মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
রবীন্দ্রনাথের 'মানসী ' পর্বের কবিতায় মাত্রাবৃত্তের আবিষ্কার। কবির কথায়, " যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।"
এই ছন্দে যুক্ত অক্ষরকে দুটো অক্ষরের সমান ধরা হয়।তাই দুই মাত্রা পায় একটি যুক্তাক্ষর।
রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুন কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা।
ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল ,
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল ।
চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায় ,
বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায় ।
স্পন্দিত নদীজল ঝিলিমিলি করে ,
জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি বালুকার চরে ।
এখানে যুক্তাক্ষরগুলোকে ভেঙে ভেঙে পড়তে হবে।ফাল্গুন হবে ফালগুন।এখানে চারটি অক্ষর।তাই চার মাত্রা পাবে ফাল্গুন শব্দটি।এভাবে কাঞ্চন হবে কানচন।৪ মাত্রা পাবে।পুন্ জিত আমরোমুকুল একই ভাবে আসবে।
ছন্দ বিশ্লেষণ :-
ফাল্গুনে /বিকশিত-(৪/৪) কাঞ্চন /ফুল ,(৪/২)
ডালে /ডালে/ পুঞ্জিত-(২/২/৪)আম্রমুকুল ।(৬)
চঞ্চল /মৌমাছি (৪/৪)গুঞ্জরি /গায় ,(৪/২)
বেণুবনে /মর্মরে (৪/৪)দক্ষিণবায় ।(৬)
স্পন্দিত /নদীজল-(৪/৪)ঝিলিমিলি করে ,(৪/২)
জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি-(৪/৪)বালুকার চরে ।(৪/২)
'স্পন্দিত' শব্দটাকে লক্ষ্য করুন।এটা ৪ মাত্রা পেয়েছে। ৫ মাত্রা পায়নি।যদিও দুটো যুক্তাক্ষর আছে।শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে সেটা এই ছন্দে এক মাত্রাই পায়।মধ্যে বা অন্তে যুক্তাক্ষর থাকলে তবেই তা দুই মাত্রা পায়।
অক্ষরবৃত্ত যেমন শব্দগুলোকে গুটিয়ে নিতে চায়,মাত্রাবৃত্ত ঠিক উল্টো ভাবে যুক্তাক্ষরগুলোকে ভেঙে ছড়িয়ে দেয়।মাত্রাবৃত্ত দুই মাত্রা দেয় একটি যুক্তাক্ষরকে।
এসব দেখে মনে হয়,মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে লেখা উচিত মাত্ রাবৃত্ ত ছন্ দ।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গুনতে হবে যুক্তাক্ষরকে দুমাত্রা ধরে।বাকি সব অক্ষর এক মাত্রার।অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যুক্তাক্ষর এক মাত্রা পায়।এটাই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সংগে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রা হিসাবের ফারাক।উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, 'ছন্দ' শব্দটি অক্ষরবৃত্তে ২ মাত্রা কিন্তু মাত্রাবৃত্তে ৩ মাত্রা পাবে।মুক্তদল এক মাত্রা, রুদ্ধদল দুই মাত্রা পায় মাত্রাবৃত্তে।ছন্দ শব্দে 'ছন্ 'হল রুদ্ধদল, ২ মাত্রা পাচ্ছে তাই।আর 'দ ' মুক্তদল, এক মাত্রা পাবে।
মাত্রাবৃত্ত হল মধ্যম লয়ের ছন্দ।স্বরবৃত্তের মত টগবগ করে ছোটে না, আবার অক্ষরবৃত্তের মত গজেন্দ্রগমন ও করে না।
যেমন, নিচের চারটি লাইন দেখুন:-
মনের মানুষ /কপালে কি কারো /থাকে?
