বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬১তম জন্মজয়ন্তীতে বিশেষ নিবন্ধ....
(((২০২২,মে মাসের সময় পরিবর্তন ম্যাগাজিনে  প্রকাশিত)))

"রবীন্দ্রনাথ ও  এডওয়ার্ড জন টমসন :  এক বিতর্কিত বন্ধুত্ব
                                - প্রবীর দে

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে  প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী  পঞ্চদশ -ক খন্ডে গ্ৰন্থপরিচয়ে উল্লিখিত , বাণীবিনোদ বন্দোপাধ্যায়ের "রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে রেভারেন্ড টমসনের বহি" প্রবন্ধ বিষয়ে  প্রশান্ত মহলানবিশকে লেখা পত্রাংশে. রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন...
      "........ Thompson এর ব ইটা পড়ে দেখলুম। সেটা  superficial এবং অনেকটা পরিমানে অযথার্থ।"রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন:সেখানে , " ব ইয়ে Thompson অনেক  জায়গাতে খুব flippant এবংdogmatic ভাবে তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন---যাতে তাঁর অন্তর্নিহিত ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে।"
বুঝলাম বিশ্বকবি র এ মতামত  তাঁরই জীবনীকার এডওয়ার্ড টমসনের গ্ৰন্থ Rabindranath Tagore : His Life and Works (১৯২১) সম্বন্ধে। আর বলবেন নাই   বা  কেন .... যাকে তিনি বন্ধুত্বের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন প্রাণের টানে,অত্যন্ত আপনজন হিসেবে যার কাছ থেকে আসা  নিজের লেখা গল্পের অনুবাদের প্রস্তাবকে সাদরে গ্ৰহন করেছিলেন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে , যিনি কিনা রবীন্দ্র অনুসারী- হিসেবে রবীন্দ্র সাহিত্য চর্চার এক অক্লান্ত সৈনিক রূপে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন ও পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথের গুণকীর্তিকে উপস্থাপন করবার জন্য রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন .....সেই তিনি ই রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে  বলতে গিয়ে  নাকি  প্রমান করার চেষ্টা করেছিলেন যে রবীন্দ্র সাহিত্যে যে সারবস্তু আছে তা ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব জাত ,খৃষ্টধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা র ফল"।
মনে পড়ে গেল...আরে ইনিই   হলেন   রবীন্দ্রনাথের  সেই জীবনীকার ,  অধ্যাপক  এড ওয়ার্ড  টমসন, যিনি  কিনা   প্রথম ইউরোপীয় সাহিত্য রূচিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ এর রচনাকে  তুলে ধরেছিলেন  ইউরোপের সাহিত্য জিজ্ঞাসুদের কাছে ।যিনি  মনে করতেন  রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কীর্তি গুলির যথার্থ ইংরেজী অনুবাদ প্রয়োজন  নাহলে ইংরেজদের কাছে রবিঠাকুরের অসাধারণ শিল্পকর্মের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। হ্যা, তিনিই  এডওয়ার্ড টমসন, রবীন্দ্রনাথের বহু ছোটগল্পের অনুবাদক  , রবীন্দ্র  গবেষক এবং রবীন্দ্রনাথের  বিতর্কিত সেই  বন্ধু যিনি রবীন্দ্রকীর্তিকে প্রকাশের প্রচেষ্টায়  পূর্ব-পশ্চিম কে একাকার করতে সচেষ্ট ছিলেন যদিও  বিতর্কের পরিসরে তার সেই   প্রচেষ্টা শুধু গুরুত্বহীন হয়েই পড়েছিল না, তাঁর বহুমুখী ব্যক্তিত্বকেও উপেক্ষিত করে তুলেছিল।
