আসুন প্রথমে পরিচয় করিয়ে দিই এই দুই মহান কবির সঙ্গে।
১) কবি টমাস স্টেয়ার্ন্স এলিয়ট অর্থাৎ সংক্ষেপে টি এস এলিয়ট
জন্ম: ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮,সেন্ট লুইস, মিশৌরি,আমেরিকা
মৃত্যু ৪ জানুয়ারি ১৯৬৫ (বয়স ৭৬) কিংস্টন, ইংল্যান্ড
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার: সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার (১৯৪৮), অর্ডার অফ মেরিট (১৯৪৮)
এলিয়ট, আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম কবি, সাহিত্য সমালোচক, নাট্যকার, এবং সম্পাদক।
২) কবি এজরা পাউন্ড
জন্ম :৩০ অক্টোবর ,১৮৮৫
মৃত্যু : ১ নভেম্বর, ১৯৭২
এজরা পাউন্ডকে সাধারণত কবিতায় আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ব সংজ্ঞায়িত ও প্রচারের জন্য কবিকে সর্বাধিক দায়বদ্ধ মনে করা হয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, তিনি ব্রিটিশ এবং আমেরিকান লেখকদের মধ্যে কাজ এবং ধারণার একটি চূড়ান্ত বিনিময় শুরু করেছিলেন এবং তিনি উদারতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন যার সাথে তিনি ডব্লিউবি ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের মতো বড় সমসাময়িকদের কাজকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। , মেরিয়েন মুর, এইচডি, জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং বিশেষত টিএস এলিয়ট।
এই দুই মহান কবির যুগলবন্দিতে সৃষ্টি হলো কোন কবিতাটি?
‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’।
কবিতার নাম এলিয়ট দিয়েছিলেন ‘হি ডু দ্য পুলিশ ইন ডিফরেন্ট ভয়েসেস’ (HE DO THE POLICE IN DIFFERENT VOICES)। এজরা পাউন্ড কে যখন কবিতাটি সম্পাদনার জন্যে দিলেন তখন প্রথমেই 'কবিতার শিরোনাম পাল্টে রাখেন ‘The waste land’—বাংলায় ‘পড়ো জমি’। ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ই হয়ে উঠেছে বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবিতার অন্যতম একটি।
কবিতাটি পড়ে এজরা পাউন্ডের মন্তব্য :- 'আমার দেখা কোনো আমেরিকানের লেখা মহত্তম কবিতা।’
টি. এস. এলিয়ট ও এজরা পাউন্ড এই দুই কবির যুগলবন্দীতে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতার হাড়, মেদ, মজ্জা কে অস্ত্রপ্রচার করে পূর্ণাঙ্গ অবয়ব তৈরী হলো। এলিয়টের হাতে জন্ম নেয়া এ কবিতা পাউন্ডের রূপসজ্জায় পাঠকের মঞ্চে এসে দাঁড়ায় ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে।কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সাহিত্যের আকাশে এক নতুন ঝড় উঠলো। পাউন্ডের ইচ্ছাতেই এলিয়ট দীর্ঘ এই কবিতাটি তার কাছে রেখে চলে যান সুজারল্যান্ড এ ছুটি কাটাতে। এজরা পাউন্ড কবিতাটির উপর অস্ত্রপ্রচার চালিয়ে কাটছাঁট করে ৪৩৩ লাইনে নামিয়ে আনেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বিমানবিকীকরণের প্রতিবাদে টি. এস. এলিয়েট এক শ্বাশত ঐতিহ্যের সন্ধানে এবং তৎকালীন আত্মসংকট থেকে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষায় রচনা করেন তার দীর্ঘ কবিতা ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’। দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে। সে মাসেই এলিয়ট তার এক বন্ধু আমেরিকান আইনজীবী ও শিল্পপৃষ্ঠপোষক জন কুইনের কাছে এজরা পাউন্ড সম্পাদিত ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর পাণ্ডুলিপি সামান্য দামে বিক্রি করে দেন। যদিও জন কুইন তার বাজার দর হিসেবে মূল্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এলিয়ট তা আমেরিকার পত্র-পত্রিকা ও প্রকাশনীর কাছে পৌঁছে দেবার শর্তে সামান্য মূল্যে উপহার হিসেবে জন কুইনের হাতে তুলে দেন। এর দু’বছর পর ১৯২৪ সালে জন কুইন অপ্রত্যাশিতভাবে মৃত্যুবরণ করলে কবিতার পাণ্ডুলিপির হদিস পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত জন কুইনের স্টোর রুম থেকে এটিকে উদ্ধার করে ১৯৫০ সালের দিকে এই পাণ্ডুলিপিটি ‘নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি’ কর্তৃপক্ষের হাতে আসে। কর্তৃপক্ষ এই তথ্য অপ্রকাশিত রাখেন দীর্ঘদিন। ১৯৬৮ সালে এলিয়টের মৃত্যুর তিন বছর পর নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি এই তথ্য প্রকাশ করে। তারপর ১৯৭১ সালে এলিয়টের দ্বিতীয় স্ত্রী ভ্যালেরি এলিয়টের সম্পাদনায় আবার ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ প্রকাশিত হয় নিউইর্কের হারকোর্ট প্রকাশনী থেকে। প্রশ্ন জাগে মনে আজও এই কবিতাটি কেন এতো সমাদৃত ? কারণ ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ একক, নিরবলম্ব ও স্বকীয় চরিত্রে বিশ্বসাহিত্যে অনন্য।‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতাটি প্রকাশের আগে এজরা পাউন্ড যেভাবে অস্ত্রোপচার করে একে পরিশীলিত ও পরিবিন্যস্ত করেছেন, তা এখন বিশ্বপাঠকের কাছে অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠেছে—বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর কবি, সমালোচক ও গবেষকদের কাছে।