চুপিচুপি তাকে /মনেই থাকতে /দাও,
স্বপ্নেরা শুধু/ স্বপ্ন হয়েই /থাকে
স্বপ্নটা ভুলে /বাস্তব মেনে/ নাও।
এখানে ৬/৬/২ মাত্রার মাত্রাবৃত্তের চাল দেখতে পাচ্ছি।স্বপ্ন, শব্দটি তিন মাত্রা পেয়েছে।প্রাথমিক যুক্তাক্ষর-' স্ব' একমাত্রা আর পরের যুক্তাক্ষর 'প্ন' দুই মাত্রা পেয়েছে।
' বাস্তব 'চার মাত্রা পেয়েছে।কারণ যুক্তাক্ষরটি মাঝখানে আছে।যুক্তাক্ষর মাঝখানে বা শেষে থাকলেই দু মাত্রা আদায় করে ছাড়বে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে।শব্দের প্রথমেই যুক্তাক্ষর থাকলে একমাত্রা পাবে।
মাত্রাবৃত্ত চার রকমের হতে পারে।৪ মাত্রা, ৫ মাত্রা, ৬ মাত্রা ও ৭ মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত হয়।
ফাল্গুনে/ বিকশিত/ কাঞ্চন/ ফুল -(৪/৪/৪/২) - এটা হল চার মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত।
এবারে জয় গোস্বামীর দুটি লাইন দেখুন:-
"বেনীমাধব বেনীমাধব তোমার বাড়ি যাব- বেনীমাধব,তুমি কি আর আমার কথা ভাবো?"
বিশ্লেষণ :-
বেনীমাধব /বেনীমাধব/ তোমার বাড়ি/ যাব-(৫/৫/৫/২)- বেনীমাধব/ তুমি কি আর /আমার কথা /ভাবো?(৫/৫/৫/২)
এটা হল পাঁচ মাত্রার চালের মাত্রাবৃত্ত।
এটাকে আমরা ৫/৭ হিসাবেও ভাবতে পারি, শেষ দু মাত্রাকে এক সংগে ধরে।
এবারে ৬ মাত্রার চাল দেখুন মাত্রাবৃত্ত ছন্দে:-
জীবনানন্দ কবিতার কারিগর
এই বাংলায় ধানসিড়িটির তীরে
হয়তো বা হাঁস নয়তো অন্য রূপে
বাংলার কবি ঠিক আসবেন ফিরে।
বিশ্লেষণ :-
জীবনানন্দ /কবিতার কারি/গর(৬/৬/২)
এই বাংলায়/ ধানসিড়িটির /তীরে(৬/৬/২)
হয়তো বা হাঁস /নয়তো অন্য /রূপে(৬/৬/২)
বাংলার কবি /ঠিক আসবেন /ফিরে। (৬/৬/২)
৬ মাত্রার চাল, মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। এটাকেও ৬/৮ হিসাবে বলা যায় শেষ দু মাত্রকে এক সংগে ধরে।
এবারে ৭ মাত্রার চাল:-
সেটা স্পষ্ট ভাবে খোদাই হয়ে আছে
সেটা মরতে গিয়ে আবার বেঁচে ওঠে
তাকে মারব বলে মিথ্যে ছোটাছুটি
সেটা রোজ সকালে পদ্ম হয়ে ফোটে।
বিশ্লেষণ :-
সেটা স্পষ্ট ভাবে /খোদাই হয়ে আছে/(৭/৭)
সেটা মরতে গিয়ে/ আবার বেঁচে ওঠে(৭/৭)
তাকে মারব বলে /মিথ্যে ছোটাছুটি(৭/৭)
সেটা রোজ সকালে /পদ্ম হয়ে ফোটে।(৭/৭)
এটা হল মাত্রাবৃত্ত ছন্দে ৭ মাত্রার চাল।
এমন ৭ মাত্রার চালে আরও চার লাইন লেখা যাক।
সেটা হারিয়ে গেলে/ দারুণ ভাল হত
সেটা অনেক বেশি /কষ্ট বয়ে আনে
সেটা দিনের শেষে/ নিদ্রা কেড়ে নেয়
সেটা কাঁটার মত/ বিঁধেই থাকে প্রাণে।
৭/৭ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত।
এবারে আরও একটা কবিতা দেখুন।
পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণাটা নামে
অনেক না বলা কথা আছে নীলখামে।
ঝর্ণারা মিলেমিশে হয়ে যায় নদী
শুনবে নদীর গান, কান পাতো যদি।
ও নদী কোথায় যাও? ছলছল তানে?