বাঙালির র কাছে ভীষন গর্বের বিষয় হল  রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি।  ১৯১৩ সালে রবিঠাকুরের এই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর  পরই শুধু দেশের মাটিতেই নয় , পশ্চিমের দেশগুলিতেও তাঁর সম্পর্কে জানার কৌতূহল স্বাভাবিক ভাবেই  ছড়িয়ে পড়েছিল। চটজলদি পদক্ষেপে শুধু দেশে নয়  বিদেশেও নানাভাবে বেশকিছু জীবনী প্রকাশিতও  হয়। তাঁরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল  জার্মান ভাষায় লেখা Paul Cremer-এর Rabindranath Tagore (১৯১৪) ,ইংরেজিতে লেখা Earnest Rhys-এর Rabindranath Tagore : A biographical study (১৯১৫), Basanta Koomar Roy-এর  Rabindranath Tagore : The man and His poetry (১৯১৫) প্রভৃতি।তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও বিতর্কিত  ছিল  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু অধ্যাপক -গবেষক এড ওয়ার্ড  টমসনের   লেখা  রবীন্দ্রনাথের জীবনীকথা  Rabindranath Tagore : His Life and Works (১৯২১)।পরে অবশ্য তারই সম্প্রসারিত রূপ হিসেবে প্রকাশ করেন তাঁর দ্বিতীয় বই Rabindranath Tagore : Poet and Dramatist (১৯২৬)।  


মিশনারি পণ্ডিত-কবি-অধ্যাপক টমসন সাহেব রবীন্দ্রনাথের খুব  বন্ধুই  ছিলেন । ।নানা তর্ক, জটিলতা আর কথা-রাখা-না-রাখায় যে বন্ধুত্বের জুড়ি মেলা ভার। রবীন্দ্রনাথ  টমসনকে প্রথমদিকে  উপযুক্ত মর্যাদায় সম্মানিতও করেন, । ইংরেজি অনুবাদ সংশোধনের  মত গুরুদায়িত্বও দিয়েছিলেন। কিন্তু অনুবাদের মাধ্যমে য়ূরোপে তিনি রবীন্দ্রনাথ কে কবি হিসেবে নয় ,তাঁকে প্রাচ্যের এক ধর্মীয় -আধ্যাত্মিকতার বাণীমূর্তি হিসেবে পরিচয় করাতে চেয়েছিলেন। আর এই ক্ষেত্র ধরেই  সম্পর্কের জটিলতার শুরু।রবীন্দ্রনাথ  এই সমালোচনা গ্ৰহন করেন নি।। সরাসরি ভাবে প্রকাশ না করলেও জীবনীতে উল্লিখিত অনেক বক্তব্য ই রবীন্দ্রনাথ কে সন্তুষ্টি দিতে পারে নি। ব্যক্তিগত চিঠিতে  এইসম্বন্ধে মত প্রকাশের পরে  তিনি শ্রী বাণীবিনোদ বন্দোপাধ্যায় ছদ্মনামে " প্রবাসী" তে একটি প্রবন্ধ লেখেন ।প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ---" রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে রেভারেন্ড টমসনের বহি"।।এখন, কিভাবে রবীন্দ্রনাথের সাথে বন্ধুত্ব হল তা জানানোর আগে টমসন সাহেব সমন্ধে কিছু জেনে নেওয়াই যাক  ।
টমসন সাহেব ১৯১০ এ ভারতে আসেন বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ান স্কুলে শিক্ষকতা করতে...   এরপর হেডমাস্টার হন তারপর   বাঁকুড়ার  কলেজে ইংরেজির লেকচারার,  এক্টিং প্রিন্সিপাল হয়ে কাজ করার পর ১৯২৩ ইংল্যান্ডে ফিরে যান।