জাবেদ বিয়ে করেছে বেশী দিন হয়নি। এর মধ্যেই সংসারের বিভিন্ন বিষয় তাকে প্রচণ্ডভাবে ভাবাতে শুরু করেছে। আগে যখন আব্বা আম্মা বিভিন্ন বিষয়ে বলতো- বিয়ে কর তারপর বুঝবি সংসার কি! তখন মনে হতো এটা এমন কি কঠিন বিষয় যে বিয়ে করার পরে বুঝতে হবে। কত জটিল দর্শনের মীমাংসা করেছে জীবনে। তবে আজকের সকালটা প্রতিদিনের মতো নয়। আজ ঘুম ভেঙেছে নাজমার আদর পেয়ে। নাজমা তাকে একটা সুসংবাদ দিয়েছে। বলেছে- তুমি বাবা হবে। আর আমি মা হবো। আমাদের সংসার আনন্দে ভরিয়ে দিতে একটা ফুটফুটে শিশু আসছে। জাবেদ আনন্দে নাজমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে এমন একটা খবর দেয়ার জন্য আজ অফিস থেকে ফিরে নাজমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যাবে। এরপর জাবেদ তৈরী হয়ে সকালের নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। অফিসটাও অনেক দূরে। সরকারী চাকরীর এই একটা সমস্যা। বছর দুবছর পরপর একবার করে জায়াগা বদলাও। আরে একটা মানুষ একটা জায়গায় একবার নিজেকে মানিয়ে নিতেইতো সাত বছর লেগে যায়। আর সরকার কেন যে দুই বছর পরপর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি করে কে জানে। ব্যবস্থাপনার বইতে এটাকে প্রেষণা হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর বাস্তবে এটা একটা বড় যন্ত্রনা। চট করে বাসাও পাওয়া যায় না। নয়তো বাসাটা পাল্টাতো। এ সময় গাড়িতেও প্রচণ্ড ভীড় হয়। আজকে রাস্তায় এসে অবাক হয়ে গেল সে। একটা খালি গাড়ি ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় দাঁড়িয়ে একটা ছেলে হাক ছেড়ে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করছে। অন্যরা লক্ষ্য করার আগেই দ্রুত উঠে গেল সে। গাড়িটা বেশ চমৎকার চালিয়েছে চালক। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কর্মস্থলে পৌঁছতে পারল। সরকারী অফিসের এটা আরেকটা বড় সমস্যা। নচিকেতার গানের মতো ১২টায় অফিস আসি ২টায় টিফিন। এখন অবশ্য অনেক ঠিক হয়ে গেছে। সে খেয়াল করল আজকে সকাল থেকে সবকিছু কেন যেন ঠিকমতোই হচ্ছে। এ সময়টাতে সবচেয়ে বেশী যাঁর কথা মনে পড়ে তিনি আর কেউ নন, মহা পরিকল্পনাকারী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী পরম করুণাময় মহান স্রষ্টা যার অশেষ করুণায় আমরা এই জীবন পেয়েছি। অফিসে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বেশ ভালো ব্যবহার করল। রাতে তারা বাইরে একটা ভালো রেস্তোরাঁতে খেল। স্রষ্টার প্রতি এক অসীম কৃতজ্ঞতায় তার দুচোখ ভিজে গেল। তিনি চাইলে মানুষকে কত সুখ দিতে পারেন!
