আজ কবিতা পড়া যাক।আগেই বলেছি ছন্দ শিক্ষার জন্য ছন্দে লেখা কবিতার বিশ্লেষণ জরুরী।কবিতা পাঠের সঙ্গে আমরা করব ছন্দ পাঠ।ডাক্তারি শেখার জন্য যেমন মানুষের শরীর কাটা-ছেঁড়া  করতে হয়, সেভাবেই কবিতার কাটা-ছেঁড়াও খুব দরকার কবিতা লেখার জন্য।

একটা কবিতা দেখা যাক।

"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে জ্যোৎস্না করি পান
আধেকলীন অতীতে ওড়ে চন্দ্রযান।
অনিকেত পথে-পথে, গভীর প্রদেশে;
হঠাৎ দাঁড়াচ্ছ তুমি এক চিলতে হেসে।
তুলে আনছি পান্না-হীরে-মুক্তো কিছু কিছু
ইতিহাস জাপটে ধরে, ছাড়ে না তো পিছু।
ভূতকাল ভবিষ্যৎ পাশাপাশি হাঁটে
স্বপ্নবৎ বর্তমান সময়টা কাটে।
দুঃখ-সুখের লব্ধিতে, চক্রব্যূহ পথে
যুযুধান লড়ে চলি অসম দ্বৈরথে।"

কবিতাটি কোন ছন্দের? কি করে বুঝবো?

প্রথম লাইনটি দেখুন।
"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে জ্যোৎস্না করি পান"
প্রথম দুটি তিন অক্ষরের শব্দ।একটিতে যুক্তাক্ষর আছে, আর একটিতে নেই।এটাই বলে দিচ্ছে কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দের।পড়তে গিয়ে আমরা, 'প্রপঞ্চে চকোর-রূপে' এর পরে একটু থেমে যাচ্ছি।যদিও কোনও কমা দেওয়া নেই।
এটাকে বলা হয় কবিতার 'যতি'। আমরা পড়ছি, "প্রপঞ্চে চকোর-রূপে, /জ্যোৎস্না করি পান" মাত্রা বিশ্লেষণ করলে, ৩-৩-২/২-২-২
জ্যোৎস্না শব্দটি দুই মাত্রার।যদিও দেখে তিন মাত্রার মনে হচ্ছে।আসলে,উচ্চারণে গুটিয়ে এটা জ্যোস্না হয়ে যাচ্ছে।
"এক চিলতে হেসে" তে 'চিলতে' দুই মাত্রা পাচ্ছে।তিন নয়।কারণ? সেই উচ্চারণ। 'চিল্তে' হয়ে যাচ্ছে শব্দটা।একই ঘটনা "তুলে আনছি" এর 'আনছি' তে।এটা 'আন্ছি'।
তাই বলে কি ' আনছি' তিন মাত্রা পেতে পারে না অক্ষরবৃত্ত ছন্দে? উওরে বলা যায়, পারে।উচ্চারণ ডিমান্ড করলেই পারে।
'জাপটে' শব্দটাও এখানে 'জাপ্টে' হিসাবে পড়া যায়।তাই দুই মাত্রা পাচ্ছে।
দেখুন,একটা শব্দ, 'কলকাতা'। এটা তিন বা চারমাত্রা দুরকম ভাবেই লেখা যায় অক্ষরবৃত্ত  ছন্দে।যেখানে উচ্চারণে গুটিয়ে 'কল্কাতা' হয়ে যায়, সেখানে তিন মাত্রাই পায় শব্দটি।

"উচ্চারণ ভেদে হয় মাত্রাভেদ ভ্রাতা
নাহলে কলকাতা কেন হবে কলকাতা?"

এখানে প্রথম কলকাতা টি ৩ - মাত্রার শব্দ।পরেরটি চার মাত্রার।
এবারে ছন্দ বিশ্লেষণ করা যাক।