সেখানে গিয়ে অক্সফোর্ডে র বাংলার লেকচারার ,তারপর ভারতীয় ইতিহাসের রিসার্চ ফেলো হিসেবে  ১৯৪৬   এ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কাজ করেন। টমসন জন্মেছিলেন ইংলণ্ডে, শৈশব কেটেছে দক্ষিণ ভারতের তিরুচিরাপল্লিতে। তাঁর ওয়েলিসান মিশনারি পিতামাতা সেখানেই সেবাকাজে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর দশ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। মায়ের সঙ্গে ইংলণ্ডে ফিরে যাওয়ায় সেখানেই দারিদ্রের সঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠা। ছাত্রজীবনেই পরিবারের দায় মেটানোর জন্যে কাজে যোগদান সঙ্গে   পড়া চালিয়ে যাওয়া আর , কাব্যচর্চা তো ছিলই। ১৯০৭-এর তাঁর প্রথম কাব্য The Knight Mystic প্রকাশিত হয়। আগেই উল্লেখ করেছি, তাঁকে ১৯১০-এ স্কুল ও কলেজের দায়িত্ব নিয়ে বাঁকুড়া আসতে হয়।  বিদেশি হয়েও টমসন একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন বাঁকুড়াকে।একটা কথা মনে করিয়ে দিই ,বর্তমান এতিহ্যবাহী বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ প্রথমে  কিন্তু ওয়েলিসান কলেজ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল (১৯০৩-এর ২৯ জুন)। আর এইটিই  বাঁকুড়ার প্রথম কলেজ।

বাঁকুড়ায় আসার বছর দুয়েক পরে টমসন সাহেবের  বন্ধু লোকেন্দ্র নাথ পালিতের  মাধ্যমে  রবীন্দ্রনাথ ও টমসনের প্রথম আলাপ হয় কলকাতায়। লোকেন্দ্রনাথ তখন ছিলেন বাঁকুড়ার জেলা জজ। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রসাহিত্যে গভীর পরিচয় টমসনের। আসলে বাঁকুড়ায় পড়ানো র কাজে ব্যস্ত থাকলেও নিঃসঙ্গতার অবকাশে একাকী  ঘুরে বেরিয়ে টমসন সাহেব  যেমন গ্রামবাংলাকে চিনেছিলেন ,তেমনি বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্মকরনের চেষ্টা য় সক্রিয় হয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে আয়ত্ব করে তার সাহিত্যের সঙ্গেও সংযোগসাধনেও তৎপর হন তিনি।   রামপ্রসাদী গান থেকে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস সবকিছু র সাথেই তাঁর পরিচয় হয়েছিল নিবিড়ভাবে। অনুবাদেও  ব্রতী হয়েছিলেন । আবার এদেশে তিনি ইংলণ্ডের ম্যাঞ্চেস্টারের ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সাংবাদিকও ছিলেন। সেদিক থেকে বাংলা ও বাঙালিকে জানার পরিসরেই এক অনন্য মূহুর্তে  টমসন রবীন্দ্রনাথে পৌঁছে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ১৯১৩-র ১৪ নভেম্বর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির সংবাদে উচ্ছ্বাসমুখরিত দিনে প্রথম শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন টমসন সাহেব।সেদিন  কি তাঁর উচ্ছ্বাস।বন্ধুর কীর্তিতে বন্ধুর উচ্ছ্বাস। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের প্রতি   ,সৃজনশীলতার প্রতি,,মননশীলতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা না থাকলে তো এ উচ্ছ্বাস আসে না।
বাঁকুড়ার উন্নতি র জন্যে টমসন সাহেবের যে আকুতি ছিল ,রবীন্দ্রনাথের কাছে তা ছিল ভালো লাগার বিষয়।