বই পর্যালোচনা-'মন বাতায়ন'
লেখক-অনিরুদ্ধ বুলবুল

কবিতার পাতায় আমরা সবাই কবি। দু’চার কথায় তরতরিয়ে লিখে যাই মনের কথা। কবিতার পাতায় পোস্ট দিয়ে কিছু বাহবা ও পাই। এখানকার লেখক-কবিদের মধ্যে গল্পকার বা প্রাবন্ধিকের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। আমাদের পরিচিত কবি - অনিরুদ্ধ বুলবুল প্রবন্ধ রচনায় এবং গল্প লিখায়ও যে সিদ্ধহস্ত তার প্রমাণ পাই তার গ্রল্পগ্রন্থ ‘নরকের ফোন-কল’ আর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘মন বাতায়ন’ পড়ে।বই দু’টি পড়ে এত তৃপ্তি পেয়েছি যে ‘মন বাতায়ন’ এই শিক্ষামূলক প্রবন্ধগ্রন্থটি নিয়ে পাঠক-বন্ধুদের সাথে দু’চার কথা শেয়ার করার লোভ থেকেই কিছু লিখতে বাধ্য হলাম।
একনিষ্ঠ মনযোগের সাথে কবির ‘মন বাতায়ন’ পড়ে দেখেছি- বইটি সত্যিই, জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনকে শিক্ষা দানের এক আদর্শিক গ্রন্থই বটে। আমার বিশ্বাস, জীবনের তাৎপর্য জেনে-বোঝে জীবনকে সাজাতে এই বইটি সকলেরই একবার পড়া উচিত। এটি ‘বাংলা-কবিতা ডটকমে’র নতুন উদ্যোগ - ‘অর্ক প্রকাশনী’র ১৭তম প্রকাশনা এবং কবির ৮ম একক প্রকাশনা।
আদর্শিক চেতনার শিক্ষামূলক রচনা সমৃদ্ধ এই বইটি যেকোন জ্ঞান অন্বেষণকারীর সংগ্রহেই রাখার মত। যেমনি এর ভাষা ও রচনাশৈলী তেমনি ভাব আর বিষয়বস্তু। খটোমটো গদ্যের রচনা হলেও পড়ায় আড়ষ্টতা নেই। লেখাগুলো শ্রুতিমধুর, প্রতিটি রচনাই কাব্যিক ছোঁয়ায় মন্দ্রিত।
দৃষ্টিনন্দন ঝকঝকে মলাটের ৫ ফর্মার এই বইটিতে মোট ১৮টি সুলিখিত প্রবন্ধ সত্যিই মনঃসমীক্ষামূলক, আদর্শিক চেতনার কথাই বলে। জীবন থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা আর কবির মেধা ও শ্রমে ঋদ্ধ গবেষণার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর ওই প্রবন্ধগুলো যথাক্রমে: “মন বাতায়ন, বিশ্বাস, সাফল্যের শিরমণি, শিষ্টাচার ও সৌজন্যতা, সমর্পণ, ধর্ম বনাম মনুষ্যত্ব, ডুবুচরে অস্থিত মন, পরিণতি, সফলতার ইঁদুর দৌড়, দুঃখ জয়ে স্বপ্ন সাধন, স্বপ্ন এবং বাস্তবতা, জীবন হাটের কেনা-বেচা, স্মৃতিময়তার নিগূঢ় আলাপন, মানবতার জয়ধ্বনি, পর্ণগ্রাফের ভয়াল থাবা..., রিলে রেসের কাঠি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং পিটুইটারির খেলা”।
এতবড় বইটির বিশাল সব অভিসন্দর্ভের সারমর্ম এত অল্প পরিসরে তুলে ধরা খুবই কঠিন কাজ। তাই আমরা বরং লেখকের মুখেই শুনি! যেমন নাতিদীর্ঘ ভূমিকার এক অংশে লেখক বলেছেন -