পরদিন শুক্রবার তারপর শনিবার দুইদিন বন্ধ। এইটা একটা ভালো কাজ হয়েছে। সপ্তাহে অন্তত দুইটা দিন বন্ধ থাকা দরকার। জুম্মাবারে সবকিছু পরিস্কার করে গোসল সেড়ে নামাজ পড়তেইতো দুপুর হয়ে যায়। একবার আব্বা আম্মাকে দেখতে যাওয়া দরকার। খবরটা নাজমা ওদের জানিয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করেনি। বিয়ের আগে বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করেই বাড়ির দিকে ছুটত। ড্রাইভাররাও সুযোগ বুঝে দ্বিগুন ভাড়া চাইত। মনে হয় এখানকার মানুষ স্বভাবতই সুযোগসন্ধানী। নয়তো যখন মানুষের বেশী প্রয়োজন তখন কেউ সেটার সুযোগ নিবে কেন। অর্থনীতি চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য তত্ত্ব দিয়ে এই বিষয়টা বৈধ করে দিয়েছে। এসব তত্ত্ব যারা দেয় তারা বোধ হয় তথ্যটা ঠিকমতো সংগ্রহ করে না অথবা এরকম সমস্যার মুখোমুখি হয় না। বিয়ের পর অবশ্য শুক্রবার বিকেলে অথবা বন্ধের দিন বাড়ীতে যায়। তাই খুব একটা সমস্যা হয় না। আসলে আমরাও কেমন। যখন যেখানে ভীড় বেশি তখন সেখানেই ছুটছি বেশি। কেন! একটু আগে পরে করলে কী হয়! জাবেদতো প্রায়ই বড় অনুষ্ঠান, মেলা, মেজবান এসব ঝামেলায় থাকতেই চায় না। নাজমাও সেরকম। বলে পরে একসময় গিয়ে দেখে আসবো। ও যদি অন্যদের মতো হতো তাহলে জাবেদের কষ্টের সীমা থাকতো না। ওকে দেখলে মনে হয়- আল্লাহ আমাদের জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছে। অবশ্য কেউ যখন একাধিক বিয়ে করে তখন অন্য কথা। ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান সব মাথার মধ্যে নিজেদের একেকটা জগৎ তৈরী করে নিয়েছে। এরাই সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মনোবিজ্ঞানীরা এটাকে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে চালিয়ে দেয়। কিন্তু একটা মানুষের জন্য এ অস্থিরতা কখনো কখনো বড় ধরণের সমস্যাও করতে পারে। মৌলানারা বলে এতে ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। কী জানি। মাথাটা মাঝে মাঝে ঠিকমতো কাজ করে না। কম্পিউটার হলে বন্ধ করে আবার চালু করলে ঠিক হয়ে যেত। মানুষের মন, চিন্তা, চেতনা এসবের উপর কি মানুষের নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ আছে! না কি স্রষ্টার ইচ্ছায় তা পরিচালিত হয় কে জানে।
শুক্রবারে যাত্রী কম হয় তাই গাড়িটা পথে পথে লোক নেয়ার জন্য দাঁড়াচ্ছে। একটা বড় চায়ের দোকানে অনেকে বসে নাস্তা করছে আর টিভি দেখছে। একটা হিন্দী গান শোনা যাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে আমাদের প্রজন্মরা বাংলার আগে হিন্দী শেখে। এভাবে সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস করে মানুষের স্বকীয়তা। দজ্জালের মতো মিথ্যা বেহেশত দেখিয়ে প্রতারণা করে মানুষের সাথে। উদারপন্থীরা অবশ্য বলে ভালো মন্দ দুটোই থাকুক। হাঁসের মতো ভালোটাই বেছে নিতে শিখতে হবে। কথাটা বেশ চমৎকার। কিন্তু ভালো মন্দ নির্বাচনের শিক্ষাটাতো থাকতে হবে। পাশের লোকটার মাথা ঘুমে ঢলে পড়েছে জসীমের কাঁধে। কী নিশ্চিন্তে মুখ হা করে ঘুমোচ্ছে। তবুও মসনবী শরীফে মওলানা জালাল উদ্দীন রুমী লিখেছেন- মানুষের উঠিতে চিন্তা, বসিতে চিন্তা, খাইতে চিন্তা, ঘুমাইতে চিন্তা। চিন্তা ছাড়া মানুষ হইতে পারে না। অথচ অধিকাংশ মানুষ জানেই না তাদের কি চিন্তা করতে হবে। যাই হোক লোকটাকে জাগাতে হবে। নামার সময় হয়ে এল। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ীর জন্য কিছু খাবার কিনতে ঢুকল একটা দোকানে। সুমন আগে এসেই অপেক্ষা করছিল। মাধ্যমিক পর্যন্ত একসাথে পড়েছে ওরা। দুর্দান্ত মেধাবী একটা ছেলে। জাবেদ প্রথম এবং সুমন দ্বিতীয় এটা অবধারিত সত্য ঘটনা ছিল ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত। তবে ধর্ম বিষয়ের নাম্বারটা বাদ দিলে সুমনই বেশি নাম্বার পেত। হিন্দু ধর্মের শিক্ষকরা নাম্বার দিতে বেশি কার্পণ্য করে। সে তুলনায় মৌলবীরা অনেক ভালো। বেশি বেশি নাম্বার দেয়। ভিন্ন ধর্মের হলেও দুজনের ছিল মানিক জোড়। প্রতিযোগিতাও ছিল। একজন দশঘন্টা পড়লে অন্যজন এগার ঘন্টা। এমনটাই চলত। দুজনই বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়ায় মুক্তচিন্তার অধিকারী ছিল। খুব একটা ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। কুসংস্কারগুলো ওরা এড়িয়ে যেত। বিচার বিবেচনা, আলাপ আলোচনা করে যে কোন বিষয়কে গ্রহণ করা বা বর্জন করার মানসিকতাও তৈরী হয়েছিল ওদের মধ্যে। এটাই এখনো জাবেদকে সবক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযোগিতা করে। পরমত প্রণিধানযোগ্য স্রষ্টার এই অমোঘ বাণী ভুলে গিয়ে আমরা পরমত সহিষ্ণুতার বদলে বড় বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি। মহামহিম স্রষ্টা এতে কী রহস্য রেখেছে কে জানে।
সুমন অনেক আগে বিয়ে করেছে। পারিবারিক ভাবে তার মা বাবা পছন্দ করে কোষ্ঠী মিলিয়ে তার চেয়ে দশ বছরের ছোট এক মেয়েকে নিয়ে এসেছে বৌ করে। বিয়েতে সে কী কাণ্ড! রাতভর মন্ত্র পড়ে যজ্ঞ করে সাতপাকে বাঁধা পড়ল দুজনে। তারপর কড়ি খেলা, আংটি লুকানো, বাসি বিয়ে, ফুলশয্যা কত নিয়ম কানুন। সবকিছুতেই অন্য সবার মতো জাবেদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। সে যে ওদের ঘরের আরেক ছেলে। হোক জাত ভিন্ন। মনতো ভিন্ন নয়। রক্তও তো সেই একই রঙের। একবারতো জাবেদ দুর্ঘটনাই পড়ে মরতে বসেছিল। সুমনই তাকে হাসপাতালে নিয়ে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে এনেছে। সেই থেকে ওরা রক্তের ভাই। দুজনের রক্তই এ পজেটিভ। কী অদ্ভুত মিল। পুজোর সময় জসীম কোন কিছু ছুঁতে না চাইলে সুমন বলতো কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত। কোন ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হয় জগন্নাথ। জাবেদ সুমনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতো পৃথিবীর সব মানুষ তোর মতো হয়না কেন। তাহলেতো এতো ভেদাভেদ থাকতো না। এত দাঙ্গা এত রক্তের বন্যা দেখতে হতো না। এতো মন্দির এতো মসজিদ ভাঙতো হতো না। ঈদের সময় জাবেদের আব্বা জাবেদের জন্য যেমন সুমনের জন্যও তেমন কাপড় কিনে আনতো। ঈদ-উল-আযহার সময় সুমনের জন্য অন্তত একটা মুরগী জবাই করতো জাবেদদের ঘরে। সুমনের হাতে ওষুধের প্যাকেট দেখে জাবেদ জানতে চাইল অসুখ কার। সুমন জানাল তার ছেলের কাশি। তাই ডাক্তারের পরামর্শে এ্যম্বোলিট সিরাপ নিয়েছে। লতকাশ। একটানা কাশতে থাকে। এটা অবশ্য সুমনের কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। শুনেছিল হোমিওপ্যাথিতে এর চিকিৎসা আছে। ইপিকাক মাদার টীংচারটা খাওয়ালে চলে যায়। একজন ভালো হোমিও ডাক্তারের সাথে আলাপ করতে হবে। আগে অনেক কবিরাজ ছিল। ওরা একধরণের ভেষজ ব্যবহার করতো যাতে এরকম কাশিও কমে যেতো। এখন