তাই টমসন সাহেবকে তিনি  মর্যাদার আসনে বসিয়ে ছিলেন। ২৯ জানুয়ারি ১৯১৬ বাঁকুড়া জেলার দুর্ভিক্ষে সাহায্য করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনী-র অভিনয় হয়েছিল  জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণে আটচালা বেঁধে রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে, টিকিট বিক্রি করে। রবীন্দ্রনাথ কথা দিয়েছিলেন টমসনকে, ওই অভিনয়ের পরে বাঁকুড়া যাবেন। কিন্তু সে কথা  তিনি রাখতে পারেন নি। এতটাই ক্লান্ত ছিলেন যে, চলে গেলেন শিলাইদহে, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। টমসন তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর পোয়েট অ্যান্ড ড্রামাটিস্ট’-এ লিখছেন, ‘পরের দিন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম---তাঁর আমার সঙ্গে বাঁকুড়া যাবার কথা। কিন্তু তাঁর উৎসাহ ফুরিয়ে গেছে। মেজাজ থাকলে তাঁর উৎসাহ থাকে দানবের মতো, কিন্তু হঠাৎ সে উৎসাহ একেবারে হারিয়ে যায়…।’ তার পরে স্ত্রী থিওডোসিয়াকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘তিনি বাঁকুড়ায় কখনোই এলেন না, শেষ মুহূর্তে কথা দিয়ে কথা রাখলেন না…এটাই তাঁর অচেতন মনের অভ্যাস।’ এরপরও রবীন্দ্রনাথকে বাঁকুড়ায় নিয়ে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন টমসন। রবীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর চিঠিতে সেই আর্তি, "Dear Rabi babu,You must come to Bankura,my boys are longing to see you....I want you to come here,if you can on when it is fool moon." যদিও ‘ বছরের পর বছর কেটে গেলেও রবীন্দ্রনাথ কথা দিয়েও যান নি সেখানে। আর তাঁর এই বাঁকুড়া না আসার ক্ষোভ অনেক দিন ধরে পোষণ করেছিলেন টমসন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধুকে মনের গভীরে শ্রদ্ধা র সাথে স্থান দিলেও কিছু কিছু ঘটনা র পরিপ্রেক্ষিত তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ একটু দেখে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন টমসনকে। দেখে দেওয়ার বন্ধুকৃত্য শোভনতা অতিক্রম করে টমসন তাতে মাস্টারি করে শ’দেড়েক কবিতায় প্রায় শ’তিনেক পেন্সিলের আঁচড় কেটে কবির আন্তরিকতাকেই আঘাত করেন। এজন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁকে চিঠি লিখে (১৮- নভেম্বর ১৯১৩) তাঁর তীব্র অনীহা জানিয়ে তা থেকে বিরত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ১৯১৩-এর ২৭ নভেম্বরে লেখা চিঠিতে বিশ্বকবি তাঁর বিরূপ মনোভাব স্পষ্ট করে তোলেন। সেখানেই শেষ নয়। পরের দিন রবীন্দ্রনাথের ‘The Gardener’ পাঠের প্রতিক্রিয়ায় টমসন যে সুদীর্ঘ  প্রশস্তি সূচক চিঠি লিখেছিলেন, সেটিও বিশ্বকবিকে প্রশান্তি দিতে পারে নি।
একসময়  রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের দুর্বলতা নিয়ে তাঁর বইয়ের মধ্যেও মুখর হয়েছিলেন টমসন। তাঁর এই অপ্রিয় প্রকৃতি ,সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতাকে স্বাভাবিকভাবেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এতেও  কিন্তু  দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ টমসনের মনোভাবে বা সমালোচনায় বিরূপ হলেও তাঁর প্রতি বিমুখ হননি।  ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে আপনার করে নিয়েছিলেন তাঁকে। আবার এও সত্য যে  টমসন রবীন্দ্রনাথকে আপনার করে পেতে চেয়েছিলেন। সত্যিই একপ্রকার নাছোড় রবীন্দ্রানুরাগই টমসনকে রবীন্দ্রচর্চায় স্মরণীয় করে তুলেছিল। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বিরূপতাও সেই অনুরাগ থেকে তাঁকে বিরত করতে পারেনি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর  নোবেলপ্রাপ্তির পর পদ্মায় একাকী নিজেকে খুঁজে ফেরার জন্য টমসনের ডাকে পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী  বাঁকুড়া যাওয়ার আহবানে সাড়া দিতে পারেননি।  আর এক্ষেত্রে  কবিকে না-পাওয়ার অনুশোচনাও টমসনকে রবীন্দ্রবিমুখ করে তোলেনি। কবিগুরুর বাঁকুড়া না আসার  সংবাদে দুঃখ পাবার পরেও ম্যাকমিলান থেকে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনুবাদে টমসন  যোগ দিয়েছিলেন ।অবশ্য অনুবাদের জন্য টমসনের ফি’র দাবিকে রবীন্দ্রনাথ মেনে নেননি। সেই অনুবাদ থেকে প্রাপ্ত অর্থ শান্তিনিকেতনের উন্নয়নে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
  টমসনের অনেক অনুবাদ  রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রশংষিতও হয়েছিল। টমসন অনূদিত ‘শুভা’ গল্পটির প্রশংসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই অনুবাদক হিসাবেও টমসন তাঁর প্রত্যাশিত স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে  একসময় সি এফ এন্ড্রুজের সহায়তা করে অনুবাদ করতে বলেন। এবং ‘Hungry stones and other stories’ (১৯১৬),  গল্প গ্রন্থটির সাতটি গল্পের মধ্যে  তিনটি তে টমসন সহ- অনুবাদক হিসাবে সি এফ এন্ড্রুজের সাথে থাকার অনুমতি পান।  
অন্যদিকে টমসন যে তাঁর জীবনীরচনা সক্রিয় রয়েছেন, সেকথা গুরুদেব জানতেন। এজন্য তাঁর লেখায় স্বচ্ছন্দভাবে রচনার উদ্ধৃতি ব্যবহারের সানন্দ সম্মতি দিয়েছিলেন কবি। ১৯২০-এর ২০ অক্টোবরে ইংলণ্ডে থেকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ টমসনকে জানিয়েছেন : ‘আপনার কাজ ভালো মতো অগ্রসর হচ্ছে জেনে সুখী হলাম। আমার লেখা থেকে যেমন ইচ্ছে উদ্ধৃতি আপনি ব্যবহার করতে পারেন—কবিতার ক্ষেত্রে, যেসব কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি, সেসব কবিতা আপনি নিজেই অনুবাদ করে নিতে পারেন।’ এই চিঠির মধ্যেই টমসনের প্রতি পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরেও রবীন্দ্রনাথের গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা যে বজায় ছিল, তা উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, প্রথম বইটি প্রকাশের পর তীব্র প্রতি বিরূপতার পরেও কবি তাঁকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।
টমসনের প্রথম  বইটি তো  রবীন্দ্রনাথকে খুশি হতে পেরেছিল না।  টমসনের  বইটি  রবীন্দ্রনাথ পড়ার আগেই এন্ড্রুজ পড়েছিলেন। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের পড়ার আগেই এন্ড্রুজ কবির মনটি বিরুপ করে দেন,যদিও নিজে বাংলা ভাষা না জানায় এসব আলোচনার অধিকারীই তিনি ছিলেন না ,তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যাইহোক এরপরে কবি বইটি পড়েন এবং  ক্ষুব্ধ হন এবং সে ক্ষোভ তিনি প্রশান্তচন্দ্রকে লেখা চিঠিতে জানিয়েও ছিলেন । এদিকে আবার  টমসনের বইটির রবীন্দ্রমূল্যায়ন বাংলার বুদ্ধিজীবীদের অনেককেই বিরূপ করে তুলেছিল। আগেই উল্লিখিত ,‘অধ্যাপক টমসনের রবীন্দ্রনাথ’ নামে ‘প্রবাসী’তে (পৌষ ১৩২৮) বইটির সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ও প্রশান্তচন্দ্র মহলনাবিশ ও তাতে জীবনীকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। আর এজন্য ব্রজেন্দ্রনাথতো টমসনের সঙ্গে সম্পর্কই ত্যাগ করেন।
