গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা পার্বতীর মাত্র তিন দিনের জন্য পিতৃ গৃহে আগমন এবং তাঁর এ আগমনকে কেন্দ্র করে রচিত গানই আগমনী গান। আর পিতৃগৃহে তিনদিন অবস্থানের পর উমা যখন পুনরায় পতিগৃহে ফিরে যান, তখন যে বিষাদের সুর বেজে ওঠে তাকে কেন্দ্র করে রচিত গানগুলিই বিজয়ার গান।
অষ্টাদশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য কাব্য বৈচিত্র্য শাক্ত পদাবলীর অংশ বিশেষ হল আগমনী -বিজয়া গান।শিব-পার্বতী উমা/দুর্গা)-র কাহিনী অবলম্বনে রচিত এই প্রকার জনপ্রিয় বাংলা গান কিন্তু বহুকাল ধরে বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত এবং সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত।
এ গানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন । এছাড়াও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য রামবসু ও দাশরথি রায় এই আগমনী গানের রচনা ,ও সুর সৃষ্টিতে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আমার এই নিবন্ধে আলোচনার বিষয়বস্তু হল ‘ কবিরঞ্জন’ রামপ্রসাদের আগমনী গান।
কবি রামপ্রসাদ এসেছিলেন তাঁর সাধনার অনুভূতিলব্ধ সুর ও ধ্বনি নিয়ে। তাঁর বাণীতে ক্লান্ত, অবসন্ন বাঙালী-জীবন মায়ের রক্তচরণ কমলে বিপদ মুক্তির শরণাগতি খুঁজেছে। সন্তানের আতুর ব্যাকুলতা মায়ের প্রতি দুহাত বাড়ানো স্নেহ প্রার্থনা রামপ্রসাদের ভবঘুরে জীবনের মহত্তর সাফল্য। তাঁর সৃষ্ট সব ধরনের শাক্ত পদাবলীর উৎকর্ষতা এবং তাতে প্রতিভার বিচ্ছুরণ চির প্রশংসা যোগ্য এবং তাঁর অনুরণন আজও ধ্বনিত হয়।
এটা ঠিক যে আগমনী বিজয়ার গানে রামপ্রসাদের প্রতিভার নমুনা অল্প পরিমাণেই প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই পদগুলিতে যে বাৎসল্যরসের প্রকাশ ঘটেছে তা এককথায় চমৎকার।
💐 শাক্ত পদাবলীর প্রথম পূজারী রামপ্রসাদ--:
বৈষ্ণব পদাবলীর ইতিহাস চারশো বছরের আর শাক্ত পদাবলীর উৎপত্তি ও বিকাশ শুধু অষ্টাদশ শতাব্দীতেই ।কিন্তু হিন্দু বাঙালীর মধ্যে শাক্ত ভাব ও ভাবনা তো সেই বহু আগে থেকেই …।প্রাচীন কাল থেকেই (বৈদিক যুগ ) এই ভারতবর্ষ যে তন্ত্রপ্রধান মাতৃকা পূজার পীঠস্থান । অষ্টাদশ শতাব্দীতে একদিকে বর্গীর হাঙ্গামা, শাসকদের অত্যাচারে বাঙালীর ধর্ম, প্রাণ সব কিছুতেই একটা নিরাপত্তার অভাব দেখা গিয়েছিল ।শ্রমে ও সেবায়, বৈরাগ্যে ও ব্যর্থতায়, প্রার্থনায় ও বার্ধক্যে, স্নেহবুভুক্ষার কম্পিত মুহূর্তে কিংবা ভক্তির আকণ্ঠ ক্রন্দনে নৈসর্গিক আবেগের বাণী রূপ আবির্ভূত হয় শাক্ত পদাবলী। আর রামপ্রসাদ ছিলেন এই শাক্ত পদাবলীর প্রথম পুজারী।
রামপ্রসাদ ছিলেন শাক্ত উপাসক ,কবি।শক্তি অর্থাৎ উমা- পার্বতী -চণ্ডী -কালিকাকে কেন্দ্র করে যে গান রচিত হয়েছিল , তা-ই শাক্ত পদাবলী বা গান। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অবশ্য সে গানকে বলা হত ‘মালসী ‘।সম্ভবত মালবশ্রী রাগে গান গুলি গাওয়া হত বলেই এই নাম ছিল। পরে এ নাম অবশ্য আর স্থায়িত্ব পায় নি। তবে শাক্ত পদাবলীর উৎস হিসেবে একে ধরা যেতেই পারে ।