ঔষধ সাম্রাজ্যবাদের ফলে কবিরাজী, ইউনানী, আয়ুর্বেদী চিকিৎসক নাই বললেই চলে। চিকিৎসকরা নিজেদের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে অসুস্থকে সুস্থ করার কথা ভাবলেই বোধহয় মানুষের কষ্ট অনেক কমে যেত। যাদের কাজ সেবা করা তারা যদি ব্যবসা করে তবে একটা সময় স্রষ্টার অভিশাপ তাদের উপর অবশ্য নেমে আসবে। এই কারণে এখন মানুষ ডাক্তারের উপর আস্থা হারিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্য চলে যাচ্ছে।
বউ কেমন আছে জানতে চাইলে সুমন বলল- সুমি সুস্থ আছে। চাকরি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। যে দুইদিন বন্ধ থাকে সেটা ওর ঘুমে কেটে যায়। সিংহ রাশির মেয়েতো, তাই খুব বাস্তববাদী। জায়গা, জমি, বাড়ি, গাড়ি, গয়না, টাকা এসব ছাড়া অন্য কিছুই বোঝে না। যথেষ্ট সন্দেহপ্রবণ। কিছু বললেই বলে সব মেয়েরাই নাকি এরকম। তাদের স্বামীকে সন্দেহ করে। এটা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তুলারাশির ছেলেদের নাকি একদম বিশ্বাস করতে নাই। ওরা বিশ্বপ্রেমিক। যাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। আচ্ছা জাবেদ তুই বল আমি এত অনুষ্ঠানে গান গাই, কবিতা লিখি, নাটক করি কোনদিন আমাকে অন্যায় কিছু করতে দেখেছিস। ছেলে মেয়ে আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাইকে আমরা মানুষ হিসেবে দেখি। তাই কেউ কোন সহযোগিতা চাইলে তাকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। এটা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। ও সেটা একেবারে সহ্য করতে পারে না। ওর কাছে কাজ মানে হচ্ছে অর্থের মাপকাঠিতে যার একটা বিনিময় মূল্য থাকবে। ও মন্দিরে ভোগ দেবার সময়ও কড়ায় গণ্ডায় হিসেব করে নেয়। তবে একটা বিষয় কি! আমার মতো উদাসীন ছেলেকে সংসারের শৃঙ্খলে বাঁধার জন্য এমন মেয়ে না হলে সংসার টিকতো না। ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো আমার সাথে তিনদিনও সংসার করতে পারতো না। সৃষ্টিকর্তা যা করে তা ভালোর জন্যই করে। তিনি সব আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন। নয়তো এতো জায়গায় অনুষ্ঠান করতে গেলাম। এত মেয়ের সাথে পরিচিত হলাম। শুধু ওদের গ্রামে যাওয়া হয়নি। ওর সাথেও কখনো দেখা হয়নি। কিভাবে যে বিয়েটা হয়ে গেল বুঝেও উঠতে পারিনি। দেখতে দেখতে ছেলেটারও চার বছর হয়ে গেল। স্রষ্টার কী ইচ্ছা কী লিখেছে ওর ভাগ্যে কে জানে!
ওরা দুজন প্রথমে জাবেদদের বাড়ীতে গেল। সালাম করলো আব্বা আম্মাকে। আব্বা আম্মা প্রাণভরে দোয়া করলো দুজনকে। জাবেদের মনে পড়ল অফিসের সামনে মাইকে একটা গান প্রায় শুনতে পায়। তোমরা কোনদিনও মায়েরই মনেতে কষ্ট দিও না। মায়ের মনে কষ্ট দিলে খোদা যে সবে না। লাইন দুটি স্মরণ হওয়ায় সে ভাবলো সে কি অজান্তে তার আব্বা আম্মাকে কোন কষ্ট দিয়েছে। আব্বার প্রশ্নে ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল। বউমা কেমন আছে? জাবেদ বললো ও ভালো আছে। তবে এবার তোমাদের ওখানে নিয়ে যাব। অভিজ্ঞ মানুষ না থাকলে সমস্যা। আম্মা বলল- কেন বউ কি অন্তস্বত্ত্বা? জাবেদ একটু হাসলো। আম্মা বুঝতে পেরে বললো ঠিক আছে আমরা এদিকটা গুছিয়ে নিই। তুই আগামী সপ্তাহে আসলে তখন একবার যাবো। এরপর মায়ের বানানো নাস্তা খেয়ে সুমনদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সেখানে গিয়ে সুমনের বাবা মাকে প্রণাম করে তাঁদের আশীর্বাদ নিল। সবার আশীর্বাদই মনে হয় তাকে বিভিন্ন বিপদে রক্ষা করে।
