মহাশক্তির আরাধনায় দেবী বন্দনা
শ্রী শ্রী মহানবমী পূজা (পৌরাণিক গল্প)
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
রামচন্দ্রের হয়ে রাবণ বধের জন্য ব্রহ্মা দেবীর বোধন করেছিলেন আশ্বিনের কৃষ্ণা নবমী তিথিতে। ব্রহ্মা বলেছিলেন, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা নবমী তিথিতে আমরা সংকল্প করছি যতদিন পর্যন্ত না রাবণ বধ হয় ততদিন পর্যন্ত আমরা তোমার পুজো করে যাব। এরপরই দেবী তুষ্ট হন। বলেন, নবমীর অপরাহ্ণেই রাবণ বধ হবে।
পুরাণ মতে দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে রত তখন তাঁর দুই সেনা চন্ড ও মুন্ড দেবীকে আক্রমণ করে। তখন দেবী দুর্গার তৃতীয় নয়ন থেকে এক দেবীর আবির্ভাব হয় যিনি চন্ড ও মুন্ডকে বধ করেন। এই কারনে দেবীর নাম হয় চামুন্ডা। সন্ধিক্ষণে আসলে দেবী চামু-ারই পূজা হয় ১০৮ পদ্ম ও ১০৮ প্রদীপ জ্বালিয়ে। তাছাড়া পদ্মফুলের জন্ম পাঁকে। কিন্তু, তবুও পদ্মফুল পাঁক থেকে ওঠে গায়ে পাঁকের দাগ না নিয়ে। পদ্ম আসলে এই ইঙ্গিতই দেয় যে পরিবেশ শেষ কথা নয়। খারাপ পরিবেশে জন্মেও অনেক ভালো কাজ করা যায়, যেমন পাঁকে জন্মে পদ্ম পূজার আবশ্যিক অঙ্গ। হিন্দু শাস্ত্র মতে ১০৮ সংখ্যাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেবতাদের থাকে অষ্টোত্তর শতনাম। ১০৮ পদ্ম, ১০৮ প্রদীপ।
আমাদের সমস্ত তিথি-নক্ষত্র হিসাব করা হয় চন্দ্রের অবস্থান দেখে। সেই অনুযায়ী মাসের তিরিশ দিনকে শুক্ল ও কৃষ্ণ এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মহানবমী এই শুক্লা নবমী যাকে শাস্ত্রে বলে ‘উগ্রপদা’। নবমী তিথিতে মানুষের নাকি উত্তেজনা বাড়ে অর্থাৎ মানুষের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা বাড়ে, অশুভত্বের দিকে মানুষ নবমীতে বেশী ঝুঁকে যায়। কিন্তু, এই অশুভত্বকে বিনাশ করে শুভশক্তির জয়ের জন্য আমরা সেই দেবী দুর্গারই শরণ নেই। তাই এই মহানবমী তিথিকেই অন্য নবমী তিথির মধ্যে শুভ ধরা হয়। জপ, তপ, উপাসনা এইসব তাই এই তিথিতে বেশি করে করতে বলা হয়।
পূজা বিধি
এমনিতে তো দুর্গা পূজা বিধি খুবই জটিল। কিন্তু, তার খানিকটা এখানে বলা হল।
সন্ধিপুজো
নবমী তিথি শুরুই হয় সন্ধিপুজো দিয়ে। আমরা সবাই জানি যে সন্ধিপুজো হয় অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর সূচনার প্রথম ২৪ মিনিট জুড়ে। মূলত দেবী চামুন্ডার পূজা হয় এই সময়ে। একশো আটটি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ও একশো আটটি পদ্মফুল নিবেদন করা হয় দেবীর চরণে। নিবেদন করা হয় রান্না করা ও কাঁচা সবজি, ফল ইত্যাদিও।
অঞ্জলি
অষ্টমীতেই মূলত অঞ্জলি দেওয়া হয়, সেটাই প্রশস্ত। কিন্তু, নবমীতেও অঞ্জলি দেওয়া হয়ে থাকে। আসলে অষ্টমী এই ক’দিনের তুঙ্গ মূহুর্ত বলেই এই দিনে সাধারণত দেওয়া হয় অঞ্জলি। নবমীর অঞ্জলির আলাদা কোনো নিয়ম নেই, তা অষ্টমীরই মতো। তিনবার পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে প্রণাম করতে হয়,
