বিদ্রোহী কবি র শুভ জন্ম দিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য:
নিবন্ধ:
বিবাহ বিভ্রাট
প্রবীর দে
কবি কাজী নজরুলের জীবনের অত্যন্ত বেদনাদায়ক, অপ্রীতিকর, অপ্রত্যাশিত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ) বহুল ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম ছিল তাঁর প্রথমবারের বিবাহ এবং তার বিচ্ছেদ ( কারন এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত কবিকে অনেক বাস্তববাদী হতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল )
নার্গিস আসার খানম (সৈয়দা খাতুন) ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথমা স্ত্রী (নজরুল তাকে নাম দেন নার্গিস, ফার্সি ভাষায় যার অর্থ গুল্ম)। নার্গিস ছিলেন পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের ভাগ্নি।পুস্তক প্রকাশনা বিষয়ে আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুলের একটা নিবিড় সৌহার্দপূর্ণ সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল। আকবর নজরুল কে কুমিল্লা য় নিয়ে যান। এবং ভাগ্নী র সাথে বিবাহের সিদ্ধান্ত নেন।
যাক নার্গিসের সাথে বিয়ে হওয়ার প্রেক্ষাপটের বিষয়টি একটু বিস্তারিত শুনে নিলে বোধহয় খারাপ কিছু হবে না।
নার্গিসের মামা আলী আকবর খানের সাথে নজরুলের পরিচয় কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে। আলী আকবর খান সম্রাট বাবরের জীবনী নিয়ে একটা নাটক লিখেছিলেন এবং টুকটাক পুস্তিকা লিখে নিজেই ফেরি করে বিক্রি করতেন। সেই সব পুস্তিকায় আলী আকবর খান রচিত কিছু কবিতাও থাকত। তার সেসব হাস্যকর কবিতা তিনি একদিন নজরুলকে দেখালেন।নজরুল বললেন ,'এগুলো কোন কবিতা হয়েছে নাকি, দাঁড়াও আমি তোমায় একটা কবিতা লিখে দিচ্ছি.. "।তখনই নিজে “লিচু চোর” কবিতাটি আলী আকবর খানকে লিখে দেন।
এতে খুশি হয়ে সে নজরুলকে তার গ্রামের বাড়ি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুমিল্লাতে দাওয়াত দেন। এই আলী আকবরকে নজরুলের বন্ধুরা তেমন পছন্দ করতেন না এবং সর্বদাই তার থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু সরল মনা নজরুল কখনই বন্ধুদের উপদেশ গ্রহণ করেননি। ১৯২১ সালের মার্চে নজরুল আলী আকবর খানের সাথে বন্ধুদের কিছু না জানিয়েই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়ার পর এটাই ছিল নজরুলের প্রথম পূর্ববঙ্গ যাত্রা। যাবার পথে তিনি “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতাটি লেখেন।
ট্রেনে কুমিল্লা পৌছে নজরুলকে নিয়ে আলী আকবর খান তার স্কুলের বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেন। বীরেন্দ্রকুমারের মা ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবী। একই বাড়িতে তার বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবীও থাকতেন তার মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তা (দোলন) ওরফে আশালতা সেনগুপ্তাকে নিয়ে। চারপাঁচ দিন সেখানে কাটিয়ে কবি রওয়ানা দেন দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির উদ্দেশ্যে। তবে সেই চারপাচ দিনেই সেনবাড়ির সবাই বিশেষ করে বিরজাদেবীর সাথে নজরুলের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। নজরুল তাকে “মা” সম্বোধন করতেন।