"প্রপঞ্চে চকোর-রূপে /জ্যোৎস্না করি পান
৩-৩-২/২-২-২
আধেকলীন অতীতে /ওড়ে চন্দ্রযান।
৫-৩/২-৪
অনিকেত পথে-পথে, /গভীর প্রদেশে;
৪-২-২/৩-৩
হঠাৎ দাঁড়াচ্ছ তুমি/ এক চিলতে হেসে।
৩-৩-২/২-২-২
তুলে আনছি পান্না-হীরে-/মুক্তো কিছু কিছু
২-২-২-২/২-২-২
ইতিহাস জাপটে ধরে, /ছাড়ে না তো পিছু।
৪-২-২/২-১-১-২
ভূতকাল ভবিষ্যৎ /পাশাপাশি হাঁটে
৪-৪/৪-২
স্বপ্নবৎ বর্তমান/ সময়টা কাটে।
৪-৪/৪-২
দুঃখ-সুখের লব্ধিতে, /চক্রব্যূহ পথে
২-৩-৩/৪-২
যুযুধান লড়ে চলি /অসম দ্বৈরথে।"
৪-২-২/৩-৩

দেখা যাচ্ছে ৮/৬ অক্ষরবৃত্তে আছে কবিতাটি।
আধেকলীন শব্দটিকে অক্ষরবৃত্ত 'আধেক্লীন' হিসাবে চার মাত্রার শব্দে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে।এখানে এটি ৫- মাত্রা হিসাবে ধরা হয়েছে।
কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এই সব মারপ্যাঁচ। আর সেটাকে ধরতে পারা কবিতা পাঠে আলাদা মজা এনে দেয়।

আরও একটা কবিতার উপরে ছুরি চালানো যাক।

"বৃষ্টি এলে শিউলিতলায়, ছাতিমগাছের ডালে
মনটা বড় কেমন করে বৃষ্টি-ঝরা কালে।
এখন তুমি অনেকদূরে না জানি কোনখানে,
ভিজছো কিংবা গুনগুনিয়ে সুর তুলেছো গানে।
তোমার গানের সেই সুরটাই বৃষ্টি হয়ে এসে
টাপুরটুপুর পড়ছে ঝরে মেঘকে ভালবেসে।
মেঘ বিরহী,কান্নাটা তার বৃষ্টি হয়ে ঝরে
তোমার বুঝি মেঘ দেখলেই আমায় মনে পড়ে?"

এটা কোন ছন্দ?
দেখাই যাচ্ছে সুরটা আগের চেয়ে নরম।পড়াও যাচ্ছে অনেক দ্রুত।শ্বাসাঘাত আছে প্রতি প্রথম মাত্রায়।তাহলে এটা স্বরবৃত্ত।
বিশ্লেষণ করা যাক।

বৃষ্টি এলে /শিউলিতলায়, /ছাতিমগাছের /ডালে
মনটা বড় /কেমন করে /বৃষ্টি-ঝরা /কালে।
এখন তুমি /অনেকদূরে/ না জানি কোন/খানে,
ভিজছো কিংবা/ গুনগুনিয়ে/ সুর তুলেছো /গানে।
তোমার গানের/ সেই সুরটাই /বৃষ্টি হয়ে /এসে
টাপুরটুপুর /পড়ছে ঝরে /মেঘকে ভাল/বেসে।
মেঘ বিরহী,/কান্নাটা তার /বৃষ্টি হয়ে /ঝরে
তোমার বুঝি /মেঘ দেখলেই /আমায় মনে /পড়ে?

এটা ৪/৪/৪/২ মাত্রার স্বরবৃত্ত।এখানে মুক্তদল, রুদ্ধদল সাবাই সামান মাত্রা পেয়েছে।সব দল ১ মাত্রা।তিনটি রুদ্ধদল পাশাপাশি থাকলে কিন্তু চারমাত্রা পায় এই ছন্দে।যেমন, 'সেই সুরটাই' বা 'মেঘ দেখলেই',  এখানে দল তিনটি কিন্তু মাত্রা চার।'সেই',  'লেই' ইত্যাদি দলের শেষে স্বরবর্ণ আছে।কিন্তু এরা রুদ্ধ দল।কারণ,এখানে 'এ-ই',  দুটি স্বরবর্ণ পাশাপাশি আছে এবং একক প্রচেষ্টায় উচ্চারিত হচ্ছে।এটা হল যৌগিক স্বর।যৌগিক স্বরকে রুদ্ধদল ধরা হয়।

এভাবে যত বেশি কবিতা কাটা-ছেঁড়া  করা যাবে তত ভাল কবিতার ডাক্তার বা কবি হওয়া যাবে।আধুনিক গদ্য কবিতাতে ছন্দের অনেক জটিল মারপ্যাঁচ লুকিয়ে থাকে।ধীরে ধীরে প্রবেশ করা যাবে সেই রাজ্যেও।