দীর্ঘ এই কবিতাটি রচিত হতে থাকে ১৯২১ সালের শেষ দিকে লন্ডনের মার্গেট শহর এবং সুইজারল্যান্ডের লাউসান শহরের স্বাস্থ্যনিবাসে ভ্রমণকালে। যেখানে এলিয়ট মাস দুয়েক লন্ডনভিত্তিক লয়েড ব্যাংকে চাকুরিরত অবস্থায় চিকিৎসার ছুটিতে ছিলেন। এলিয়ট এই ছুটিকে আখ্যায়িত করেছেন ‘স্মৃতিভ্রংশ, বিশৃংখল আবেগগত শুশ্রূষা’ হিসেবে।
কবিতাটি সুষমা, বোধ ও সৌন্দর্যের মহত্তে পৌঁছে গেছে। অত্যন্ত যত্ন, নিষ্ঠা আর পরিশ্রম করে কবি এলিয়টের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এজরা পাউন্ড ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতাটি সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ করেছেন। বিশ্বসাহিত্যে সম্পাদনা রীতির একটি নতুন শিল্পকে উন্মেচিত করেছে। একটি কবিতা শুধু যে কবির নিজস্ব সম্পদ তা নয়, তা হয়ে উঠতে পারে দেশ, জাতি বা কালাত্তীর্ণ, এই কথাটি প্রমাণিত হলো এজরা পাউন্ডের এই যৌক্তিক ও গঠনমূলক সম্পাদনা। এজরা পাউন্ড সে কাজটিই সম্পন্ন করেছেন এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতার ক্ষেত্রে।এলিয়টের প্রশংসা করতে হবে এই জন্যে যে, তাঁর রচিত কবিতার ওপর যেভাবে সম্পাদনার কাঁচি চালিয়েছেন পাউন্ড, তা বিচক্ষণতার সঙ্গে মাথা পেতে নিয়েছিলেন তিনি। সে সঙ্গে পাউন্ডের অভিমত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন কবিতাটির শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। যেমন, পাউন্ড ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এ ব্যবহৃত এলিয়েটর অনেক শব্দগুচ্ছ, দৃশ্যচিত্র, চরিত্র ও ভাষার রূপ পরিবর্তন করে কবিতাটিকে টান টান করে তুলেছেন। যা এলিয়ট সানন্দে মেনে নিয়েছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বস্ত ইউরোপে আধুনিক সংস্কৃতির নামে যে অবক্ষয় নেমেছিল, তারই প্রতিচ্ছবি এই ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতাটি। পাউন্ড কর্তৃক বিশদ সম্পাদনার পর প্রকাশিত এই কবিতায় আবেগের চেয়ে বুদ্ধিদীপ্তির নির্মল ব্যবহার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিশ্বপাঠকের কাছে।
এজরা পাউন্ড অনুভব করতে পেরেছিলেন কবিতায় টি. এস. এলিয়টের আধ্যাত্মিক ও কল্পনাপ্রবণ অবস্থানকে। এটাকে তিনি এলিয়টের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছেন। কবিতাটি সম্পাদনাকালে এ বিষয়কে মূলসূত্র হিসেবে গেঁথে দিয়েছেন কবিতার শরীর ও ভাবে। যা থেকে এলিয়টের কাব্য-বৈশিষ্ট্য একটা স্বতন্ত্র মাত্রা পেয়েছে।
উপসংহার :-
এজরা পাউন্ড ‘The Waste land’ কবিতার ক্ষেত্রে দুটি বড় পরামর্শ দিয়েছিলেন টি. এস. এলিয়টকে। তা হচ্ছে:
এক. কবিতাটি থেকে দীর্ঘ অংশ ও দীর্ঘ বাক্য বাদ দিয়ে ঘন বিন্যাসে সাজানো।
দুই. কবিতার ছন্দ-বিন্যাসকে ভেঙে ফেলা।
এলিয়ট ত্রিকালদর্শীর মতো এ পরামর্শের গভীরতাকে উপলব্ধি করেছেন এবং তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। পাউন্ডের সম্পাদনার এই আস্থার কারণে ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ আজ বিশ্বসাহিত্যের অনন্য সংযোজন।
টিকা :
এলিয়ট বলেন....
‘পোয়েট্রি ইস নট এ টারনিং লুস অফ ইমোসন। বাট ইট ইস অ্যান এস্কেপ ফ্রম ইমোশন। পোয়েট্রি ইস নট অ্যান এক্সপ্রেশন অফ পার্সোনালিটি , বাট অ্যান এস্কেপ ফ্রম পার্সোনালিটি। দোস হু হ্যাভ পারসোনালিটি অ্যান্ড ইমোশন নোস , হোয়াট ইট মিন্স টু ট্রাই টু এস্কেপ ফ্রম দিস থিংস’।
অর্থাৎ কবিতা শুধু আবেগের প্রকাশ নয়। কবিতা বুদ্ধি এবং মেধার মোড়কে মোড়া এক উন্নতমানের সৃষ্টি। আবেগ এবং যা কিছু ব্যক্তিগত তাঁকে প্রকাশ সেই ব্যক্তিই করেন না, যিনি এ দুটির মুল্য জানেন। রোম্যান্টিক কবিদের স্টাইলে চরম আঘাত হানলেন এই কবি। শুরু হল বিংশ শতাব্দীর কবিতার জগতে নতুন ধারা, কবিতা রচনার।