এককথায় যাকে ব্যক্ত করা যায় "প্লেটোনিজম" শ্বব্দটির দ্বারা। ভালোবাসার আরেক রূপ। প্রেমের স্বাদ বা রস আস্বাদন করা যায় শুধু আবেগ দিয়ে, শরীর দিয়ে নয়। এ ভালোবাসা কামগন্ধহীন। যৌনতার কোনও স্থান নেই প্লেটোনিক ভালোবাসায়। এ এক প্রচণ্ড ভালোবাসা যখন প্রেম কে মনে হয় স্বর্গ সুখ। ভক্তির সঙ্গে প্রেমের নিবিড় সম্পর্কটা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন তার হৃদয় দিয়ে।
সালটি ছিল ১৯২৪। আর্জেন্টিনার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্ম নেওয়া ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বয়স তখন ৩৪। ৬৩ বছরের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অর্থাৎ প্রায় ৩০ বছরের বয়সের ব্যবধান। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাবার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বকবি। যার দর্শন প্রতীক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন ওকাম্পো , সেই সুযোগটি মিলে গেলো হঠাৎই। রবীন্দ্রনাথ জাহাজে করে যাচ্ছিলেন পেরু। কবি তখন সারা বিশ্বময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন শান্তিনিকেতনের জন্যে অর্থ সংগ্রহের জন্যে। সমুদ্রযাত্রাও বেশ লম্বা ছিল। বুয়েনোস আইরেসে (আর্জেন্টিনার রাজধানী)গিয়ে কিছুটা অসুস্থ শরীর নিয়ে ওঠেন হোটেল প্লাসাতে। সঙ্গে ছিলেন সহযাত্রী এবং সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্ট। খবরটা পৌঁছে গেলো ভিক্টোরিয়ার কাছে। যার জন্যে এতদিনের দীর্ঘ প্রতীক্ষা, এ সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করা যায়না। সোজা চলে গেলেন হোটেলে প্লাসাতে।
যখন দেখা পেলেন তিনি দেখলেন কবি খুবই অসুস্থ। এই অবস্থায় কবিকে দেখে ওকাম্পোর হৃদয় কষ্টে ভরে গেলো। ঠিক করলেন কবিকে এই অবস্থায় কিছুতেই ফেলে রেখে যাবেন না তিনি হোটেলে। ভিনদেশি কবিকে যে কিভাবে রাজি করাবেন তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে ভেবে কুল পেলেন না। ধরলেন তাঁর সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্ট কে। শেষ পর্যন্ত কবিকে রাজি করানো গেলো। কবিকে নিয়ে এলেন তার আত্মীয়ের বাড়ি মিলারিও ভিলাতে। যেখানে মাত্র দুমাসে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক প্লেটোনিক প্রেম প্লাটা নদীর ধারে। এই দুই মাস কবির জীবনের অবিস্মরণীয় মাস। প্লাটা নদী বোধহয় তাঁদের হালকা কথাপোকথন এবং ভারী নিশ্বাস শুনে নিঃশব্দে প্রবাহিত হচ্ছিলো। বাগানে ছিল একটি বিখ্যাত টিপা গাছ। তার ছায়ায় বসে তাঁর অতিপ্রিয় ভিক্টোরিয়ার নাম দিলেন 'বিজয়া' । চললো বিজয়া কে নিয়ে এক এর পর এক কবিতা রচনা। যে কবিতাগুলি পরে সংকলন করে প্রকাশিত হলো 'পূরবী' এবং সেটি উৎসর্গ করলেন কবি বিজয়া কে। তাঁর পূরবী গ্রন্থে এক তৃতীয়াংশ আর্জেন্টিনার এই দেবদূতের দ্বারা অনুপ্রাণিত। হে বিদেশী এসো এসো। হে আমার প্রিয় , এই কথা স্মরণে রাখিও। তোমা সাথে এক স্রোতে ভাসিলাম আমি হৃদয়স্বামী , জীবনে মরণে প্রভু। ওকাম্পো কবিগুরুকে নিয়ে তাঁর গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার আবেগকে একটি মহান প্রেমের কোমলতা বলে বর্ণনা