আজ সবার আগে গুরুদেবের পূজা ও প্রেমের শান্তির বাণী দিয়ে আমার লেখা শুরু করবো। পূজা ও প্রেম ই তো কবিদের আরাধ্য দেবতা। পূজা ও প্রেম না থাকলে কবিতা রচনা কি সম্পূর্ণতা পেতে পারে ?
" বোস্-না ভ্রমর, এই নীলিমায় আসন লয়ে
অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু মাখা হয়ে।
যেখানেতে অগাধ ছুটি মেল সেথা তোর ডানাদুটি,
সবার মাঝে পাবি ছাড়া ॥"
গত শতাব্দীর চারের অথবা পাঁচের দশকে, বাংলা কবিতায় এক বিভাজনের প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিলো। অন্যভাবে বলতে গেলে, কবিদের মধ্যে এক বিভাজন বলাই বোধয় বেশি সমীচীন হবে। কবিদের দুটি দলে যদি বিভক্ত করা যায় তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায়। একদল কবি, যারা সমাজসচেনতার কথা সুস্পষ্ট লিখেছেন তাঁদের কবিতায়, আর এক দলের কবির আত্মমগ্নতা, যা প্রায়শ বাস্তবতা থেকে দূরবর্তী প্রান্তে অবস্থান করেছে। আসলে একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আদৌ এ বিভাজনের কোনো ভিত্তি আছে কিনা অথবা যদি থেকেও থাকে তাহলে শ্বাশত সৃষ্টির অমোঘতার নিরিখে তার আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়।
কবিতা যে শুধু তত্ত্বভিত্তিক হতে হবে এমন কোনো কথা আছে কি ? অবশ্যই নয়। কবিতা সবসময় তত্ত্বভিত্তিক বা শিক্ষামূলক হয়না। অনেকসময় দেখা যায় যে খুব ভালো একটি রাজনৈতিক কবিতাও অরাজনৈতিক হয়ে যায়। কারণ কবিতার প্রয়োজনের তাগিদে সেটা হতে হয়।
যেমন এরিক ফ্রাইড( Erich Fried ) (6 মে 1921 - 22 নভেম্বর 1988) ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত কবি, লেখক এবং অনুবাদক। তিনি প্রাথমিকভাবে তার রাজনৈতিক কবিতার জন্য জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া উভয় দেশেই বিস্তৃত জনসাধারণের কাছে পরিচিত লাভ করেছিলেন। যদিও তার কবিতাগুলো ছিল মূলত রাজনৈতিক , কিন্তু তাতে তাঁর আত্মমগ্নতার প্রতিফলন ও একইসঙ্গে নিহিতভাবে জীবনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। অনেক প্রেমের কবিতাতেও রাজনীতির ব্যাপারটা আশ্চর্য ভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে।
কবি যখন কবিতা লেখেন, তিনি অর্ধেক লেখেন, বাকিটা লেখে নিয়তি। কারো এক একটা কবিতা কোনো এক মুহূর্তে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। আবার যদি কোনোদিন একই ধরণের কবিতা লিখতে যান , তখন আর সেই দৈবী মুহূর্ত আর আসেনা। অর্থাৎ কবিতা মাত্রই একটা মুহূর্তের দৈবপ্রেরিত সৃষ্টি।
তাইতো জীবনানন্দের কথায় উচ্চারিত হলো। .....
"পৃথিবীর দেয়ালের পরে
আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে
একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা
সে সব ব্যর্থতা
আলো আর অন্ধকারে গিয়াছে মুছিয়া"
আবার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার অবয়ব পরিবর্তিত হতে থাকে। বয়স যত বাড়তে থাকে ততই কিছু না কিছু শান্ত স্থিতিশীলতার উপলব্ধি আসে যার প্রতিফলন হতে থাকে কবিতায়। যৌবনের সেই বিদ্রোহ, বিপ্লবিদ্রোহ ক্রমে ক্রমে কবিতার মধ্যেও নিষ্প্রভ হতে থাকে।
ঈশ্বর কবির চেতনাতে শুধু দূরবর্তী কোনো আরাধ্যমাত্র নয়। ঈশ্বর কবির আলিঙ্গনে এসে ধরা দেয়, অথবা দিতে পারেন, অন্তত কবি সে আখাঙ্খাই করে।
" আল্লা বুড়ো আল্লা এই গুল্মরের গাছ ,
তাঁর খুব উঁচু ডাল মহম্মদ পয়গম্বর।
দুজন দাঁড়িয়ে, দেখি চাঁদ আর সূর্য দুই তাজ,
তাঁদের মাথায়, কিন্তু আমাকেই নিয়ে যায় ঝড়। "
সার্থক এক কবির মগজে বিশ্বাসের যে বীজ প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল তারুণ্যের আদিলগ্ন থেকে, এ কবিতাটি তারই প্রতিফলন।
"তাঁর বুকে যাবো বলে একেবারে হয়ে যাবো নিচু ,
আমি যার একটি বউল, দায়ী একটি বউলে
তাঁর বুক ভরে দেব, আমায় কি ভাব,
আল্লা আমি হাসিমুখে কবরে চলে যাবো। "
এ লেখাটিতে দেখুন জীব ও পরমের অযুতসিদ্ধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেছেন কবি। এ এমনি এক আদ্যন্ত জাগতিক, যাকে অনায়াসে স্পর্শ করা যায়। সুনীল গাঙ্গুলি থেকে শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চ্যাটার্জি সবাইকার কবিতায়, এমনকি জীবনচর্চাতেও ঈস্বরচেতনার কাব্যিক উচ্চারণ প্রায়শ কবিমহলে চর্চার বিষয় হয়ে উঠতো।
আজও 'জল পড়ে পাতা নড়ে’ মনের মধ্যে কেমন যেন গুঞ্জনের সৃষ্টি করে। এ হলো একধরনের সুখানুভূতির কাব্যিক প্রকাশ। হূদয়ে একটি কাব্যময় অবস্থার কল্পনায় অতি সহজেই নিমজ্জিত হয়ে যেতে হয়। তাইতো ছন্দ শিখতে হয় প্রকৃতির কাছে।কল্পনাকে সত্যে রূপান্তরিত করে দিতে পারে সহজ সরল শব্দের ব্যবহার।
উপসংহার:-
নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে এলেই হবে কবিতা শিল্পের মুক্তি। বাঙালির কবিতাপ্রীতি যেন বাঙালির ললাটে শুভচিহ্ন নিয়ে ফিরে আসে এই কামনা নিয়ে আমার এই রচনার ইতি টানলাম।
শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও ভালোবাসায় ভালো থাকুন সবাই। ধন্যবাদ।