বাংলা কবিতার তিনটি প্রধান ছন্দ।স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত তাদের একটি।আজকের আলোচনা স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখার সহজ উপায় বিষয়ে।
এর আগে কবিতার ক্লাসে দল বা সিলেবল বিষয়ে আলোচনা করেছি।দল বা সিলেবল হল ছন্দের প্রাণ।আর ছন্দে চোখের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় কান।তাই কোনো লাইন দেখতে ছোট বা বড় হলেই সেটা বেমানান নয়, কান যদি বেমানান বলে, তবে সেটাই শুনতে হবে।
দল দুই প্রকার।মুক্তদল আর রুদ্ধদল।স্বরবৃত্ত ছন্দে সব দল সমমাত্রিক। কোনটা মুক্তদল, আর কোনটা রুদ্ধদল? কি করে চিনব?
খুব সহজ।যে দলের শেষে স্বরবর্ণ থাকে সেটাই মুক্তদল।আর যে দলের শেষে ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে সেটা রুদ্ধ দল।
যেমন - 'বাজনা বাজে' বাক্যাংশটিতে বাজ, না, বা, জে এই চারটি দল আছে।এর মধ্যে প্রথমটি হল রুদ্ধ দল।বাকিগুলো মুক্ত দল।
বাজ্+ না+বা+জে = ১+১+১+১= ৪ মাত্রা।
স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে গেলে কোনটা কোন দল, সেটাও জানার দরকার নেই।শুধু দলের বা সিলেবেলের ধারনাটুকুই যথেষ্ট একদম ঠিকঠাক ছন্দ মেনে স্বরবৃত্তে লেখার জন্য।
এবারে দেখা যাক কিভাবে লেখা হবে।
কবিতার প্রথম লাইনটাই আপনাকে বলে দেবে কবিতাটা কোন ছন্দে লেখা হবে।কারণ, এটা বলা হয়, first line comes from God!
যদি প্রথম লাইনটা স্বরবৃত্ত ছন্দে আসে তো পুরো কবিতাটা স্বরবৃত্ত ছন্দেই লেখা উচিত।নইলে ভাতের বদলে খিচুড়ি রান্না হয়ে যাবে।
এবারে প্রশ্ন, কি করে বুঝব, প্রথম লাইনটা কোন ছন্দে এসেছে?
এটা একটু শক্ত।তিন ছন্দ সম্পর্ক এ প্রাথমিক ধারণা না থাকলে এটা বের করা শক্ত।
যদি দেখা যায় তিন অক্ষরের শব্দের পাশে তিন অক্ষরের শব্দ এসে বসেছে, তাহলে আন্দাজ করা যেতে পারে কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আসছে।যেমন -' হাজার বছর ধরে আমি পথ...' এমনি প্রথম লাইন মনে এলে বুঝতে হবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে।সেখানে নিয়ম হবে বিজোড়ে বিজোড় গাঁথ, জোড়ে গাঁথ জোড়।অর্থাৎ তিনের পাশে তিন, দুই এর পাশে দুই অক্ষরের শব্দ।
যদি দেখা যায় প্রথম লাইনে যুক্তাক্ষর যুক্ত শব্দ এসেছে, বা লাইনটা মধ্যম লয়ের তাহলে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে ধরতে হবে।যেমন, 'ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল' এমন প্রথম লাইন এলে ধরে নিতে হবে কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে আসছে।
আর যদি দেখা যায় লাইনটা খুব দ্রুত পড়া যাচ্ছে, ছড়ার মত দোলা আছে, তাহলে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা আসছে বুঝতে হবে।
আজ শুধু স্বরবৃত্ত ছন্দের আলোচনা করছি।তিন ছন্দের আলোচনা পড়ার পরে এই ব্যপারটা ধরতে পারা সহজ হবে।বাস্তবিক, প্রথম লাইনটা দেখে এই ধরতে পারাটা বেশ শক্ত।এর জন্য দরকার ছন্দের নিয়ম মেনে কবিতা পাঠের সংগে ছন্দ পাঠ।আসলে ছন্দপাঠ খুবই আনন্দদায়ক।ছন্দপাঠ করতে শেখা কবি হবার জন্য জরুরি। এমনকি গদ্য কবিতা লেখার জন্যেও।গোটা সংস্কৃত সাহিত্য গদ্যে লেখা, কোথাও অন্তমিল নেই, কিন্তু কি স্পন্দন! কি স্পন্দন!অন্তমিল অনেক সময় কবিতার ভাবকে দুর্বল করে, কিন্তু ছন্দের স্পন্দন হল কবিতার প্রাণ। তাই ছন্দকে ছুঁড়ে ফেলা শক্ত।বরং ছন্দকে ছুঁয়েই লিখতে হবে কবিতা।
