প্রত্যেক বছর কার্তিক মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা পালন করা হয়। এই রীতির নেপথ্যেও কিন্তু আছে বিশেষ কারণ। কথিত আছে, এই ভাইফোঁটার প্রথা শুরু হয়েছে মৃত্যুর দেবতা যম ও তাঁর বোন যমুনার সম্পর্কের হাত ধরে। এই তিথিতে যমরাজ তাঁর বোন যমুনার থেকে ফোঁটা নিয়েছিলেন। এই উৎসবকে তাই অনেকে 'যমদ্বিতীয়া'ও বলে থাকেন । আবার অন্য একটি মতবাদ বলছে, শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করার পরে তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দিয়েছিলেন সযত্নে। সেই থেকেই নাকি ভাইফোঁটার উৎপত্তি। ভাইফোঁটার দিনে দিদি বা বোনেরা তাদের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে মঙ্গল কামনা করেন। শুরুতে প্রদীপশিখা, ধান-দূর্বা, আতপ চাল, পানে বরণ করা হয় ভাইদের। তার পরে বাঁ হাতের কনিষ্ঠা বা কড়ে আঙুল দিয়ে ভাইয়ের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া হয়। কিন্তু কেন বাঁ হাত ও কড়ে আঙুলই ব্যবহার করা হয়?
এর ব্যাখ্যা আছে সনাতন হিন্দু শাস্ত্রে। মনে করা হয়, হাতের পাঁচটি আঙুল পঞ্চ ভূতের প্রতীক। এই পঞ্চ ভূত হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। কনিষ্ঠা বা কড়ে আঙুল হল ব্যোম অর্থাৎ আকাশ বা মহাশূন্যের প্রতীক। আবার মনে করা হয়, ভাই ও বোনের সম্পর্ক আকাশের মতোই উদার, অসীম ও অনন্ত। তাই আকাশের প্রতীক হিসেবে বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়েই ফোঁটা দেওয়ার রীতি চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে।
ভগিনীরা চন্দন কাঠ জল দিয়ে ঘষে (কেউ কেউ দইও মিশ্রিত করেন চন্দন কাঠের সাথে), নিজের কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে ভ্রাতার কপালে নিচের মন্ত্রটি পড়তে পড়তে তিনবার ফোঁটা দিয়ে দেয়। ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে-
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।।
যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়ে
যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা নিয়ে
আমার ভাই হোক অমর।
এ বছর ৩ নভেম্বর ২০২৪ (রবিবার), ভাইফোঁটার সময়কাল ২ ঘণ্টা ১১ মিনিট। দুপুর ১টা ১০ মিনিটে ভাইফোঁটার শুভ সময় শুরু । যা শেষ হবে ৩টে ২২ মিনিটে।
ভাইফোঁটা উত্সব (বিবিধ কবিতা)
কলমে- কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ভাইফোঁটা দিবসে ভগিনী ফোঁটা দেয়,
ভ্রাতা ভগিনীর কাছে ভাইফোঁটা নেয়।
ভ্রাতৃ দ্বিতীয়ায় তাই ভারি ধূম পড়ে,
হাসি খুশি কলরব, প্রতি ঘরে ঘরে।
আপন ভ্রাতার শিরে ধান্য দূর্বা দিয়ে,
ললাটে চন্দন ফোঁটা প্রদীপ জ্বালিয়ে।
আজিকার শুভক্ষণে যদি দেয় ফোঁটা,
যমের দুয়ারে জানি পড়িবেক কাঁটা।
ভ্রাতৃ-দ্বিতীয়ার দিন পূণ্য তিথি কয়,
ঘরে ঘরে ভাইফোঁটা ভারি ধূম হয়।
সুগন্ধিত ধূপ দীপ নানা উপহার,
ভগিনীরা ফোঁটা দেয় ললাটে ভ্রাতার।
আজিকার দিনে যদি বোন ফোঁটা দেয়,
সাধ্য কার ভাই তার যম কেড়ে নেয়।
ধান্য দূর্বা ফুল দিয়ে, নিয়ে আশীর্বাদ,
কপালেতে দেয় ফোঁটা পুরে মনোসাধ।
সুমিষ্টান্ন ফলমূল বিবিধ প্রকার,
ভগিনী প্রদান করে হস্তেতে ভ্রাতার।
সবশেষে গুঁয়াপান দেয় বিধিমতে,
সারাদিন আলাপন ভ্রাতার সহিতে।
জ্বলে দীপ শঙ্খ বাজে পূণ্য শুভক্ষণে,
ভায়ের কপালে ফোঁটা দেয় সযতনে।
চন্দনের ফোঁটা দেয় ভ্রাতার ললাটে,
সারাদিন ভাইফোঁটা হর্ষে দিন কাটে।
ভ্রাতা করে ভগিনীরে নব বস্ত্র দান,
দিনেদিনে ভ্রাতা পায় অর্থ যশ মান।
আয়ুবৃদ্ধি হয় শুভক্ষণে ফোঁটা দিলে,
গ্রহদোষ নষ্ট হয়, চিত্তে শান্তি মিলে।
ঘরে ঘরে ভাইফোঁটা বিধিমতে হয়,
শুভদিনে ফোঁটা দিলে কাটে যমভয়।
ভ্রাতৃভালে দেয় ফোঁটা ভগিনীসকল,
বিধাতার কাছে চাহে ভ্রাতার মঙ্গল।
ধান্য দূর্বা ধূপ দীপ, সুগন্ধি চন্দন,
সুমিষ্টান্ন দ্রব্য কত করে আয়োজন।
ধান্য দূর্বা শিরে দেয় কপালে চন্দন,
ভাইবোনে ওঠে গড়ে প্রীতির বন্ধন।
উপহার বিনিময় ভাই-বোন মিলে,
আয়ুবৃদ্ধি হয় বোন ভাইফোঁটা দিলে।
ভাইবোনে গড়ে ওঠে স্নেহের বন্ধন,
ভাইফোঁটা কাব্য লিখে শ্রীমান লক্ষ্মণ।
=================================
মনে রাখবেনঃ-
ভাইফোঁটার সময় আসন পেতে ভাইকে বসিয়ে দিন। মনে রাখবেন ভাইয়ের মুখ যেন পূর্ব দিকে থাকে। তারপর ভাইয়ের কপালে টিকা লাগান ও ভাইয়ের হাতে লাল সুতো বেঁধে দিন। এরপর প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাইয়ের আরতি করুন এবং তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করুন। ভাইফোঁটার দিন বোন ও ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে অশান্তি ঝামেলা এড়িয়ে চলবেন। ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া উপহারকে বোনেদের অবশ্যই সম্মান দেওয়া উচিত। বোনেরা ভাইকে টিকা পড়াবার আগে উপোস থাকবেন। এই দিনে ভুলেও বোন এবং ভাই কেউ কাউকে যেন মিথ্যা না বলে। ভাইকে ফোঁটা দেওয়ার সময় বোনদের কালো কাপড় পরা উচিত নয়। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পবিত্রতম দিবসে সারা বিশ্বের সব দিদিদের জানাই ভক্তিপূর্ণ প্রণাম আর
বোনের জন্য রইল আমার শুভাশীর্বাদ। সবাই ভালো থাকুন। জয়গুরু!