অষ্টাদশ শতকের এই শাক্ত পদাবলী ছিল ভক্তিরস ,বাৎসল্য রস এবং মাতৃ হৃদয়ের অনুভুতিতে জাগ্রত।
মনে রাখতে হবে ইতিপূর্বে সৃষ্ট সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলায় রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্য, চণ্ডী মঙ্গল বা মনসা মঙ্গল কাব্য গুলি অপেক্ষা বাৎসল্য রস এই শাক্ত পদাবলীতে অনেক বেশী বলেই তা জনপ্রিয় হয়েছিল এবং আজও তাঁর অনুরণন ধ্বনিত হয়।
তাই বাঙালীর অতি কাছের মাটির গন্ধমাখা জীবন রাম প্রসাদী সুরের মধ্য দিয়ে আজকের আধুনিক সংস্কৃতির যুগেও অতি সহজে প্রবেশ করে আমাদের বাতায়ন পাশ দিয়ে।
সত্যই রামপ্রসাদের শাক্ত পদে গ্রন্থলব্ধ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দূর হয়ে যায়। রামপ্রসাদের পদাবলীকে কতগুলি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে–
ক) উমা বিষয়ক (আগমনী ও বিজয়া)
খ) সাধন বিষয়ক (তন্ত্রোক্ত সাধনা)
গ) দেবীর স্বরূপ বিষয়ক
ঘ) তত্ত্ব দর্শন ও নীতি বিষয়ক
ঙ) কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি বিষয়ক ইত্যাদি।
রামপ্রসাদ অন্ধকারের মধ্যে আশার বর্তিকা জ্বেলেছেন। তিনি শুধু কবি বা গায়কমাত্র নন—মানুষের তাপদগ্ধ জীবনে তিনি স্নেহের প্রলেপ দিয়েছেন। মাতৃতন্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পূজারী হলেন তিনি। আর আগমনী গানে তিনি মাতাকে কন্যারুপে দেখালেন যেখানে মাতা মেনকার আবেগ ,অনুভুতি মধ্যবিত্ত সংসারের মাতার অনুভুতির সাথে মিলে গেল। হ্যাঁ , এর আগে বাংলার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের স্থানে স্থানে শাক্ত পদাবলীর আভাস ফুটে উঠলেও রামপ্রসাদের কণ্ঠে শ্যামাসঙ্গীত শতধারায় প্রবাহিত হয়েছে। মানুষ আজও তাঁকে ভুলতে পারে নি। তাই তাঁকে শাক্ত পদাবলীর প্রথম পূজারী বলে ধরা যায়।
💐আগমনী- বিজয়ার গানের অনুপ্রেরণা ও মূল্যায়ন ---:
আগমনী-বিজয়া গানের অনুপ্রেরণা এসেছে বৈষ্ণব গীতিকবিতা থেকে। বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী উভয়েরই মূল রস মধুর, তবে আগমনী-বিজয়া গানে করুণ রসেরও অভিব্যক্তি ঘটে ছিল খুব নিপুণভাবে । তাছাড়া বৈষ্ণব কবিতায় সাধারনত থাকে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রাধান্য, কিন্তু আগমনী-বিজয়া গানে থাকে সর্বজনীনতার সুর। বৈষ্ণব পদাবলীর উপজীব্য ছিল শৃঙ্গার রস , তার পরিবর্তে শাক্ত পদাবলীতে স্থান পেয়েছে বাৎসল্য রস। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা কৃষ্ণের প্রেম ভক্তি বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল।। আর শাক্ত পদাবলীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে উমা, পার্বতী ,চন্ডী ,কালিকাকে কেন্দ্র করে।