ছড়ার ছন্দ স্বরবৃত্ত চলে চার মাত্রার ছোট ছোট চালে।ঘোড়ার মত টগবগিয়ে ছুটতে থাকে এই ছন্দ। শ্বাসাঘাত প্রধান এই ছন্দ নৃত্যচপল ছন্দস্পন্দনে স্পন্দিত।এই কবিতার দলে স্বরবর্ণের বিশেষ করে ই বা এ কারের প্রাধান্য দেখা যায়।
যেমন:-
'টগবগিয়ে /টগবগিয়ে /ছন্দ চলে /ছুটে'... এমনি একটা লাইন লেখা যেতে পারে।এখানে দেখা যাচ্ছে ৪/৪/৪/২ মাত্রার লাইনটা।কিভাবে?টগ, ব, গি, য়ে এই হল চারটি দল।স্বরবৃত্ত ছন্দে যত দল, তত মাত্রা।তাই টগবগিয়ে চার মাত্রা পাবে।
এবারে আমাদের দ্বিতীয় লাইন লিখতে হবে।আমরা লিখতে পারি, টগবগানো/ শব্দে খোকার /ঘুমটা গেল /টুটে।
এটাও ৪/৪/৪/২ এ আছে।
টগ্+ব+গা+নো = ১+১+১+১= ৪ মাত্রা।
শব্ +দে+ খো+ কার= ১+১+১+১= ৪ মাত্রা
ঘুম+টা+ গে+ল=১+১+১+১=৪মাত্রা
টু+টে = ১+১= ২ মাত্রা।
তাহলে কবিতাটা ঠিকঠাক এগোচ্ছে।এভাবে লাইনের পরে লাইন জুড়ে আমরা সঠিক স্বরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখে যেতে পারব।এই ছন্দ ৪/৪/৪/২ বা ৪/৪/৪/১ এ ভাল লেখা যায়।৪/৪ এও লেখা যায়,তবে তাতে ছন্দের দ্রুততা আরো বেড়ে যায়।যেমন, পালকি চলে/ দুলকি চালে/ সাতবেহারা/ জোয়ান তারা। ৪/৪/৪/৪ এখানে লাইনগুলো একটা আর একটার ঘাড়ে এসে পড়ছে। কিন্তু শেষে ওই ১/২ এর ভাঙ্গা মাত্রাটি থাকলে লয়ের দ্রুততা একটু কমে।কবিতাটি সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।
স্বরবৃত্ত এমনিতেই দ্রুত লয়ের ছন্দ।টগবগ টগবগ করতে করতে চলে।সাধারণত ছড়ার ছন্দ হলেও সিরিয়াস কবিতাও লেখা যায় এই ছন্দে।তবে গুরুগম্ভীর কবিতার ছন্দ হল অক্ষরবৃত্ত,স্বরবৃত্ত নয়।
এবারে আরও একটা কবিতা দেখা যাক এই ছন্দে।
তোমরা যাবে নাইট ক্লাবে পরবে ফাটা জিন্স,
আমার ছেলে রিক্সা-পুলার, তোমার ছেলে প্রিন্স।
তোমরা হলে ধূর্ত শেয়াল, আমরা হলাম ফেউ
তোমরা যাবে ডিপ-সী-ট্যুরে, আমরা গুনি ঢেউ।
তোমরা কর পেপার-ওয়ার্ক, আমরা করি কাজ,
পুড়ছি রোদে, ভিজছি জলে, পড়ছে মাথায় বাজ।
তোমরা চাপ এ. সি. গাড়ি, আমরা ধরি ট্রেন
আসতে যেতে চেপ্টে-চিড়ে, হস্তে হেরিকেন ।
তোমারা হলে রাঘব-বোয়াল, তোমরা বানাও জোট
আমরা মশাই খেটেই মরি দিই তোমাদের ভোট ।
তোমরা পর হিরের চুড়ি, আমরা বানাই ঘট
বাড়ছে তোমার টাকার পাহাড় আমরা তো হ্যাভ-নট।
এবারে বোঝাই যাচ্ছে কবিতাটা ৪/৪/৪/১ মাত্রায় লেখা স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা।কারণ, লয় দ্রুত।জীবনানন্দ দাসের 'আবার আসিব ফিরে'র মত মন্থর তান নেই এতে।বরং ছটফটান ভাব আছে।এটাই স্বরবৃত্ত চেনার উপায়।আর তার পরেই ওই ৪/৪/৪/১ বা ২ দল কে খুঁজতে হবে।পেয়ে গেলেই বাজিমাত। কনফার্ম স্বরবৃত্ত। মাত্রা গোনা খুব সহজ এই ছন্দে।যত দল, তত মাত্রা।একমাত্র ব্যতিক্রম তিনটি রুদ্ধদল পাশাপাশি থাকলে তখন চার মাত্রা ধরা হয়।
ছন্দ বিশ্লেষণ :-
তোমরা যাবে /নাইট ক্লাবে/ পরবে ফাটা /জিন্স,৪/৪/৪/১
আমার ছেলে /রিক্সাপুলার /তোমার ছেলে /প্রিন্স।৪/৪/৪/১