এরপর নার্গিসের সাথে কবির আলাপের সূত্রপাত কবির বাঁশি বাজানো নিয়ে। এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হন নার্গিস। একদিন নজরুলকে এসে শুধান, “গত রাত্রে আপনি কি বাঁশি বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি”। এই পরিচয়ের পরই নজরুল সেই যুবতি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন। তার আচার আচরণে নার্গিসের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেতে থাকল।
আলী আকবর খানও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। মূলত নজরুলকে কুমিল্লা আনবার তার উদ্দেশ্য এই ছিল, নিজ পরিবারের কারো সাথে নজরুলের বিয়ে দেওয়া। তার পরামর্শে নার্গিসের খাঁ বাড়িতে আসা যাওয়া বাড়তে থাকে। নার্গিসের মাকে তিনি জানান, “এই ছেলে (নজরুল) একসময় জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক কবি হবে। এই কাজীকে কোন রকমে আটকাতেই হবে। তাহলে ভবিষ্যতে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে”।
যাইহোক ,কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামের নার্গিস অত্যন্ত ধার্মিক পরিবারের মেয়ে ছিলেন। কবি নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের বিবাহ সম্পর্কে তাঁর পিতা রাজীও ছিলেন না। এমন কি নার্গিসের বড় ভাইরাও এ বিয়েতে অমত ছিলেন।নজরুল নার্গিসকে পছন্দ করেন এবং বিয়েতে রাজি হন।
এই সময় আলী আকবর খান নজরুলকে তার কলকাতার কোন বন্ধুদের চিঠি দিতেন না এমনকি নজরুলের চিঠিও কলকাতায় পোস্ট করার আগেই সরিয়ে ফেলতেন। বিয়ের প্রায় কিছুদিন আগে নজরুল এই ঘটনা গুলো জানতে পারেন( নার্গিসের দ্বিতীয় স্বামী কবি আজিজুল হাকিম পরবর্তিতে সেই চিঠি গুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করেন)। আলী আকবর মনে মনে ভেবেছিলেন চালচুলোহীন নজরুলকে ভাগ্নীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ঘর জামাই করে রাখবেন এবং নজরুলকে দিয়ে স্কুলপাঠ্য বই লিখিয়ে নিয়ে নিজের প্রকাশনা ব্যবসা চালিয়ে যাবেন রমরমিয়ে।
পিতা ও ভাইদের অসম্মতি সত্বেও মামাদের কথায় নার্গিস এ বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন। নজরুলের পক্ষ হতে কলকাতা থেকে এ বিয়েতে কেউই উপস্থিত ছিলেন না।শুধু কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবী সহ সেনগুপ্ত পরিবারের সকলেই এ বিয়েতে যোগদান করেছিলেন।
বিয়েতে তার পক্ষের অতিথি হিসেবে বিরাজা সুন্দরী দেবী ও তার পরিবারকে মনোনিত করেন। বিয়ের আগের দিন সবাই দৌলতপুরে এসে উপস্থিত হন। কলকাতায় নজরুলের বন্ধুদের এমন সময় দাওয়াত দেওয়া হয় যেন কেউ আসতে না পারে। কবির অন্যতম ঘনিষ্ট বন্ধু কমরেড মোজাফফর আহমেদ নিমন্ত্রন পত্র পান বিয়ের পরে।
বিয়েতে বিভিন্ন ধরণের গান-বাজনারও আয়োজন করেছিলেন। এই গানের অনুষ্ঠানে কুমিল্লা শহর থেকে একদল মহিলা শিল্পী এসেছিলেন। তারা আলী আকবর খানের বাসাতেই সবাই অবস্থান করেছিলেন। শিল্পীরা সবর্ক্ষন এই সদ্য বিবাহিত বর ও বধূকে বিভিন্নভাবে আনন্দ ফুর্তিতে রেখেছিলেন। অনুমান করা হয় এসব কারণেই রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য নার্গিসের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথম দিনেই এ বিবাহের বিচ্ছেদ ঘটে (যদিও এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে বিতর্কের আজও অবসান ঘটে নি)।তবে যে মতটি বেশী গ্ৰহনযোগ্য মনে হয় অনেকের কাছে ,তা হল...
