এইতো সেদিন দু’দেশের সীমানার কাঁটাতারের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে দেখেছি কাছে এসেই দাঁড়ালো চার চাকার একটি ছোট গাড়ি, আর তার ভেতর থেকে মধ্যবয়সী এক যুবক থেকে নেমে পড়লো তড়িঘড়ি।
গাড়িতে তার বৃদ্ধ মা। বয়স মনে হয় শতবর্ষের দোরগোড়ায়, একা একা চলতে অপারগ বৃদ্ধা, বড়ো অসহায়।
সন্তানের হাত ধরে সন্তর্পনে গাড়ি থেকে নেমে বৃদ্ধা কয়েক পা হেঁটে সীমান্তের কাছে গিয়ে বসলেন।
সামনে কাঁটাতারের বেড়ার দু’ধারে দু’দেশের সশস্ত্র সীমান্তরক্ষীরা দিচ্ছে প্রহরা।
বুঝতে আদৌ কষ্ট হয়নি সেই বৃদ্ধা ও তার সন্তানের কথোপকথন শুনে বৃদ্ধার জন্মভিটে সীমান্তের ওপারে।
দেখেছি কাঁটাতারের বেড়ার দিকে চেয়ে বৃদ্ধা বুকে হাত রেখে শিশুর মতোই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বোধ হয় কেউ যেন ঠক ঠক করে কড়া নেড়েছে তাঁর মনের দুয়ারে।
বৃদ্ধা মাটিতে শুয়ে পড়ে কপাল ও ঠুকলেন বেশ জোরে জোরে। শুনেছি যুবকের মুখে বৃদ্ধা এই বয়সে এসে প্রায়শ বলেন, শৈশবে সেই যে জন্মভিটে ছেড়েছেন মা-বাবার হাত ধরে, সেই স্মৃতি তাঁকে সারাজীবন কুঁড়ে কুঁড়ে খেলেও কখনো আর যাননি ফিরে।’
জীবনের শেষ লগ্নে সেই স্মৃতি আবছা হলেও অনুভব করছেন ব্যাপক নাড়ির টান। দেখতে ইচ্ছা হয়েছে জন্মভিটে, তাঁর শৈশবের সেই বাসস্থান।
ইচ্ছা হয়েছে জন্মভূমির মাটি চুমে আবারো ফিরে আসতে। তবে দুর্ভাগ্যই বটে।
ইচ্ছাঘুড়ি বন বন করে উড়ে সীমান্তে এসেও এগিয়ে যেতে মানা। এখন জন্মভূমিতে যেতে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া সেদিকে মোটেও পা বাড়ানো যাবে না।
অসহায় বৃদ্ধা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সীমানার ওপারের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে কষ্ট হলো খুব। মনে হলো, হায় রে, কারোর এই অবস্থা হলে কে, সেই কষ্টের অনুভূতি রাখতে পারে ধরে।
এখন সেখানে যাওয়ার হলেই বিদেশ ভ্রমণ। লাগবেই পাসপোর্ট ও ভিসা, সেইসাথে বৃদ্ধ বয়সে বইতে হবেই শারীরিক ধকল।
সাধ থাকলেও সামর্থ্যের কথা ভেবেই বৃদ্ধা চোখ বন্ধ করে বোধ হয় দেখলেন সামনে দাঁড়িয়ে বৃন্দাচল।’
মনে মনে ভেবেছি সীমান্তে বসে বৃদ্ধা এই সময় ভাবছেন কি ‘কেউ তাঁর ইচ্ছায় জোর জবরদস্তি চালিয়ে দিয়েছে কাঁচি?
ভাবতে পারেন, ‘ দেশভাগের আগে ক’জন ভেবেছে দেশত্যাগ করবে যারাই স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে বিধির এই নিষ্ঠুর বিধান।
সূর্য ঢলে পড়ছে দিগন্তরেখায়। চারিদিক ঘিরে ফেলেছে আবছা অন্ধকারে। এই অবস্থা দেখে বলে উঠলো যুবক ‘মা, দেশভাগের যন্ত্রণা সহ্য করে এই সময় বোধ হয় ভিটে মাটি ছোঁয়া গেল না। বলবে, আছে কি আর সেই উপায়?’
দেখেছি বৃদ্ধা সেই কথায় কর্ণপাত না করে এক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন সীমান্তের ওপারের দিকে।