্যান্য নানান দিক উঠে এসেছে। সুদীর্ঘ সাক্ষাতকারটির শুধুমাত্র চুম্বক অংশ অনুবাদ করা হলো পাঠকদের জন্য।
প্লিমটন: কিভাবে বুঝতে পারেন যে এখনই আপনার লেখার সবচেয়ে ভালো সময়?
মায়া: আমি জানি কোন সময়টায় আমি সবচেয়ে ভালো লিখতে পারব। সেটা হয়তো সেরা লেখা নাও হতে পারে। এই একই লেখা অন্য কোন লেখক হয়তো আরো বেশি ভালো লিখবে। কিন্তু আমার কাছে তখন সেটাই সেরা, আর সেরা মুহূর্ত। আমার জানা মতে সেরা লেখাগুলো হলো সেগুলো যখন একজন লেখক বলতে পারেন, “না, আর কিছু করার নেই। এপর্যন্তই।”
প্লিমটন: আপনার লেখায় রিভিশন কেমন থাকে?
মায়া: সাধারণত আমি সকালবেলায় লেখালেখি করি। দুপুরের দিকে বাসায় ফিরে গোসলটা সেরে নিই। কারণ, লেখালেখি খুব শক্ত একটা একটা কাজ। সেজন্য গোসলটাও হতে হয় ঝাক্কাস! তারপর আমি কেনাকাটা করতে বাইরে যাই। অনেকেই জানেন না- আমি কিন্তু খুব সিরিয়াস রাঁধুনি।...আমি আমার নিজের জন্য খাবার বানাই... তারপর থালাবাসন ধোয়ামোছার কাজ শেষ হলে আমি আমার সকালের লেখাগুলো নিয়ে বসি। আর প্রায়ই যেটা হয়, যদি নয় পৃষ্ঠা লিখি, শেষ পর্যন্ত সেটা আড়াই বা তিন পৃষ্ঠায় এসে ঠেকে। এরকম হলে আমার খারাপ লাগে, কষ্ট হয়। বুঝতে পারি, কাজ ভালো হয়নি। কিন্তু যখন ৫০ পৃষ্ঠা লিখে ৫০ পৃষ্ঠা-ই রাখতে পারি, তখন সত্যি খুব ভালো লাগে। আমার সম্পাদক আমার সাথে আছেন ১৯৬৭ থেকে।... মাঝেমাঝে তিনি হয়তো বলেন, এখানে কোলন না হয়ে সেমিকোলন হলে ভালো হয়। যদিও তখন রাগ হয় খুব, পরে আবার পড়ে বুঝতে পারি, সে-ই ঠিক। তখন তাকে জানিয়ে দিই।... কিন্তু আমি মনে করি, সম্পাদক সম্পাদনা করার আগে নিজের লেখা নিজেই সম্পাদনা করাটা সবচেয়ে বেশি দরকারী, বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্লিমটন: প্রতিটি বইয়ের জন্য আপনি কোন থিম ঠিক করে নিয়ে শুরু করেন?
মায়া: আমি যখন লিখি তখন আমি আমার জীবনের ফেলে আসা সময়টাকে মনে করার চেষ্টা করি। যেসব ঘটনায় নিষ্ঠুরতা, মায়া, হিংষা বা আনন্দ-উল্লাস থাকে সেসব থিমকে প্রভাবিত করে। তবে এসবের মধ্যে থেকে আমার চাহিদা বা উদ্দেশ্যের সাথে খাপ খায়, এ রকম একটা থিম নির্বাচন করি।
প্লিমটন: আপনি কি কোন নির্দিষ্ট একটা পাঠকগোষ্ঠিকে মাথায় রেখে লেখেন?
মায়া: একটা সময় আমি অবশ্য ভাবতাম, যদি আমি কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরীদের জন্য কিছু লিখতে পারতাম, তাহলে দেখাতাম কিভাবে সমাজে বেড়ে উঠতে হয়। কারণ তাদের জন্য লেখা বই খুব একটা বেশি নেই। তারপর আমি এই গ্রুপটাকে আরো একটু বড় করার কথা ভাবলাম- এই গ্রুপে ঢুকে গেল কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে, তারপর সাদা মেয়েরা, তারও পর সাদা ছেলেরা। কিন্তু সর্বোপরি আমি আমার লেখার ধরনটাকেই বেশি গুরুত্ব দিই। আমি আমার লেখা দিয়েই পাঠককে মুগ্ধ করতে চাই। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলে অবশ্য আমাকে পাঠকের কথাই ভাবতে হয়। কিন্তু এটা খুব কমই হয়।
প্লিমটন: আপনার জীবনের অসাধারণ বা অস্বাভাবিক কোন ঘটনা অন্য আর সবার জীবনের সাথে মিলানো কি খুব কঠিন একটা কাজ নয়?