যতদূর জানা যায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় এবং আকদ্ও সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিনের শর্ত উল্লেখ করবার সময়ই ঝামেলা বাঁধে। আলী আকবর খান শর্ত জুড়ে দিতে চান, নজরুলকে ঘর জামাই থাকতে হবে। বাঁধন হারা নজরুল এই শর্ত প্রত্যাক্ষান করেন। আকদ্ হয়ে যাবার পর আনুষ্ঠানিক অন্যান্য কাজে যখন সবাই ব্যস্ত তখন নজরুল অন্তর্দ্বন্দে বিক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ছুটে যান বিরজা সুন্দরী দেবীর কাছে। তাকে বলেন, “মা, আমি এখনই চলে যাচ্ছি”। বিরজা সুন্দরী দেবী বুঝতে পারেন এই অবস্থায় নজরুলকে ফিরানো সম্ভব না। তিনি তার ছেলে বীরেন্দ্রকুমারকে নজরুলের সাথে দিয়ে দেন। সেই রাতে দৌলতপুর থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত কর্দমাক্ত (আষাঢ় মাস) রাস্তা পায়ে হেটে নজরুল ও বীরেন্দ্রকুমার কুমিল্লা পৌছেন। পরিশ্রমে ও মানসিক চাপে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। নজরুলের জীবনে নার্গিস পর্ব সেখানেই শেষ মনে হলেও তা কিন্তু নয়।
’এই ঘটনা নজরুলের জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত করেছিলো। এ বিয়েকে কেন্দ্র করে নজরুলের জীবনে ঘটে যায় যে বিষাদময় অনুভূতি,তার অনুরণন শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে জীবন সংগ্ৰামে এগিয়ে যাওয়া ছিল এক চ্যালেঞ্জ।।সে ছিল এক স্বপ্ন ভঙ্গের ইতিহাস।
কবি তার ছায়ানট; পূবের হাওয়া; চক্রবাক কাব্য গ্রন্থের অনেক কবিতা নার্গিসকে কেন্দ্র করে রচনা করেন। ছায়ানটের মোট ৫০ টি কবিতার মধ্যে "বেদনা অভিমান'; "অবেলায়"; "হার মানা হার"; "অনাদৃতা"; "হারামনি"; মানস বধু; বিদায় বেলায়; পাপড়ি খেলা; ও বিধূর পথিক সহ মোট নয়টি কবিতা নার্গিসকে কেন্দ্র করে লেখেন।
ব্যক্তি জীবনে এতবড় হৃদয় বিদারক দুঃখময় ঘটনা সৃষ্টির পশ্চাতে নজরুলের মনে অন্য কোন গভীর বেদনা কাজ করছিলো কি না তা শুধু নজরুলেই সঠিক বলতে পারবেন। পরবর্তীতে তার বহু কবিতায় ও বহুগানে এই দুঃখের দীর্ঘশ্বাস আমরা দেখতে পাই।
এ বিয়ে কেনো ভেঙ্গে গেলো তা’ আজও রহস্যবৃত। কেউ কেউ বলেন নজরুলের ছন্নছাড়া, ক্ষ্যাপা জীবনই এর জন্য দায়ী। কেউ বলেন নজরুলের প্রতি নার্গিস আসারের তাচ্ছিল্যই এ বেদনাদায়ক পরিস্থিতি ঘটিয়েছিল। আবার অনেকে বলেন বিবাহের সময় ২০,০০০/- (বিশ হাজার) টাকা কাবিন হওয়ার পরেও শর্ত ছিল নজরুল ইসলাম নার্গিস আসারকে দৌলতপুর থেকে নিয়ে যেতে পারবেনা। এই শর্তই নজরুল ইসলামের অহমিকায় ভীষণভাবে আঘাত হেনেছিল। আবার অনেকে বলেন নার্গিস আসার খানমের মামা আলী আকবর খানের বিরাট স্বার্থান্ধতাই এ বিয়ে বিচ্ছেদের মূল কারণ।
বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পরে পরবর্তীতে নার্গিস আসার খানম ঢাকা শহরেই বসবাস করতেন। তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এবং এই কলেজ থেকেই আই.এ পাশ করেন।নার্গিস আসার খানম পরবর্তীতে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার নিকটবর্তী রায়পুরার আলিমুদ্দিন সরকারে পুত্র বিশিষ্ট কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাঁর পুত্র কন্যারা সবাই সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হন।নার্গিস বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো, তাহমিনা (উপন্যাস) ও ধুমকেতু (উপন্যাস)।নজরুলের সাথে নার্গিসের দেখা হয়েছিল বিয়ের ১৫ বছর পরে। অনেকে বলেন তখন নাকি তাদের আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এবং নজরুল ভক্ত কবি আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের তারপরেই নাকি দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয়।