তোমরা হলে /ধূর্ত শেয়াল,/ আমরা হলাম /ফেউ ৪/৪/৪/১
তোমরা যাবে /ডিপ-সী-ট্যুরে, /আমরা গুনি/ ঢেউ।৪/৪/৪/১
তোমরা কর/ পেপার-ওয়ার্ক,/ আমরা করি /কাজ,৪/৪/৪/১
পুড়ছি রোদে, /ভিজছি জলে,/ পড়ছে মাথায় /বাজ।৪/৪/৪/১
তোমরা চাপ /এ. সি. গাড়ি,/ আমরা ধরি /ট্রেন ৪/৪/৪/১
আসতে যেতে /চেপ্টে-চিড়ে, /হস্তে হেরি/কেন ।৪/৪/৪/১
তোমারা হলে /রাঘব-বোয়াল, /তোমরা বানাও /জোট ৪/৪/৪/১
আমরা মশাই /খেটেই মরি/ দিই তোমাদের /ভোট ।৪/৪/৪/১
তোমরা পর/ হিরের চুড়ি/ আমরা বানাই/ ঘট ৪/৪/৪/১
বাড়ছে তোমার/ টাকার পাহাড় /আমরা তো হ্যাভ-/নট।৪/৪/৪/১
সব ক্ষেত্রেই কিন্তু যতগুলো সিলেবেল বা দল আছে তত মাত্রা হয়েছে।দল বা সিলেবেল হল এই ছন্দের প্রাণ।আরও একটু ভেঙ্গে দেখাচ্ছি :-
আসতে যেতে /চেপ্টে-চিড়ে, /হস্তে হেরি/কেন ৪/৪/৪/১
আস+ তে+ যে+তে = ৪ মাত্রা
চেপ+টে + চি+ড়ে= ৪ মাত্রা
হস+তে+ হে + রি= ৪ মাত্রা
কেন্=১ মাত্রা।
এভাবে কবিতাটি পড়তে হবে।কবিতা পাঠের সংগে সংগে চলবে ছন্দপাঠ।
আর একটি কবিতা দেখা যাক।
যখন বৃষ্টি নামলো, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা।
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাব দেখা।
হয়তো মেঘে- বৃষ্টিতে বা শিউলি গাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে-- অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!
ছন্দ বিশ্লেষণ :-
বৃষ্টি নামলো /যখন আমি /উঠোন-পানে /একা ৪/৪/৪/২
দৌড়ে গিয়ে /ভেবেছিলাম /তোমার পাব /দেখা।৪/৪/৪/২
হয়তো মেঘে- /বৃষ্টিতে বা/ শিউলি গাছের /তলে ৪/৪/৪/২
আজানুকেশ/ ভিজিয়ে নিচ্ছো /আকাশ-ছেঁচা/ জলে ৪/৫/৪/২
কিন্তু তুমি /নেই বাহিরে-- /অন্তরে মেঘ /করে ৪/৪/৪/২
ভারি ব্যাপক/ বৃষ্টি আমার/ বুকের মধ্যে /ঝরে!৪/৪/৪/২
দেখা যাচ্ছে নির্ভুল স্বরবৃত্ত ছন্দে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় কবিতাটি লিখেছেন।৪/৪/৪/২ এর একটি ভারি সুন্দর কবিতা এটি।
খ্যতিমান কবিদের কবিতা ছন্দ মেনেই লেখা।সেগুলো পাঠের সময়ে আমরা এবারে ছন্দপাঠ করতে চেষ্টা করব।এভাবেই একদিন সঠিক ছন্দে কবিতা আসবে সব কবির কলমে।আর ছন্দ পাঠ একবার করতে শিখলেই বুঝতে পারা যাবে, তা কবিতা পাঠের চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক।
বি.দ্র.:- আসরের অনেকেই ছন্দ জানেন। যারা ছন্দে সুপণ্ডিত, তাদের জন্য এই আলোচনা নয়।যারা ছন্দ জানেন না, বা জানলেও কবিতা লেখার সময়ে সঠিক ছন্দের তাল রাখতে পারেন না, তাদের জন্যই এই আলোচনা।ছন্দের বই বাজারে অনেক আছে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এসব বই যারা লিখেছেন, তারা ছান্দসিক, কবি নন।কবিতা ছন্দ মেনে কিভাবে লিখতে হয় তেমন বই একমাত্র কবিরাই লিখতে পারেন।প্রাথমিকভাবে ছন্দ শিখতে আমার প্রচুর হোঁচোট খেতে হয়েছে।বই পড়ে ছন্দ শেখার পরে কবি বিকাশ নায়কের সান্নিধ্য আমার অনেক উপকারে এসেছে।বিকাশদা ছন্দ শেখেন কবি শঙ্খ ঘোষের থেকে। তখন থেকেই বুঝতে পারি শুধু বই পড়া নয়,ছান্দসিক অধ্যাপক নয়, ছন্দ জানা কবির সান্নিধ্য বা আলোচনা কত উপকারী।যদি আসরের এক জন কবিরও লেখাটা উপকারে আসে, আমার শ্রম সার্থক হবে।