মায়া: অসাধারণ! না, না, আমার জীবন খুবই সাধারণ। ১৩/১৪ বছর বয়সে যা কিছু ঘটেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু জানেন তো, বড় হওয়ার পথে সব মানুষকেই দুনিয়াকে কিছু দেনা শোধ করতে হয়। সেটা করতে না পারার কারণে অনেক মানুষ আর বড় হতে পারে না। বড় হওয়া খুব কঠিন একটা কাজ। আসলে যেটা ঘটে তা হলো, বেশির ভাগ মানুষের বয়স বাড়ে, তারা বুড়ো হয়। তাদের টাকা পয়সা হয়, তাদের অনেক বড় বাড়ি হয়, তারা বিয়ে করে, বাচ্চার জন্ম দেয়- কিন্তু বড় হয় না। সত্যিকার অর্থেই তারা বড় হয় না। কিন্তু বড় হতে হলে মূল্য দিতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। অর্থাত্, তুমি যে সময়টায় বাস কর, যে স্থানে বাস কর- সেসবের দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। এটা একটা সাংঘাতিক কঠিক কাজ। একটা সময় তুমি ঠিকই জানতে পারবে, ভালোবাসা পেতে বা হারাতেও অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু সাফল্য জিনিসটা আরো বেশি কিছু দাবি করে। আর এটা নিয়েই আমার লেখা। আমি যা লিখি, যা বলি, তা খুবই সাধারণ গল্প।
প্লিমটন: ...কখনও কি মনে হয়েছে যে কৃষ্ণাঙ্গ লেখক হিসেবে আপনি বড় কোন ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হচ্ছেন?
মায়া: হ্যাঁ। কিন্তু শুধুমাত্র লেখালেখির ক্ষেত্রেই নয়, আমি এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়েছি প্রায় প্রতিটি কাজে। আমেরিকার যে সমাজব্যবস্থা, তার সবচে উপরে আছে সাদা পুরুষ, তার নিচে সাদা নারী, তার নিচে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ আর সবার নিচের স্তরে আছে কৃষ্ণাঙ্গ নারী। আর এটাই সব সময়ের চিত্র। কিন্তু তার মানে আবার এ-ও নয় যে, আমি তাতে ভীত, দুর্বল...
প্লিমটন: সমাজব্যবস্থায় এই বিভেদ আছে জানি, কিন্তু সেটা কি শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও?
মায়া: দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হয়, হ্যাঁ আছে। জাতিগত বিভেদ সব ক্ষেত্রেই সমানভাবে বিরাজ করছে। সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন হোক কিংবা ব্যালে নৃত্যের স্টেজ- বিভাজনটা কিন্তু সর্বজনীন।... শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কিন্তু এই একই চিত্র। হলিউডের আমিই একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গী যে সুইডেনে গিয়েছিল সিনেমাটোগ্রাফির উপর কোর্স করতে।.... আমি সব সময় দেখে এসেছি আমার সাদা সহকর্মীর চাইতে আমাকে সবক্ষেত্রে দশগুণ বেশি দক্ষতা আর প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হয়েছে।
প্লিমটন: আপনার কাছে লেখালেখির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক কোনটি?
মায়া: আমার মনে হয়, কোন একটা লেখা শেষ করার মুহূর্তটুকুই আসলে একজন লেখকের কাছে সবচেয়ে আনন্দময়। কিন্তু আমার কাছে তা একটু আলাদা: যখন ভাষা নিজ থেকে আমার কাছে ধরা দেয়, নিজের সবটুকু আমার কাছে ধার দেয়, যখন তা আসে শুধুই আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে, আর বিনয়ের সাথে বলতে, আমি তোমার, শুধুই তোমার! ভাষার এই ধরা দেয়ার সময়টুকই হচ্ছে আমার লেখালেখির সবচেয়ে সুখকর মুহূত।
প্লিমটন: যখন আপনি লেখেন, তখন কোন কিছু কি ছেড়ে দেন না বা কোন একটা মনে এলো কিন্তু লেখার প্রয়োজন নেই, এমনটি হয়?
মায়া: না, লেখার সময় আমার মনে যা আসে, তা-ই লিখি। তখন কিছুই বাদ দিই না। কিন্তু আমি যখন রিভাইজ করি, কেবলমাত্র তখন কিছু বাদ দেয়ার প্রয়োজন হলে দিই। অবশ্য যদি আরো ভালো কোন সংশোধনী বা ভাষা আমার মনে আসে।
প্লিমটন: সবচেয়ে বেশি সময় বা শ্রম দেন কি লেখার সময় না যখন তা রিভাইজ করেন, তখন?
মায়া: কোন কোন লেখার গতি এতটাই সাবলীল থাকে যে, তার কোন বিরতির দরকার হয় না- হয়তো তিন দিনেই হয়ে গেল। লেখার সময়টায় একটা অনবদ্য গতি থাকে এবং তখন শুধু লিখে যাওয়া। অন্য সময়টায় (মানে রিভিশনে) একটু গতি কমিয়ে দিতে হয়। কারণ, তখন দৃষ্টি থাকে লেখার ভিতর থেকে তো, যদি, এবং, কিন্তু, তাহলে, এইহেতু টাইপের শব্দগুলো চেঞ্জ করা বা বাদ দেয়া। এই তো, এই আর কি!