মঙ্গলকাব্যের গানেও রুদ্রচন্ডী একাধারে কন্যা ও মাতৃরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু আগমনী ও বিজয়ার গানগুলিতে বাৎসল্য ও করুণরসের অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। এ গানের বিষয়বস্তু বাঙালি হিন্দুর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং বাস্তবতার এক নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায় এসব গানে। বাঙালি পরিবারের কন্যা ও জামাতাগৃহের বিরোধের কথাও এতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এর পদ্গুলি সাধনা ভক্তিবাদকে অতিক্রম করে অনেকটাই মানবিক হয়ে উঠেছিল । তাই শরৎকালের নিশিশেষে গিরিরাজ পত্নি মেনকা কন্যা উমাকে স্বপ্নে দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে স্বামীকে নিবেদন করছেন……
যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী,
উমা বড়ো দুঃখে রয়েছে,
আমি দেখেছি স্বপন নারদ-বচন
উমা মা-মা বলে কাঁদিছে....
আগমনী-বিজয়া গানের মধ্য দিয়ে শাক্তপদাবলির সংসারমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বাঙালি হিন্দু মেয়েদের যখন বাল্যবিবাহ হতো তখন মা মেনকার মতো বাঙালি মায়েরাও স্বামীগৃহে মেয়ের সুখ-দুঃখের কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হতেন। তাঁরাও আকুলভাবে মেয়েকে কাছে পেতে চাইতেন, আর মেয়েরাও উমার মতো পিতৃগৃহে আসার জন্য সারা বছর অপেক্ষায় থাকত এবং সে সুযোগটি ঘটত সাধারণত শারদীয় দুর্গাপূজার সময়। এ সময় মেয়েকে কাছে পেয়ে মা স্বস্তি বোধ করতেন, আনন্দিত হতেন, আবার বিদায়ের সময় মেনকার মতোই দুঃখে কাতর হতেন। সমাজের এ প্রেক্ষাপটে আগমনী-বিজয়া গান বাঙালি জীবনে এক অস্থায়ী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
মা মেনকার মত বাঙালি মায়ের মনেও কন্যার আর্থিক অবস্থা নিয়ে এক অস্থিরতা তাও ছিল রামপ্রসাদের পদাবলীর বিষয়বস্তু । তাই কন্যার দারিদ্রের কথা স্মরন করে মেনকার উক্তিতে রামপ্রসাদ বলছেন …
জনক তোমার গিরি ,পতি জনম ভিখারী
তোমা হেন সুকুমারী দিলাম দিগম্বরে।‘
হ্যাঁ , রামপ্রসাদের আগমনী – বিজয়া গানের মুল চরিত্র হলেন গিরিরাজ হিমালয় পত্নি আরাধ্যা উমার মাতা মেনকা। মাতৃ হৃদয় তো মমতাময় … তাই গিরি রাজ যখন কৈলাসে মেয়েকে আনতে গেছেন … মা মেনকার মাতৃ হৃদয়ের ভাবনা তখন আবেগধর্মী । মেনকা তাঁর স্বামীকে বলছেন …
“ গিরি, এবার উমা এলে আর উমা পাঠাবো না
বলে বলবে মন্দ লোকে , কারও কথা শুনবো না।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয় উমা নেবার কথা কয়
এবার মায়ে ঝিয়ে করবো ঝগড়া জামাই বলে মানবো না। “
অপত্য স্নেহ ,বাৎসল্য ,মমতাময়ী মায়ের অভিব্যক্তি সবকিছুই যেন একশো শতাংশ যথার্থ আন্তরিক ভাবে উপস্থাপিত। প্রতিটি মধ্যবিত্ত ঘরের জননীদের অনুভুতিগুলিকে উনি সজীব করে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
