–গত ৭.৪.২০১৮ কলকাতায় বাংলা কবিতা ডটকম আয়োজিত ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী কবিতা সম্মেলন ২০১৯, এ প্রদত্ত বক্তৃতা---
বিষয়-- “ বাংলা কবিতা ও বিপ্লব” , বক্তা- প্রবীর দে
কবিতা ও বিপ্লবের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক তা অত্যন্ত নিবিড় এবং সে সম্পর্ক পারস্পরিক নির্ভরতার ।বিপ্লব কবিতার অন্যতম উৎস ।অপর দিকে কবিতা বিপ্লবের ধারক ও বাহক।কবিতা বিপ্লব দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত স্বল্প পরিসরে তাঁর অনুসন্ধান আলোচনার বিসয়বস্তু।
কবিতা হল কবির উপলব্ধিজাত এক বিশেষ শিল্প ভাবনার বহিঃপ্রকাশ যা কবির বাস্তবতা বোধের উন্মোচন। কবিতা মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, কবিতা মানুষকে প্রতিবাদী হতে সাহায্য করে,কবিতা চিন্তাকে জাগ্রত করে, প্রেরণা দেয়।
আর সাধারন অর্থে বিপ্লব হল রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন যেখানে জনগণের চেতনার জাগরণ ঘটে । বিপ্লব সেখানে শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধন নয়, সংস্কৃতিগত,অর্থনীতিগত,সামাজিক, কবিতার প্রকৌউশল্গত পরিবর্তন সাধন।
কবিতা ও বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য পারস্পরিক সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করার আগে একটা কথা বলে নিই,আমার আলোচ্য বিষয় কিন্তু শুধু বাংলা কবিতাতেই সীমাবদ্ধ।
বিপ্লব হচ্ছে চেতনার নির্মাণ এবং নির্মিত চেতনার সফল বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া, যা স্বল্প সময়ে অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারে কিংবা অতি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। বিপ্লবের সংশ্লিষ্টতা রাজনীতি বা সমাজ সংস্কারের সাথে অধিকতর জুৎসই হলেও মনোবৃত্তিক কর্মকাণ্ড - ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রেও বিপ্লব ততোটাই কার্যকর এবং জীবন্ত। বিপ্লব ঘটেছে বলেই বাংলা সাহিত্য তার আদি যুগ ছেড়ে ক্রমান্বয়ে ক্রমঃউৎকর্ষে উত্তরাধুনিক ও পরাবাস্তবতায় এসে পৌঁছেছে। ১৯০৭ সালে নেপাল রাজদরবারের সংগ্রহশালা হতে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কারও তোবাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বড় বিপ্লব। কবি চন্দ্রাবতী ,সুফিয়া কামালের লেখনী দ্বারা যে নারী মুক্তির বীজ বোনা হয়েছিলো ,সেও তো বিপ্লব-ই ।
দেশের ভেতরের বা বাইরের ঘটিত সামাজিক বিপ্লব বা রাজনৈতিক বিপ্লব যেমন কবিতাকে প্রভাবিত করে আবার কবিতার হাত ধরে বিপ্লব সংঘটিত হয় ।১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের চেতনা বিশ্বে যে নতুন সমাজপ্রবাহের সৃজন ঘটিয়েছিলে, সেই চিন্তাস্রোতের মানবিক আকুতি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ ঘটেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ফ্যাসিবাদীদের বিরোধিতা করতে দেখা যায় । এই চিন্তা তাঁর শেষ জীবনের সৃষ্টিগুলোর মাঝে বারবার প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। তাঁর বেশ কিছু কবিতায় এর প্রমাণ মেলে। যেমন: পুরাতন ভৃত্য, দুই বিঘা জমি, এবার ফিরাও মোরে, ঐক্যতান, বাঁশি ও ওরা কাজ করে ইত্যাদি কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথের সাম্যবাদী চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে।
২
এরপর তেজদীপ্ত উচ্ছ্বাস নিয়ে কবিতায় বিদ্রোহের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে এলেন কাজী নজরুল ইসলাম। দুর্দশায়। শোষক গোষ্ঠী সর্বদা শোষিতকে শোষণের যাঁতাকলে রেখেছে পিষে ,তাঁর কবিতা সেই শোষণের বিরুদ্ধে সমাজকে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছিল। ।
এরপর তিরিশ ও চল্লিশের দশক সময় ধরে সাম্যবাদী চেতনার উৎসারণ-এর ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে দেখা যায়। সেই সময় বিষ্ণু দে, সমর সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্র, কামাক্ষী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ কবি বাংলা কবিতার ভুবনে মার্কসীয় চেতনার দ্বারা সাম্যবাদের জয়গান গাইলেন। তিরিশের দশকে বাংলা কবিতা্য় নভেম্বর বিপ্লবের ছোঁয়া লেগেছিল ব্যাপক ভাবে যা কিনা সামাজিক বিপ্লবকে সুচিত করেছিল এবং সে সামাজিক বিপ্লব চেতনা রাজনৈতিক বিপ্লবকে অক্সিজেন জুগিয়েছিল শুধু কবিতার হাত ধরে। এই সময় কবি নজরুলের হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে ঐ নভেম্বর বিপ্লবের আবাহনী রচিত হয় তাঁর মুক্তি কবিতা দ্বারা।কাজী সাহেব তখন বাঙালি পল্টনের সৈনিক রুপে করাচীতে কর্মরত। শুরু হল এদেশের আর এক সামাজিক বিপ্লব। এই বিপ্লবের বাতাবরণেই নজরুল তাঁর সৈনিক বৃত্তি ত্যাগ করে সাহিত্য কর্মকে পেশা হিসেবে গ্রহন করেন। তাঁর কবিত ,গান এদেশের বিপ্লবকে যথেষ্টই প্রভাবিত করেছিল।নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব পরেছিল তাঁর একাধিক কবিতায় – বিদ্রোহী,সাম্যবাদী,ফরিয়াদ ,আমার কৈফিয়ত ,সর্বহারা, প্রভৃতি ।