টমসনের কাজের প্রতি প্রশান্তচন্দ্র মহলনাবিশ অত্যন্ত  শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।  টমসন তাঁর ‘Rabindranath Tagore : Poet and Dramatist’ বইটি প্রশান্তচন্দ্র ও তাঁর সহধর্মিনী নির্মলকুমারীকে উৎসর্গ করেছিলেন।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,টমসনের সাথে প্রশান্ত মহলনাবিশ  মহাশয়ের মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের দৌলতে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের সঙ্গে টমসনের আলাপ হয়েছিল। সেই আলাপ ঘনিষ্ঠতায় আন্তরিকতা লাভ করে। প্রশান্তচন্দ্র  একবার আমন্ত্রিত হয়ে বাঁকুড়ায়ও এসেছিলেন এবং সপ্তাহখানেক টমসনের সঙ্গে কাটিয়ে ছিলেন। আর তাঁদের কথোপকথনই সৃষ্ট  ‘The Notebook of Conversation’- মহার্ঘ হয়ে উঠেছিল একসময়।
, রবীন্দ্রনাথ ও টমসনের মধ্যে মতান্তরে  প্রশান্তচন্দ্র ই রবীন্দ্রনাথ ও টমসনের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।এজন্য প্রয়োজনে দুজনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে সেই ভুলবোঝাবুঝির অবসান চেয়েছিলেন তিনি । এরপর বিশ্বকবিও টমসনকে এজন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লেখেন ১৯২১-এর ২ অক্টোবর। তাঁর কথায় : ‘Do not misunderstand me and never think that I am angry…I have been expecting you for long . Please do not disappointment me if you can help.’ শান্তিনিকেতনে তাঁদের সেই মেধাবী সান্নিধ্যের (৭-৯ অক্টোবর ১৯২১) আধারেই লেখা হয় ‘Edward Thomson’s Notebook of conversation with Rabindranath’ প্রখ্যাত রচনাটি। সেই সাক্ষাৎকারের তথ্যগুলি টমসন তাঁর পরের রবীন্দ্রবিষয়ক বই ‘Rabindranath Tagore : Poet and Dramatist’ (১৯২৬)-এ ব্যবহার করেছেন। অবশ্য সে-বইটিও রবীন্দ্রনাথকে স্বস্তি দেয়নি। এমনকি, টমসন যে তাঁর সাহিত্যকে ভালোভাবে আত্মস্থ করতে পারেননি, সেকথা তিনি বাণীবিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনামে  ‘রেভারেণ্ড টমসনের বহি’ প্রবন্ধেই জানিয়ে দেন। 'অন্যদিকে বাংলার বিদ্বসমাজে প্রথমটির চেয়েও দ্বিতীয় বইটির বিরূপ সমালোচনা আরও তীব্রতাই শুধু নয়, তিক্ততায় বিজাতিবিদ্বেষী মনোভাবের সক্রিয়তায় বিচ্ছেদের আবহও তৈরি করে'। । কিন্তু ,অবাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে বিদেশে রবীন্দ্রপ্রতিভার পরিচয় প্রদানে টমসনের প্রয়াস জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। প্রথম বইটির সমাদরের কথা স্বয়ং প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ রবীন্দ্রনাথকে জানিয়েছিলেন(চিঠি-২৫ অক্টোবর ১৯২১) : ‘Thomson-এর বইখানার খুব কাট্‌তি হচ্ছে ও হবে—এখন যতটা পারা যায় সব ঠিক করে দেওয়া দরকার। Thomsonকে লিখেছি যে চিঠিতে হবে না, সামনাসামনি ওর সঙ্গে বসতে হবে।’ সেদিক থেকে টমসনের বইয়ের সমাদরই তার গুরুত্বকে অনস্বীকার্য করে তুলেছিল,একথা মানতেই হবে।