‘ওঁ সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে
শরণ্যে ত্রম্ব্যকে গৌরী নারায়ণী নমস্তুতে’ ইত্যাদি মন্ত্রে।
হোম-যজ্ঞহোম-যজ্ঞ
নবমীর বিশেষত্ব যদি কিছু থাকে তা হল এই হোম-যজ্ঞ অনুষ্ঠানের মধ্যে। নবমীতেই মূলত হোম হয়ে থাকে, ব্যতিক্রমী নিয়মও থাকতে পারে। মূলত আঠাশটা বা একশো আটটা নিখুঁত বেলপাতা লাগে। বালি দিয়ে যজ্ঞের মঞ্চ বানিয়ে বেলকাঠ ঠিকভাবে নিয়মমতো সাজিয়ে পাটকাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে ঘি’তে চুবিয়ে বেলপাতাগুলো নিবেদন করা হয়। তারপর সবার শেষে একটি কলা চেলীতে বেধে পান নিয়ে সেটা ঘি’তে চুবিয়ে পূর্ণাহুতি দেওয়া হয়। তারপর তার মধ্যে দই দেওয়া হয় ও দুধ দিয়ে আগুন নেভানো হয়।
যূপকাষ্ঠে ছাগ বলিদান
শাস্ত্র মতে, নবমীর দিন মায়ের পূর্ণাঙ্গ পুজো হয় বলে, এই তিথিতে বলি, হোম এবং ষোড়শ উপাচারের বিধান রয়েছে। এই বলিদান মহা নবমীর একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। মূলত মা দুর্গাকে সন্তুষ্ট করতে এবং তাঁর আশীর্বাদ পেতে করা হয়। অনেকেই ভাবেন বলি সাধারণত অষ্টমীতেই হয়। কিন্তু না, বলিদানের রীতিটি কেবল নবমীতেই সঞ্চালিত হয়। শাস্ত্র মতে, সন্ধি পুজোর প্রথম দণ্ড অর্থাৎ ২৪ মিনিট পার হওয়ার পরেই হয় বলি। সহজ করে বলতে গেলে, নবমী তিথি শুরু হওয়ার প্রথম ২৪ মিনিটের মধ্যে হয়।
প্রাচীন যুগে এই দিনে মায়ের কাছে পশু বলি হলেও, বর্তমান দিনে পশু বলি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। তাই এখন কুমড়ো, লাউ, আখ, শসা বা কলা ইত্যাদি বলিতে ব্যবহার করা হয়।
সবারে করি আহ্বান। আসুন, মহাশক্তির আরাধনায় আমরা সকলেই সমবেতভাবে দেবীর সম্মুখে প্রার্থনা করি, অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হউক। বাংলা কবিতা আসরের সকল কবি ও সহৃদয় পাঠকগণকে জানাই শুভ দুর্গাপূজার আন্তরিক শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!!!
মহাশক্তির আরাধনায় দেবী বন্দনা
শ্রী শ্রী মহানবমী পূজা (চতুর্থ পর্ব)
কলমে- কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
মহা নবমীর পূজা খ্যাত চরাচরে,
হাসি খুশি কলরব সারাদিন ধরে।
পূজার মণ্ডপে জমে ভিড় চারিধার,
বিধিমতে পূজা হয় শাস্ত্র অনুসার।
মন্দিরেতে পুরোহিত বসিয়া আসনে,
করিছেন মন্ত্রপাঠ ভক্তি শুদ্ধ মনে।
সুগন্ধি চন্দন ধূপ বরণের ডালা,
দেবীর সম্মুখে ঘটে থাকে ফুলমালা।
হোম যজ্ঞ পূজাপাঠ শাস্ত্রের বিধান,
যজ্ঞ শেষে যূপকাষ্ঠে ছাগ বলিদান।
পশুরক্তে দেবীপূজা এ কেমন পূজা,
ছাগ বধে তুষ্ট নাহি হন দশভূজা।
শুন শুন বিশ্ববাসী বচন আমার,
পশুহত্যা বন্ধ হোক কহিলাম সার।
রক্তসিক্ত দেবালয় মন্দির প্রাঙ্গণ,
মহা নবমীর কাব্য লিখিল লক্ষ্মণ।