নাজমার কথা জেনে সুমি জাবেদকে অনেক পরামর্শ দিল। বলল- তোমার ভাইতো আমাকে একদম সময় দিতো না। রাজ্যের যত কাজ সব ওকেই করতে হবে। এসময় একটা মেয়ে তার বরকে সবসময় পাশে দেখতে চায়। সে জ্ঞানটুকুও তোমার বন্ধুর নেই। ও বাবা হয়েছে কোন কষ্ট না করে। আমার কথা বাদই দিলাম ছেলের জন্য পর্যন্ত একটুও মায়া নেই। সংসারী না হয়ে সন্ন্যাসী হলেই ভালো হতো। কেউ আর ওকে জ্বালাতন করতো না। তারপর বল ঠাণ্ডা না গরম কোনটা খাবে। জাবেদ বলল কোনটাই না। এইমাত্র বাড়ী থেকে খেয়ে বেরিয়েছি। চলে যেতে হবে। নাজমা বাসায় একা। তাড়াতাড়ি না গেলে দুশ্চিন্তা করবে। সুমি বলল- ঠিক আছে ভাই তোমাকে আটকাবো না। আমিতো পাই নি। তাই বুঝি, না পাওয়ার বেদন। কবি বলেছেন- চিরসূখী জন, ভ্রমে কি কখন, ব্যাথিত বেদন বুঝিতে পারে! প্রার্থনা করি যেন নতুন অতিথি সুন্দরভাবে ধরাধামে আসতে পারে। তিনি চাইলে পঙ্গুও গিরি লঙ্ঘন করতে পারে।
জাবেদ আর দেরী না করে বাসায় ফিরে এলো। প্রতিমাসে নাজমার চেকআপ ঠিকমতো চললো। ডাক্তার পুণম দেখছে। তিনি ডেলিভারী বিষয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। শেষদিকে এসে নাজমা প্রায় জাবেদকে অফিসে যেতে দিতো না। বলতো আমার ভয় করছে। কিসের ভয় জিজ্ঞেস করলে বলতো জানি না। জাবেদের আম্মার কথায় ফকিরের পানি পড়া খাওয়ানো হলো। কাজ হলো না। ডাক্তার বললো অনেক সময় মানসিক চাপ থেকে গর্ভবতীর এ রকম লক্ষণ দেখা দেয়। কারো কাছে শুনেছে মা হওয়া অনেক কঠিন। সেই অভিজ্ঞতাটা বারবার মনের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। হালকা ঘুমের ঔষধ দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। প্রেসার বেড়ে গেছে। নাজমা প্রায় বলে- আমি যদি না বাঁচি তুমি আমার মেয়েকে দেখো। জাবেদ বলে- তোমার কিছুই হবে না। আর মেয়ে হবে তোমাকে কে বলেছে। নাজমা বলে- আমি জানি। আমার একটা মেয়ে হবে। আর আমি ডেলিভারীর সময় মারা যাবো। নাজমার কথা শুনে জাবেদ প্রচণ্ডভাবে ভেঙ্গে পড়ে। সে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় আল্লাহ তুমি মেহেরবান। আমার জান নিয়ে হলেও তুমি আমার নাজমাকে রক্ষা করো। নাজমা নামাজে বসে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে বলে হে আল্লাহ তুমি আমার গুণা মাফ করে দাও। আমার স্বামীকে সকল মুছিবত থেকে রক্ষা করো। তাকে আমার মৃত্যুযন্ত্রনা সহ্য করার শক্তি দাও। আমার মেয়েকে তোমার হেফাজতে রেখে যাচ্ছি। পরের শনিবার ঠিক তিনটায় লেবার রুমে নাজমা জন্ম দিল এক ফুটফুটে কন্যা শিশু। ডাক্তাররা সাধ্যমতো চেষ্টা করলো নাজমাকে বাঁচাতে। কিন্তু পারলো না। ডাক্তার পুণম প্রায় কেঁদেই ফেলল তাঁর এই অপারগতায়। বাইরে যখন খবর গেল তখন আনন্দের চেয়ে কান্নার শব্দই বেশি শোনা গেল। জাবেদ নিজেকে প্রশ্ন করলো আমি কি এমন অপরাধ করেছি যে আল্লাহ আমার ফরিয়াদ শুনল না। হঠাৎ তার কানে শব্দ ভেসে এল অন্যরা কেউ শুনল কি না জানে না তবে সে স্পষ্টই শুনলো- তোমরা যা জান না, আমি তা জানি। নিশ্চয় আমার সবকিছু তোমাদের ভালোর জন্য। জগতে যত ঘটনা ঘটছে একমাত্র আমিই তার নিয়ন্ত্রক। তোমাদের চারপাশে যা দেখছো, যা শুনছো, যা করছো সব আমিই পরিচালনা করছি। অতএব আমার উপর আস্থা রাখ। জাবেদ এগিয়ে গিয়ে তার মেয়েকে কোলে তুলে নিল।