কর্তার ঘোড়া দেখে রাসসুন্দরী
উঠোনে ধানের রাশি খেয়ে যায় মহিমায় ঘোড়া
কর্তার ঘোড়ার সামনে কী করে বা যেতে পারে নারী
যদি দেখে ফেলে সেই ঘোড়ার ভিতরে অধিকারী
অবাধ আলোয় দেহ এক-উঠোন ধানের সন্তোষে?
আমি যে দেখিনি তাঁকে কখনো রৌদ্রের দুঃসাহসে!
স্তিমিত রাত্রির খাটে ঘনবর্ষা পিছল দর্শন—
জোনাকিকাঁটার খোঁপা,শেষ আলো ,তাও নির্বাপণ!
ঝিঁঝির অস্পষ্ট দেহ শব্দময় হবে কত আর
কোরা শাড়িটির সুখ আতরের লজ্জায় মরেছে ।
আলপনার গণ্ডিটানা সেই এক আড়-অন্ধকার
পালঙ্কে পরম শুয়ে , রুপোর জাতিটি রাঙাধুতি
প্রথম দিনের মতো শুধু এক ধূসর আকুতি
ঘোমটার মায়াবী সুতো ধ’রে যা রেখেছে পোড়াচোখ...
বকুলফুলেরা জানে , দেখনহাসিরা সব জানে
কখনো দেখিনিও তাঁকে হাওয়ার নির্ভীক অকল্যাণে
এমন স্বচ্ছন্দ আর অবাধ ঘোমটার পরপারে
নিলাজ নয়ন মেলে এক-উঠোনধানের সংসারে।
নষ্ট মধ্যাহ্ণের বেলা রাশি রাশি ধানে যায় ভেসে
কর্তার প্রতিভূ ঘোড়া আঙিনায় দুয়ার আটকিয়ে
দাঁড়িয়েছে তেরশো পাঁচের বাংলাদেশে ।
ইচ্ছে করেই কবির নাম প্রথমেই জানাচ্ছি না। পাঠককে একটু ভাববার অবকাশ দেওয়া আর কী। বলা যেতেই পারে ঃ ‘কীএমন হরিদাস তুমি ,যে, পাঠক ভাববে কী ভাববে না ; তাও তুমি বলে দেবে !’ হক কথা। এখন আর ভাবাভাবির বালাই নেই।সকলেই কবি এবং সকলেই বোদ্ধা। প্রচুর পত্র-পত্রিকা । যা খুশি লেখ আর পাঠিয়ে দেও। ঠিক কোথাও না কোথাও তা ছাপা হ’য়ে যাবে। এমনকি দল তৈরি ক রতে পারলে গুণমুগ্ধের সংখ্যাও তৈরি হ’য়ে যাওয়া সুনিশ্চিত।চাইকি এক-আধটা আকাদেমি-টেমিও জুটিয়ে ফেলাও অসম্ভব নয়। আর এসবের-ই যুগ চলছে এখন।কীরকম লেখা হ’লে বিখ্যাত হওয়া যায় তার হাতে গরম একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝান সহজ হয় তার-ইএকটা নমুনাঃ “এরা সব কবির দল। কিছু ঢ্যামনাও আছে এ-দলে।কিছু উদাসীন।নারীঘটিত কেস খাওয়া দু’এক পিস আছে......এই পাষণ্ড কবিগণ চলেছে--- আমি তাহাদের পিছুপিছু হাস্যরত,মায়াবাজারের আলুচ্চপ খেতে খেতে চলেছি । আকাশে চাঁদ উঠেছে ।যমুনার ধারের বটগাছে তখন ,ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীকে চুম্বনরত”এটি কিন্তু একজন সাম্প্রতিক বিখ্যাত কবির রচনা।এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে কিন্তু তা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বোঝাতে চাইছিলাম যে কবিতার ব্যকরণ,আঙ্গিক, ছন্দ,বিষয়বস্তুর গভীরতা ইত্যাদি বিষয় এখন গৌণ হয়ে গেছে। চিরকালের-ই কম কবিতার পাঠক ;এজন্য-ই কি আরো দূরে সরে গেছেন? হয়তো বা তাই।মনে পড়ে গেল এক দূর জেলাসদরের অতি তরুণ লায়েক কবি( !)চিৎকার ক’রে বলছিলেনঃ “মানে! আমরা যারা ছন্দ জানিনা তারা কী লিখতে পারব না!” আমি জানি না কে বা কারা তাকে বাঁধা দিয়েছিল , তবু সাম্প্রতিক সময়ের অধিকাংশের-ই মনোভাব এরকম-ই।