করেছেন। এ ছিল এমন একটি প্রেম যার মধ্যে আধ্যাত্মিক ছাড়া আর কিছু প্রবেশ করেনি। যা ঠাকুর অতি সুক্ষ ভাবে তার কবিতাতে বর্ণনা করেছেন। ওকাম্পো বাংলা জানতেন না। নেহাত ই কৌতূহল বসে উনি লক্ষ করলেন যে কবিতাগুলো উনি যখন লেখেনা এবং এটি কাটাকুটি করেন তখন মনে হতো ওগুলো একটা আর্ট। ওকাম্পো তাঁকে ব্রাশ ও তুলি দিয়ে ছবি আঁকার জন্যে অনুপ্রাণিত করলেন। এবং তার ফলস্বরূপ হিসেবে ১৯৩০ সালে, ওকাম্পো প্যারিসে কবির প্রথম শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আর সেটাই ছিল কবিগুরু ও ওকাম্পোর মধ্যে দ্বিতীয় এবং শেষ সাক্ষাৎকার।
ওকাম্পো তাঁর একটি চিঠিতে লিখছেন :-
প্রিয় গুরুদেব ,
আপনি চলে যাবার পর থেকে দিনগুলো সীমাহীন। যখন আমরা একসাথে ছিলাম আমরা বেশিরভাগ শব্দ নিয়ে খেলতাম এবং আমাদের সেরা সুযোগগুলোকে হাসানোর চেষ্টা করতাম। যখনই নীড়টি আকাশের ঈর্ষান্বিত প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার নূন্যতম চিহ্ন পাওয়া যায়, আমার মন , পরিযায়ী পাখির মতো দূরের তীরে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
রবীন্দ্রনাথ যেদিন মিলারিওতে পৌঁছান, সেদিনই তিনি ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি লিখেন –
হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম—
‘কী তোমার নাম’,
হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তবে
নামেতে কী হবে।
আর কিছু নয়,
হাসিতে তোমার পরিচয়।
হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে বুকের কাছে ধরে
শুধালেম ‘বলো বলো মোরে
কোথা তুমি থাকো
হাসিয়া দুলালে মাথা, কহিলে ‘জানি না, জানি নাকো’।
বুঝিলাম তবে
শুনিয়া কী হবে
থাকো কোন দেশে
যে তোমারে বোঝে ভালোবেসে
তাহার হৃদয়ে তব ঠাঁই,
আর কোথা নাই।
চৌত্রিশ বছর বয়স্ক ভিক্টোরিয়া তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথকে দেখে মুগ্ধতা নিয়ে লিখেছিলেন,
… প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। … তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। শ্মশ্রুমণ্ডলে মুখের নিচের দিকটা আড়াল, আর তারই ফলে উপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তার সমগ্র মুখায়ববের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব। শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর বৈপরীত্যে জ্বলে উঠছে তাঁর চোখের সজীবতা। …
উপসংহার:-
রবীন্দ্রনাথের সাথে তার পরিচয় হয় সাহিত্যের হাত ধরেই। তবে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে চেনার আগে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটে ভিক্টোরিয়ার। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হতে থাকে ‘গীতাঞ্জলী’। ভিক্টোরিয়ার হাতে এসে পড়ে গীতাঞ্জলীর ইংরেজি, স্প্যানিশ ও ফরাসি অনুবাদ। এর মধ্যে আঁদ্রে জিদের ফরাসি ভাষায় করা গীতাঞ্জলীর অনুবাদ ছিল তার প্রিয়। গীতাঞ্জলী পড়ে রবীন্দ্রনাথের একজন ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের লেখা তাকে এতটাই ছুঁয়ে গিয়েছিল যে, তিনি সেসময়ে ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’ নামে একটি লেখাও লিখে ফেলেন।