বাংলা কবিতায় সে সব কবি সাম্যবাদী চেতনা ধারণ করে উদ্ভূত বাস্তবতাবোধ, মানবপ্রীতি ও নিগৃহীত মেহনতী মানুষের কথা তুলে ধরেছেন এবং কবিতায় সাম্যবাদী চেতনায় ঐক্যের সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছেন তাদের কবিতা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই, তবে প্রথমেই যে লাইনগুলি মনে পড়ে যায়—‘সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। কবি কামিনী রায়ের ‘সুখ’ কবিতার উপর্যুক্ত এই লাইন দুটি আমাদের অবলীলায় সাম্যবাদের সহজ অভিব্যক্তি প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। পৃথিবীতে বর্ণবাদ, ধনী-নির্ধন, উঁচু-নিচু, জাতিত্ব সংস্কার, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতির চেয়ে মানবতা ও মানব সত্যের স্থান অনেক ওপরে। এই কবিতা আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।
৩
সাম্যবাদী জীবনের চেতনায় ঔপনিবেশবিরোধিতা এবং জাতীয়তাবাদ নজরুলের মধ্যে মহত্ত্বর বোধে চালিত হতে পেরেছে। নজরুল তাঁর কাব্যজীবনের প্রারম্ভ থেকেই হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অভিন্ন বলয়ে স্থাপন করতে পেরেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাতাস যখন তীব্র হয়ে উঠল , নজরুল তখন বাঙালি জাতির সামনে নিয়ে এলেন মানবতাবাদের শাশ্বত বারতা। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বল মরিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’ তার ভাবনায় সমুন্নত ছিল মানবজাতির ঐতিহ্য। এও ত এক বিপ্লব যা এসেছিল কবিতার হাত ধরে।
নজরুল পরবর্তী ত্রিশের দশকে এসে সাম্যবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত অন্যতম কবি হচ্ছেন বিষ্ণু দে। বিষ্ণু দে তাঁর কবিতার উপজীব্যে তাত্ত্বিকাতায় ও প্রকরণে মার্কসীয় সাম্যবাদী দৃষ্টির আলোকপাত করেছিলেন।
ত্রিশের দশকের শেষ সময়ের আরেক কবি সাম্যবাদী চেতনা নিয়ে কবিতাচর্চায় যিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন যে, আমি রোমান্টিক কবি নই, মার্কসিস্ট তিনি হলেন কবি সমর সেন। এরপর এলেন পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। রাজনীতিবিদ ও কবির বিরল এক সমন্বয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়।‘পদাতিক’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘সকলের গান’। পাঠককেও তিনি একজন কমরেড ভাবেন বলেই ‘পদাতিক’ কাব্যের প্রথম উচ্চারণ ‘কমরেড’।
কমরেড, আজ নতুন নবযুগ আনবে না?/কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।/লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা-
দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে, /কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?
‘ছাড়পত্র’ খ্যাত সুকান্ত ভট্টাচার্য রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর যুগের তরুণ কবি। যিনি বিপ্লবী কবি এবং গণজাগরণের কবি। যিনি সমাজতন্ত্রের আদর্শের কবি। সাম্যবাদে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। যিনি নজরুলের মতোই তার কাব্যে উচ্চারণ করে গেছেন অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সংগ্রামের শব্দমালা। যিনি বিপ্লব ও গণমানুষের মুক্তির পক্ষের সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন বারবার।
সাতচল্লিশোত্তর কালে বাংলা কবিতা বিকশিত হয়েছে অমোঘ গতীতে ভিন্ন মাত্রায়। সত্তরের নকশাল আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত বিপ্লবকে কবিতার সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল নিপুণ ভাবে। আবার বাংলাদেশের কবিতায় মুখ্যত প্রাধান্য পেয়েছিল মানুষের জীবনসংগ্রাম-দেশপ্রেমের ছবি, মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামের ছবি।'ওরা শুধুমাত্র মাতৃভাষা রক্ষার দাবীতে কবিসত্বা ও কবিতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আপামর বাঙ্গালীর কাছে কবিতা দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিতে পারে - মোদের গরব মোদের আশা/আ-মরি বাঙলা ভাষা।
যে কোন শিল্প- সংস্কৃতি- সাহিত্য কোন না কোন শ্রেনী স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে। এটা যেমন শোষক বা শাসকের জন্য সত্যি, তেমনই নিপীড়িত মেহনতি মানুষের জন্যও সত্যি।শ্রেণি সংগ্রামের বিকাশের এক একটা স্তরে যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটা খুব আশু কর্তব্য হিসাবে সামনে চলে আসে,তখন শিল্প –সাহিত্যকেও সেই বিশেষ স্তরকে শুধু ছোঁয়া নয় এগিয়ে নিয়ে যাবার সাহস জোগাতে হয়। বিপ্লব যে বিভিন্ন মুখি , বিপ্লব যে চেতনার আয়না ,তাই বিপ্লব চলবেই আর কবিতাও তার হাত ধরে প্রবাহিত হবে অনন্তকাল ধরে।
* প্রবীর দে ৭.৪.২০১৯
সংরক্ষিত