দাও নদী দাও বলে, জীবনের মানে।
ঘন্টার ঠুনঠুন, আজানের সুর;
নদী জলে মিশে যায় সোনারোদ্দুর।
বিশ্লেষণ :-
পাহাড়ের বুক চিরে/ ঝর্ণাটা নামে(৮/৬)
অনেক না বলা কথা/ আছে নীলখামে।(৮/৬)
ঝর্ণারা মিলেমিশে/ হয়ে যায় নদী(৮/৬)
শুনবে নদীর গান, /কান পাতো যদি।(৮/৬)
ও নদী কোথায় যাও?/ ছলছল তানে?(৮/৬)
দাও নদী দাও বলে,/ জীবনের মানে।(৮/৬)
ঘন্টার ঠুনঠুন, /আজানের সুর;(৮/৬)
নদী জলে মিশে যায়/ সোনারোদ্দুর।(৮/৬)
এটা হল ৮/৬ এর মাত্রাবৃত্ত। কিন্তু ৮ মাত্রা কে আমরা দুটি ৪ মাত্রার যোগফল হিসেবে ভাবতে পারি।তাই ৮ মাত্রার চালকে ৪ মাত্রার দুটি চালের সমন্বয় হিসাবে ধরা হয়।উপরের 'ফাল্গুনে বিকশিত/ কাঞ্চন ফুল' এই লাইনটাকেও ৮/৬ হিসাবে বলা যেতে পারত।যেহেতু ৮ মাত্রা দুটি ৪ মাত্রার সমন্বয়, তাই এই ধরনের কবিতাকে চার মাত্রার মাত্রাবৃত্ত হিসাবেই ধরা হয়।চোখে দেখে ' ঘন্টার ঠুনঠুন ' এই পর্বটিকে 'আজানের সুর' এর চেয়ে ছোট মনে হচ্ছে।কিন্তু 'ঘন্টার ঠুনঠুন' ৮ মাত্রার পর্ব।'আজানের সুর' ৬ মাত্রার। এজন্য মাত্রা বিচার খুব জরুরি। একই শব্দ তিন ছন্দে তিন রকম মাত্রার হতে পারে।এবিষয়ে খুব মনোযোগ দেওয়া দরকার।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখার সময় মনে রাখতে হবে এটা মধ্যম লয়ের ছন্দ।যুক্তাক্ষরগুলোকে দুটো আলাদা অক্ষর হিসাবে ধরতে হবে। যুক্তাক্ষরটি শব্দের প্রথমেই থাকলে কিন্তু এক মাত্রা পাবে।এটা মনে রাখা চাই।যেমন:-শ্মশান, স্তবক, শ্বশুর তিন মাত্রা পাবে।চার মাত্রা নয়।কারণ, যুক্তাক্ষর থাকলেও সেটা শব্দের শুরুতেই আছে।মাঝখানে বা শেষে যুক্তাক্ষর থাকলে কিন্তু দু-মাত্রা আদায় করবে এই ছন্দে।এটুকু মনে রেখে ৪/৫/৬/৭ মাত্রার চালে মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখলে ভুল হবার কথা নয়।
সুকুমার রায়ের ৪ মাত্রার একটা মজার মাত্রাবৃত্তের কবিতা দিয়ে আলোচনা শেষ করছি।
সব যেন /বিচ্ছিরি /সব যেন /খালি
গিন্নীর /মুখ যেন /চিমনীর/ কালি।
মন ভাঙা /দুখ মোর /কন্ঠেতে /পুরে
আয় ভাই /গান গাই/ প্রাণফাটা/ সুরে।
মহিলা কবিদের কি হবে জানি না,কিন্তু বেশি কবিতা লিখলে বিবাহিত পুরুষ কবিদের গিন্নীর মুখে চিমনীর কালি দেখা যাবেই।তবু বুকে সাহস রেখে প্রাণভরে মাত্রাবৃত্তে কবিতা লিখুন...