পড়াশুনোর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই ভাষাকে আত্মস্থ ক’রার। আর পুর্বসুরীদের লেখা পড়ার তো কোনো প্রশ্ন-ই নেই। আছে অন্তর্জালের জনপ্রিয় আঙিনা। সুতরাং বোদ্ধা এখন সকলেই ! এই সব মেধাবী মানুষের ভিড়ে আমি মাত্র অতি মূর্খ এক কবিতা প্রয়াসী মাত্র। তাই খুঁজে চলি তাকে ।তার ছোঁয়া পেতে আমি ডুবে গেছি আকাশ –পাতাল। উপরের ঐ অনন্যসাধারণ কবিতাটি আশা করি ইতিমধ্যে সকলেই পড়ে নিয়েছেন। এই কবিতাটি ব্যাখ্যা করার মত কোনো ভাষাই আমার অধিকারে নেই। আমি শুধুমাত্র এক মুগ্ধ পাঠক। বুঁদ হ’য়ে আছি অসাধারণ চিত্রকল্পে। মেধাদীপ্ত অথচ সংযত । প্রথম লাইনটি থেকেই অসাধারণ উচ্চারণ; “উঠোনে ধানের রাশি খেয়ে যায় মহিমায় ঘোড়া” ঘোড়া এখানে কর্তৃত্বের প্রতীক । তাই সে দাপটে খেয়ে যাচ্ছে ধান। অবলা নারী কী করে বাধা দেয় তাকে? “কর্তার ঘোড়ার সামনে কী করে বা যেতে পারে নারী / যদি দেখে ফেলে সেই ঘোড়ার ভিতরে অধিকারী । লক্ষণীয় ; এখানে কর্তার ঘোড়া ,ঘোটকী নয়। অর্থাৎ পুরূষ ঘোড়া। সুতরাং সেও এই পুরূষশাসিত সমাজব্যবস্থায় সম্যক ভাবে বলীয়ান। উপরন্তু ঘোড়া হ’লেও সে অন্য এক পুরূষ। সুতরাং এক নারী কি করে যায় এই সমাজের সামনে, ‘অবাধ আলোয় দেহ’ নিয়ে “ এক –উঠোন ধানের সন্তোষে ” তাকে বাঁধা দিতে ! “অবাধ আলোয় দেহ এক-উঠোন ধানের সন্তোষে” কী অসাধারণ উচ্চারণ! নারীদের প্রতিনিধি কবি তারপরেই বলে উঠলেন ঃ “আমি যে দেখিনি তাকে কখনো রৌদ্রের দুঃসাহসে” –এক চিরন্তন নারীর আর্ত চিৎকার ---- শুধুমাত্র পুরুষের অঙ্কশায়িনী! দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাস ! না হলে কেন সে দেখতে পারে না “রৌদ্রের দুঃসাহসে”???
এত কষ্ট বুকে নিয়ে তারা স্বামীর সং সার করে। সোহাগে আনন্দ দেয় ,সে আনন্দে ডুবে থাকতে ভালবাসে। ভালবাসে “ঘোমটার মায়াবী সুতো ধরে যা রেখেছে পোড়াচোখ”সেই “আড় অন্ধকারের” সেইসব ছবি গুলো নিয়ে ‘নিলাজ নয়ন মেলে এক-উঠোন ধানের সংসারে ডুবে থাকতে। তবুও “নষ্ট মধ্যাহ্ণের বেলা রাশি রাশি ধানে যায় ভেসে” আর কর্তার প্রতিভূ ঘোড়া আঙিনায় দুয়ার আটকিয়ে / দাঁড়িয়েছে তেরশোপাঁচের বাংলাদেশে”। ১৩০৫ না হ’য়ে ১৪২১ বললেও ভুল হ’ত না। কেন না যতই আধুনিক হ ই না আমরা ,স্মার্ট হ’তে নেশা করি না কেন,ঐ চিত্রের বদল হয়নি এখনো। কামদুনি,বারাসাত ইত্যাদি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু এই কাব্যভাষা কি আমরা খুঁজে পাই এখন ? নিখুঁত ছন্দে লেখা ,এই অসাধারণ চিত্রকল্পময় অননুকরণীয় ভাষায় রচিত এই কবিতাটির সৃজন করেছেন গীতা চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিভৃতচারিণী এক অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু সংযত এক সাধিকা কবি।তাঁকে এই অতি সাধারণ কবিতাপ্রয়াসীর শত শত শতকোটি প্রণাম ।