উমা এলেন বাপের বাড়ি । সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত তিন দিন থেকে দশমীতে আবার ফিরে যাবেন । বাবা সাথে করে নিয়ে এসেছেন … হাসিঠাট্টা ,গল্পে, আনন্দে কেটে যায় তিন দিন । নবমীর রাত এসে উপস্থিত … বিষাদের শুরু তো সেখান থেকেই… মা মেনকার মনে তখন অন্য চিন্তা … নবমীর এ রাত যেন না হয় অবসান। কবি রামপ্রসাদ মায়ের এই চিন্তা ,অনুভুতিকে প্রকাশ করেছেন যেভাবে সেগুলিই হল বিজয়ার গান।
বিজয়ার গানের পদ যেন বাঙালী ঘরের প্রতি টি মায়ের মনের কথা । তিনি সাধক কবি অথচ এই আগমনী – বিজয়ার গান রচনায় হয়ে উঠলেন এক মানবিক কবি। শক্তি সাধনা ও ভক্তি ভাবকে অতিক্রম করলেন যথার্থ সাহিত্য সৃষ্টির উদ্যেশ্যে । মর্তের জীবনকে তিনি তুলে ধরলেন পদাবলীর মাধ্যমে।
তাই বিদায় লগ্নে মায়ের যন্ত্রণার কথা লিখলেন মর্মস্পর্শী ভাষায় …
“ তনয়া পরের ধন ,বুঝিয়া না বুঝে মন
হায় হায় এ কি বিড়ম্বনা বিধাতার।“
সত্যিই ,রাম প্রসাদের আগমনী – বিজয়ার গান আমাদেরকে যেন অষ্টাদশ শতকের বাঙালি ঘরের অভ্যন্তরে পৌঁছে দেয়।
তার গানগুলি সবার মাঝে পরিচিতি পেয়েছিল ও প্রকারান্তরে, মানুষের হৃদয়ে এক বিশুদ্ধ আত্মিক সম্বন্ধযুক্তি ঘটিয়েছিল । যুগে যুগে, বাউলরা এবং সাধকরা মানবিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আধ্যাত্মিক আত্মা হিসেবেই পরিগন্য হয়ে আসছেন। রামপ্রসাদের গানের বাণীতে শুধু যে ভক্তিই নয়, রয়েছে মানব জীবনের দুর্লভ অভিজ্ঞতা-লব্ধ দর্শন, গভীর ও চিরন্তন সত্যের প্রতি দিক নির্দেশনা ।
💐আগমনী গানের কাব্য দ্যুতি ও সুরের ধারা অস্তিত্ব…..
--------:
ঠিকই , বাংলা গানের এ ধারা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, একথা সত্য , কারণ জগজ্জননীরূপে চন্ডীর যে ব্যাপকতা, তাকে তাঁর কন্যারূপ স্বল্পপরিসরে বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। মাতাকে কন্যারূপে কল্পনা করে ভক্তদের মধ্যে ভক্তিসাধনার পরিবর্তে স্নেহবাৎসল্যের এক প্রবল তরঙ্গ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু সে তরঙ্গ আবার অল্পতেই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে।
আসলে সময়ের বিবর্তন এটা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিল যে বাঙালি হিন্দু মানুষ আরাধ্য মাতা পার্বতীকে কন্যা রুপে নয় মাতা হিসেবেই দেখতে বেশী পছন্দ করেন । তাই আগমনী গানের এ ধারা আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। তবে বাঙালি হিন্দুরা এখনও শারদীয় দুর্গাপূজার সময় উমা-শিবকে নিজেদের মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে অভেদ জ্ঞান করে আনন্দ-বেদনা অনুভব করে ।শারদীয়া উৎসবে তাই আবারও সেই রামপ্রসাদী আগমনী -বিজয়া গানের অনুরণন।
২৭৫ বছর পরেও রামপ্রসাদ আজও তাই প্রাসঙ্গিক।