নিস্তব্ধতা পেরিয়ে শীতের যে দিশাহারা হাত কুয়াশার চিবুক ছুঁয়ে গেছে দিগন্ত পর্যন্ত, আমার শুধু দুদণ্ড জিরিয়ে নেওয়া সেইসব ডাঙাভাঙা গল্পগুজবে। শিকড় সম্বিলিত বটগাছের নিচে বুকচাপা অন্ধকার এলোমেলো করে যে ধুলোমাখা কার্পেটের কাছে আসে তাকে রোজ পরিচয় করে নিতে হয় ক্লিষ্টখাঁড়ির স্রোতের সাথে। আপাতত সেই বয়ে যাওয়া থেকে সন্তরণটুকু শিখে নেওয়া পর্ণমোচী পাতাটা তোমার যাবতীয় অনুসঙ্গগুলোর জন্মদাগ নিয়ে চলেছে গ্রামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। অনবরত টানাপোড়েনের গায়ে আঙুল জাপ্টে ধরে শূন্যস্থানকে আমার পেন্ডেন্টের সর্বাঙ্গে রেখেছি আর চোখ না বুজিয়েও টের পাচ্ছি সাদাকালো ছবির মিশমিশে ঘাম। সমুদ্রের কাছাকাছি এসে একবার তাকিয়ে দেখো প্রাণপুরুষ - চোরাবালির মত বালি সরে যাচ্ছে তোমার লালগর্ত থেকে। তুমি আরো জড়িয়ে পড়ছ শালুকের নিচে নদীকে মনে রেখে। ফুলে ওঠা কোন দীর্ঘরাত পেঁচিয়ে উঠেছে বহুদূর...


যতটা এগিয়ে যাওয়া সকাল তুমি দেখিয়েছিলে তার থেকেও বেশি গভীর খাদ আমাকে টেনে ধরেছে। এসব জানাগুলো একে একে লাইন কেটে গড়িয়ে গেছে। তবু রেহাই মেলে না। কোন এক উৎসর্গ-মুহূর্তে ঝলসানো ঘেরাটোপের ভেতর থেকে দেখি নীলজলের মাঝ বরাবর যেখানে জানলা দরজার আগল তোলা। একের পিঠ ভারী হলেও লন্ঠনের আলো আর প্রাণিত করে না আমাদের। ধীরে ধীরে পাটাতন পেঁচিয়ে উঠেছে বিষযাপনে। এসব আজ কাল পরশুর কথা তুমি জানতে না?  এই যে নিস্পন্দ অন্ধকার ছিঁড়ে ধোঁয়াশা সকাল ফসকালে বেলা মৃতসমান হয়ে যাবে আর ব্যাপ্তির সম্বন্ধপদে কান্না জমবে বেলাবেলির হাত ধরে - এমন শব্দগুলোও কি একদিন নিভে যাবে ভুলো পরিবারের সদস্যপদ নিয়ে! আমি টের পাই রক্তের নিম্নচাপ থেকে ভেঙে যাচ্ছে মাটির সঙ্গে পায়ের সম্পর্কগুলো। আমার আর নামা হয় না কোন বন্যার জলে। ঘাস শিশিরের জল যেটুকু ধারণ করতে পারে তা চুঁয়ে খসে পড়ছে অনুভব। বিষণ্ণতার জেটিতে বড্ড ভিড় মানুষের। ভাঙা সেতুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে ভয়ের চিহ্ন আঁকছি - ম্লান শব্দের স্কেল চেঞ্জ করে গলা বাড়িয়ে দিচ্ছি সেইসব মানুষের কাছে। কোথাও কি জলের শব্দে গাছতলার ঘুম ভাঙবে - জানি না...


কোলাহলের পূর্বমুহূর্তে চোখ রেখে কতকাল ঘুম ভেঙেছে ঘাসফড়িঙের, ঢেউয়ের মাথায় মাথায় জলের ছোঁয়া লেগে অদৃশ্যভাবে উড়ে গেছে অন্ধকার। ঘরের কথায় লেপ ও উষ্ণতার পারস্পরিক সম্পর্ক বিনিময় এসে যায়। এসব কণ্ঠাগত করে দেয়ালগুলো শিশিরের চুপকথা ধরে রাখে। তাই বুনো আগাছার ডাকে এগিয়ে আসি গাছতলায়। কোনদিন গাছের ত্বকে হাত রেখে দেখেছি আমার দেহের ভেতর বয়ে যাওয়া নদীকে। একেকটা সকাল আর এই গাছতলা কতকালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে ছায়াদেহ নিয়ে।  রক্তের ভঙ্গিমা দেখে দেখে ভোররাতে জল এসে ভিজিয়ে যায় মাটি। আমি নিচু হলে ঘাসের ডগার বেলাবেলি সেজে ওঠা। তবু কুয়াশার থেকে টুপটাপ ঝরে পড়া জলবিন্দুর থেকে টের পাই বেগুনপোড়া স্বাদ আর স্ব-জল বাড়িয়ে দেয় জলীয় বুদবুদ। যদিও আমি বাষ্প চেয়েছি - অঞ্জলি দিয়েছি সময় - ফাঁকা হাতে আর কি দিতে পারতাম কুসুম ভ্যালিতে! তোমার ডানার তলা থেকে কোন আঙুল ডোবেনি গাঢ়ত্বে। গল্প বলার আগে মনে করো ভাঙাগুলো বড় শব্দময় ও জোড়বার প্রশ্নগুলো সনদপত্রে আবদ্ধ। আলোর পাখির ঝুঁটি ধরে আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে যেসব প্রশ্নপত্র তার চিরকালীন হতাশা নামকরণ - যার অপরপিঠে না পাওয়াগুলো আশঙ্কাজনিত ভয়কে টানে।  বস্তুত আমার কাছের জমিতে ঘুমগুলো কোন কাজ করে না - তাই একাংশ পেতে বসে থাকি ঘোলাজলে। ফিরে আসাকালীন হাত ভরেছে বৃষ্টিপাতে - আসলে খুব চেঁচিয়ে জানাতে চেয়েছিলাম আবির মাখার ইচ্ছাগুলো...এখন স্রোতহীন কালোজলে তানপুরা বাঁধি - বলা হয় না ক্ষয়ে আসা ধাপের নিচের ধাপগুলোর জীবনকাহিনী। তাই বিচ্ছেদ নিয়ে জমে ওঠা কথাগুলো রোজ টুকরো টুকরো করে পুঁতে রেখে আসি মাটিতে - একদিন উদ্ভিদ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কোনদিন কি তোমার কাছে উড়ে উড়ে পৌঁছে যাবে এমন উদ্ভিদের খসে যাওয়া পাতা?


সেদিন আমার মৃতশরীরের সংরক্ষণ প্রয়োজন হবে না। তবুও এখন মনে করে পার্শ্ববর্তী গাছের কাছে জমা রাখছি আমার একাঙ্ক রোমন্থন, নগ্ন নখদর্পনের সঞ্চালন থামিয়ে ছিটকে গেছে দিনযাপন...