“আমার কাছে মনে হয়েছে; ভাবনার মন বাতায়নে যে কলির উন্মেষ ঘটে তা যদি সুকোমল পাপড়ি-দলে বিকশিত হয়ে এর সৌরভ আর সুধা-সুষমায় কানন ভরে দিতে পারে তবেই তা হয়ে উঠতে পারে যুগান্তরী ভাবনার কার্যকরী প্রয়াস! তবেই তা মানুষের কাজে আসতে পারে, সমাজ উপকৃত হয়! জীবন শুরুর দিকের আদর্শিক চেতনা আর বাস্তব জীবনে লব্ধ অভিজ্ঞতার সম্মিলনে যে মুক্তোরাজি আহরণ করেছি জীবনে তারই কিছু আলোকছটা, কস্তুরী গন্ধসম কিছু উপহার রেখে যেতে চাই চিন্তাশীল মানুষের জন্যে। সমাজবিজ্ঞানী, জ্ঞানী ও গুণীজনদের ওজনদার চিন্তায় আমার এইসব ক্ষুদ্র চিন্তাগুলো যদি সামান্যতম প্রভাবও রাখতে পারে - আমার লেখনী ধন্য হবে।”
বইটির উৎসর্গ পত্রে লেখক অত্যন্ত দামি কথায় পাঠককে অনেক ভাবনার খোরাক দিয়ে গেছেন ঠিক এইভাবে -
“জন্ম যাদের ধরিত্রীকে কিছু দেয়ার জন্য,
শুধুই পেয়ে খেয়ে ধরিত্রীকে উজাড় করা
কিংবা ভাগাড়ের বিস্তৃতি বাড়াবার জন্যে নয় -
সেইসব সংগ্রামী ও স্বপ্নবাদীদের লাখো সেলাম।”
প্রথম ফ্ল্যাপের শুভেচ্ছা বার্তায় বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক ড. তপন বাগচী বলেন -
“মন বাতায়ন - অর্থাৎ মন গবাক্ষ বা মনের জানালা! একটা চমৎকার প্রবন্ধগ্রন্থের নাম - এক ঝলক দেখেই বোঝা যায়, কিছু আদর্শিক ভাবনার সমাবেশ আছে বইটিতে... ভাবনার সমুদ্রেই তো মানুষের বাস। সারাক্ষণ মানুষ কিছু না কিছু ভাবেই... কিন্তু দেশ-সমাজের জন্যে ভাবতে পারে খুব কম জনই। একজন সমাজ সচেতন দেশপ্রেমিক হিসাবে প্রবন্ধকার দেশ তথা সমাজের হিতার্থে কিছু মৌলিক ভাবনা ভেবেছেন, তাঁকে সাধুবাদ জানাই।
ভিন্নধর্মী ও কল্যাণকামী ভাবনার ১৮টি মৌলিক রচনার সমন্বয়ে প্রবন্ধগ্রন্থটি রচনা করে লেখক একে ‘আদর্শিক চেতনার মনঃসমীক্ষামূলক রচনা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। আমার বিশ্বাস, মনঃসমীক্ষামূলক রচনাগুলো পড়ে পাঠক আপন বিবেক-বোধের সমীক্ষাটিও করে নিতে পারবেন। তাতে ব্যক্তি থেকে দেশ-সমাজ ও জাতি উপকৃত হতে পারে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগে যখন মানুষের বিবেক-চেতনায় নীরব অবক্ষয় চলছে, মানবতা ও মানুষিক বোধ বিপন্নপ্রায় তখন এই জাতীয় রচনা কিছুটা হলেও মানুষকে আলোর পথ দেখাবে বলেই মনে করি।”
সবশেষে লেখক বইটি শেষ করেন এই বলে -
“সবার উপরে মানুষ সত্য - এই দর্শনকে জীবনে গ্রহণ করে মুক্তবুদ্ধি নিয়ে কর্মে নিয়োজিত হতে পারলে সবার জন্যই পৃথিবীতে এই মানব জীবন আরো সুন্দর আরো শান্তিময় হতে পারে!”
লেখকের সাথে সুর মিলিয়ে আমরাও বলি - পৃথিবীতে এই মানব জীবন আরো সুন্দর আরো শান্তিময় হোক। প্রিয় প্রাবন্ধিকের দীর্ঘ সাহিত্য জীবন ও বইটির সফলতা কামনা করছি। লেখকের কাছ থেকে সুগঠিত ভাবনার আরো সমৃদ্ধ রচনা আশা করছি।