এখন প্রশ্ন হল বিয়েটা কি আদৌ সম্পূর্ণ হয়েছিল?বিরজা সুন্দরী দেবী ঐ বিয়ের আসরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন, 'বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মতোন ঝুলতে লাগল মধ্যপথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা।' বিয়ের ব্যাপার নিয়ে পরের বছরই, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায় বিরজা সুন্দরী দেবীর 'নৌকা পথে' নামে একখানা লেখা প্রকাশিত হয়। তাতেই তিনি ঐ বিয়ে সুসম্পন্ন হওয়ার কথা স্পষ্ট ভাবে কিছু বলেন নি। আর বিখ্যাত কবি ,প্রাবন্ধিক আব্দুল কাদির সাহেব (নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিখ্যাত মুজফ্যর আহমেদের জামাতা )ও কিন্তু কোথাও স্পষ্ট করে বলেন নি যে নার্গিসের সাথে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল না।।প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ,মুজফ্যর আহমেদ হলেন নজরুলের অত্যন্ত প্রিয়জন, ঘনিষ্ঠ সহযোগী,সুতরাং তিনি সব কিছুই জানতেন নজরুল সম্বন্ধে।আর ঘটনা সম্বন্ধে অন্যরকম কিছু হলে কাদির সাহেবকে তিনি নিশ্চয়ই বলে যেতেন।
মনে করিয়ে দিই .. করাচি সেনা শিবির থেকে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল কলকাতা ফিরে আসেন। চিঠি-পত্র মারফত মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগ সেনা শিবির থেকেই। মুজাফফরের উদ্যোগে নজরুলের প্রথম কবিতা ছাপা হয় কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির পত্রিকায় ১৯২১ সালে। করাচির সেনা শিবির থেকেই নজরুলের লেখা ডাক মারফত মুজাফফরের হাতে এসে পড়ে। এবং কলকাতায় ফিরে মুজাফফরের আস্তানাতেই নজরুল থিতু হন। তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন অনেকগুলি বছর। সেই মুজাফফর কিন্তু তথ্য-প্রমান দিয়ে দেখিয়েছিলেন যে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে সুসম্পন্ন হয়নি। তিনি ষাটের দশকেই জেলখানায় বসে নজরুল নিয়ে লেখার সময় বিরজা সুন্দরীদেবীর পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেও সুনিশ্চিত হন যে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়েটা প্রহসন ছাড়া কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিয়ের আসর থেকে বিবাহ সম্পন্ন হতে না দিয়েই নজরুল উঠে পড়লেন এবং তারই সঙ্গে তাঁদের কান্দিরপাতড়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন সেই ঝড়-জলের রাতেই। কয়েক দিন পর মুজাফফর কলকাতা থেকে কুমিল্লায় গিয়ে নজরুলকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন।
কিন্তু এমন অকাট্য সাক্ষ্য থাকা সত্বেও দু' বাংলার কিছু মুসলমান লেখক আদাজল বলে থাকেন যে নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল। তবে তাঁদের লেখায় বিয়ের চুক্তিপত্র বা অন্য কোনও সাক্ষ-প্রমান তাঁরা দাখিল করতে পারেননি। নার্গিস ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৩৮ সালে নার্গিস বিয়ে করেন । এতগুলো বছরের মধ্যে নার্গিসকে দিয়ে কোনও লেখক বলাতে পারেননি যে ১৯২১ সালে নজরুলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল।
১৯৩৭ সালে নজরুলকে নার্গিস একটা চিঠি লেখেন। চিঠি প্রাপ্তির সময় সেখানে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। নজরুল তাকেই চিঠি পড়তে বলেন। চিঠি পড়া শেষে শৈলজানন্দ নজরুলকে উত্তর লিখতে বলেন। নজরুল একটি গান লিখে দেন।
যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।
আমি গান গাহি আপনার দুখে,
তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মত ডাকিও না আর
নিশীথ অন্ধকারে।
দয়া কর, মোরে দয়া কর, আর
আমারে লইয়া খেল না নিঠুর খেলা;
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না সেই
