বিশ্বায়ন অর্থাৎ "গ্লোবালাইজেশন" শব্দটি অর্থনৈতিক বিশ্বের থেকে ধীরে ধীরে জীবনের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে বিস্তার করেছে পাঠকের মনকে। অনেকটা যেন যৌথ পরিবার ব্যবস্থা। এনে দিয়েছে পারস্পরিক আস্থা ও উন্নত প্রযুক্তি । এই কথাটা এখন খুব প্রচলিত যে গোটা পৃথিবী জুড়ে এখন 'একটা গ্রাম ' । তার মানে পুরো পৃথিবীটা আমাদের। কিন্তু সমস্যা হলো এখানেই যে আমরা তার অন্তর্গত নই ।
যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করা যায় তাহলে দেখতে পাই আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা যা বিশ্বায়ন আমাদের করে দিয়েছে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অকাব্যিক। কবিতা একটা হৃদয়ের ব্যাপার। এই বিশ্বায়ন পদ্ধতিতে কবিতার উল্লেখযোগ্য কোনো স্থান নেই ।
বিশ্বায়ন ও কবিতা সম্পূর্ণভাবে পরস্পরবিরোধী । আজ এই বৈশ্বিক গ্রামে উৎপন্ন হয়েছে শুধু ব্যাথা ,বেদনা , মানসিক আঘাত ও যন্ত্রনা। আধুনিকতার অনেক দুর্ভাগ্য জড়িয়ে পড়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। কবিতা এমন একটা মন্ত্র যে মানুষের অস্তিত্বের মহিমা অক্ষত রাখে।কবিতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবনের সারাংশ। আজ এই বিশ্বায়নের 'ডলার' কবিতার জন্যে হয়ে উঠেছে শ্বাসরোধকারী। এই আত্মার ব্যথা কবিকে করে তুলেছে অকাব্যিক। আকাশচুম্বী অট্টালিকার নীচে কোলে তার শিশুটিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তার মা দুমুঠো খাবার তুলে দেবার জন্যে। আধুনিকতার দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। এই নিষ্ঠুর পরিস্থিতি দেখার পরে কবির মনকে হত্যা করে তার কাব্যিকতাকে। আজকের এই বিশ্বের নিষ্ঠুরতা , জ্বলজ্বলে অসমতা , বিদ্রুপ ইত্যাদি কবির লেখনীকে করছে নির্মমভাবে হত্যা। বিশ্বায়নের কারণে বাংলা ভাষার সৃজনশীল লেখা লোপ পেতে চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা হারাতে বসেছি বাক্যের সৌন্দর্য , আবেগের গভীরতা , বাচনের আন্তরিকতা। নিজের মাতৃ ভাষা ছাড়া সম্ভব কি মনের গভীরতার প্রকাশকে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা ? কবিতা লিখতে গিয়ে যখন শব্দ হারিয়ে যায় চিন্তার ভান্ডারটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উধাও হয়ে যায়। আধুনিক কবিতায় এমন একটা ফাঁকের সৃষ্টি হয়েছে যে তা পূরণ করা যাচ্ছেনা।
একদিন কবিতার এমন একটা শক্তি ছিল যখন কবিতা আনতে পারতো বিশ্বে পরিবর্তন। কবিতার দ্বারা অনেক রাজা মহারাজা সিংহাসন পর্য্যন্ত হারিয়েছেন। আমাদের প্রিয় কবি নজরুল এর কথাই ভাবুন। | শুধু একটি "বিদ্রোহী" কবিতা শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে থাকা গিলে করা পাঞ্জাবি পরিহিত বাবুটিকে পর্য্যন্ত টেনে রাস্তার মিছিলে আনতে সক্ষম হয়েছিল।
ভাবুন ইতালিও চিকিৎসক কবি GIROLAMA. FRACASTORO. (1478 - 1553) র কথা। তাঁর রচিত কবিতা "সিফিলিস" সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই অত্যন্ত বিপদজনক যৌন সংক্রামক রোগটি সম্বন্ধে সারা বিশ্বকে সাবধান করে দিলেন শুধুমাত্র ওই একটি কবিতার দ্বারা।
কবিতার যা কিছু দায় তাতো জীবনেরই কাছে। এই অগ্রগতির যুগে আমরা হারাতে বসেছি আমাদের কাব্যিক আত্মা ,সৌজন্য ,মহানুভবতা ও আত্মত্যাগ। সৌন্দর্য্যের জগৎ থেকে ছিটকে পড়ছি ধীরে ধীরে।