রবীন্দ্রনাথের সাথে টমসনের মতান্তর ঘটলেও মনান্তর কখনও ঘটে নি। বিতর্কিত বন্ধুত্ব ছিল ঠিকই ,কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল। এতকিছুর পরেও তাঁদের মধ্যে চিঠিপত্র আদানপ্রদান ছিল ১৯৪০ পর্যন্ত। কেন জানি না মনে হয়, যে আশেপাশের বন্ধুজনের আলাপ- আলোচনার  হাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় সহজেই প্রভাবিত হতেন ,আবার সহজেই বোধ হয়  সে তাপ উত্তাপ কোথায়  মিলিয়েও যেত।
রবীন্দ্রনাথের  জীবনী যত রচিত হয়েছে তার মধ্যে টমসনের  লেখাটিই  কিন্তু পাশ্চাত্যের সাহিত্য প্রেমী মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকীর্তিকে  চিনতে  সাহায্য করেছিল। বিতর্ক হয়েছে ঠিকই কথা,কিন্তু পরবর্তীতে অনেক রবীন্দ্র গবেষক কিন্তু টমসনের কাজটি র  মূল্য স্বীকার করেছেন।নীহাররঞ্জন, বাণীবিনোদ, রামানন্দ  চট্টোপাধ্যায়দের টমসনের বইটি প্রসঙ্গে হয়ত উগ্ৰ সমালোচনা ছিল কিন্তু উত্তরকালে সুবোধ সেনগুপ্ত ,প্রমথনাথ বিশী,বুদ্ধদেব বসু ,শঙ্খ ঘোষ,অশ্রু সিকদার----এরা টমসনের কাজটির মূল্য স্বীকার করেছেন।এজন্যই অনেকেই মনে করেন, 'ভুলভ্রান্তি সত্বেও টমসন কবিত্বের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ কে ইংরেজিতে এনেছেন প্রায়শ সার্থকতরভাবে।তাঁর ঝোঁক এবংরুচি রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মমূর্তিতে নয়,তাঁর কবিসত্ত্বের,পোয়েটিক পার্সোনাল উপলব্ধিতে "। হয়ত একথা মানতেই  হবে টমসনই প্রথম ইউরোপীয় সাহিত্য রূচিসম্পন্ন মানুষ যিনি রবীন্দ্রনাথ এর রচনা পড়ে ইউরোপের সাহিত্য জিজ্ঞাসুদের কাছে প্রকৃত রবীন্দ্রনাথ কে উপস্থাপন করেছেন।,টমসনের ব ই ছাড়া তো আর প্রথমদিকে রবীন্দ্র-চর্চার   উপযোগী   ব ই অন্য কোন বিদেশী ভাষায় খুব বেশি ছিল না। তাই কবিত্বের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ এর আগমন ইংরেজিতে এসেছে টমসনের হাত ধরেই,একথা মেনে নিতে দ্বিধা থাকে না।
তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এডওয়ার্ড টমসনের সম্পর্কে র টানাপোড়েন নিয়ে প্রচুর গবেষণা  হয়েছে ,.....আজও চলছে।  এই চর্চা চলবেই.....।
সূত্র:
১/নীহাররঞ্জন রায়----প্রসঙ্গ:রবীন্দ্রনাথ ও রেভারেন্ড টমসন; পৃষ্ঠা২৩১-২৩৬,বঙ্গদর্শন: নিহার রঞ্জন রায়--শততম জয়ন্তী, সম্পাদক--সত্যজিৎ চৌধুরী---বঙ্কিম ভবন গবেষণা কেন্দ্র,জানুয়ারি ,২০০৩ সংখ্যা।
২/ A Difficult Friendship (Letters of Edward Thompson and Rabindranath Tagore 1913-1940)---by Uma dasgupta ,Oxford. University press 2003.
৩/Rabindra Nath Tagore -poet and dramatist.by Edward Thompson.--London oxford university press 1948.
৪/ প্রবন্ধ:শ্রেষ্ঠ জীবনী লিখেও উপেক্ষিত  টমসন ------স্বপন কুমার মন্ডল,প্রফেসর, বাংলা বিভাগ, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়, ---প্রকাশ---পেজ ফোর নিউজ ডট কম ,সেপ্টেম্বর ২০২১
৫/Alien Homage:Edward Thompson and Rabindranath Tagore(1993)--by E.P Thompson(sin of Edward Thompson.
৬/ প্রবন্ধ-----রেভারেন্ড টমসনের "রবীন্দ্রনাথ টেগোর: পোয়েট আ্যন্ড ড্রামাটিষ্ট"------নীহাররঞ্জন রায়।নীহাররঞ্জন রচনাবলী।
--------------------------
5.4.2022.
@প্রবীর দে,বিরাটি