শুভ লগনের বেলা।
আমি ফিরি পথে, তাহে কর ক্ষতি,
তব চোখে কেন সজল মিনতি,
আমি কি ভুলেও কোন দিন এসে দাঁড়িয়েছি তব দ্বারে।
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।
বিয়েটা সুসম্পন্ন হয়েছিল কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর"।কারন তাঁরা একদিনের জন্যেও সংসার করেন নি একথা অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য।
এই নিয়ে বিতর্কের মূল কারন হয়ত অন্যরকম।আসলে কয়েক জন নজরুল জীবনীকার তাঁদের ধর্মীয় সংস্কার বসত বোধ হয় পরবর্তী কালে নজরুলের হিন্দু রমণিকে বিয়ে করার বিষয়টি হজম করতে পারেননি। তা-ও আবার নজরুল সেই রমণীকে মুসলমান না করে শাঁখা সিঁদুর সহ তাঁর নিজের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে থাকতে দেওয়ায় মুসলমান জীবিনীকারদের বদ হজমের মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল হয়তো। সেই জন্যই মনগড়া ধারণা নিয়ে তাঁরা অন্তত চাইবেনই যে হিন্দু রমণী বিবাহের আগে নজরুল অন্তত এক জন মুসলমান রমণীর পানি গ্রহন করে শুদ্ধ হয়ে ছিলেন। এই মনোভঙ্গি থেকেই নজরুলের বিয়ে নিয়ে এতো বিভ্রাট"।
নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে ভেঙ্গে যাবার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর কুমিল্লার আশালতা সেন গুপ্তা ওরফে প্রমিলার সাথে নজরুল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আশালতা হলেন বিরজা সুন্দরীদেবীর দেওয়রের মেয়ে। নজরুল বিরজা সুন্দরীকে 'মা' বলে সম্বোধন করতেন। বিরজা সুন্দরী দেবীর গভীর স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠেন নজরুল। আর একথা বলা উল্লেখযোগ্য যে আলী আকবর খানের মাধ্যমেই কিন্তু এই সেন বাড়ির সঙ্গে ১৯২১ সাল থেকে নজরুলের জানাশোনা।
১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতায় বিয়ে হল নজরুলের সঙ্গে আশালতা র । বিয়ের অনুষ্ঠান হয় বেনিয়াপুকুরের ৬ নম্বর হাজি লেনে সম্পূর্ণ নতুন রীতিতে। বিয়ের আগে বা পরে স্ত্রীকে নজরুল ইসলাম ধর্মে অন্তরিত করেননি। তাই যে- ইসলামি প্রথা মেনে মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের বিয়ে হয় নজরুলের ক্ষেত্রে সেই প্রচলিত রীতি পালন করা হয়নি। 'আহলে হাদিস' মতে এক বৈবাহিক চুক্তি অনুসারে নজরুলের বিয়ে হয়। তাতে ধর্ম বদলের প্রয়োজন হয়নি। "তবে বিয়ের পর নজরুল স্ত্রীর নতুন নাম দেন প্রমীলা। কে জানে মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যে প্রমীলা নামের এক অনার্য নারির মুক্তি চেতনাকে যে ভাবে সর্ব প্রথম বাংলা সাহিত্যে মহিমান্বিত করা হয়, বিয়ের পর নজরুলের মনে সে রকম কোন ভাবনা কাজ করেছিল কি না"? ছোট বেলায় তার স্ত্রীর ডাক নাম ছিল দুলি। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর নাম হয় আশালতা। আর বিয়ের পর হয়ে যান প্রমীলা। 'নারীর যে স্বাতন্ত্র নাই' এ কথা কালীদাসের লেখাতেও বলা হয়েছে। খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতকে, কতকাল আগে। বিয়ের আগে বাবার এবং বিয়ের পর স্বামীর পরিচয়ে চিহ্নিত হয় ভারতীয় নারী। নজরুল এ নিয়মও ভাঙার প্রয়াসী ছিলেন।
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের দ্বারা প্রভাবিত নজরুল নারীর স্বাধীন সত্ত্বাকে আলাদা সম্মান করতেন। 76 বছরের জীবনে মাত্র চৌত্রিশ বছর কথা বলেছেন ঠিকই কিন্তু তাতেই রেখে গেছেন অসাধারণ মতবাদ যা প্রতিটি বর্তমান ও আগামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করবেই..... বিপ্লবের চিরাগকে জ্বালিয়ে রাখবে মনের অন্দরে।
তথ্যসূত্র:
1.কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা’ – কমরেড মুজফ্ফর আহমদ
2 .bn.m wickepedia .org