বাঙালির মনের ভেতর দুটো দিন অন্তরে গেঁথে গেছে | ২৫ শে বৈশাখ আর ২২ শে শ্রাবন | এই দুটি দিনের সঙ্গে যেন বাঙালির কেমন এক নিবিড় সম্পর্ক হয়ে গেছে | আমাদের কাছে এই দুটি দিন অমূল্য রত্নস্বরূপ |
এই দুটি দিনকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে আছে কবিগুরুর কিছু ঘটনা ও বিশিষ্টতা | তারই কিছু তুলে ধরার প্রয়াসে এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা | শুরু করি তাঁর জন্মদিনের (২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮ )কিছু ঘটনা দিয়ে | তাঁর জীবনের শেষ গান "হে নুতন দেখা দিক আরবার" | এটা শুধু শেষ গান নয় শেষ জন্মদিনের গান |
১৩৪৮ সালে কবিগুরু দেহত্যাগ করেন | কবিগুরু তখন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শান্তিনিকেতনে শয্যাশায়ী | ১৩৪৮ সালে সমস্ত বাংলাদেশ সহ গোটা দেশে এবং বিদেশে বাঙালিরা যেন অন্যভাবে মেতে উঠেছিল কবিগুরুর জন্মোৎসব নিয়ে | এই শেষ গানটির কথা বলতে গিয়ে আসুন প্রথমে পরিচয় করিয়ে দিই রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছের লোক শ্রী শান্তিদেব ঘোষ এর সঙ্গে | শান্তিদেব ঘোষ কবিগুরুর শেষ বয়সে তাঁর গানের স্বরলিপি তৈরী করার ভার নিয়েছিলেন | তাঁর কিছু কথা তাঁর নিজের মুখে শোনা যাক |
"শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছি | তিনি জিজ্ঞাসা করলেন পঁচিশে বৈশাখ এখানে কি হবে ? কথাবার্তায় বুঝলাম সেই জন্মদিন উপলক্ষ করে নৃত্যগীত ইত্যাদির আয়োজন হোক |জন্মদিনের আগে একদিন সন্ধ্যায় প্রশ্ন করি উৎসবের দিনে "আবার যদি ইচ্ছা করো" গানটা কি গাইবো ?
তিনি বললেন 'তুই বেছে নে,আমার জন্মদিনের গান আমি বেছে দেব কেন ?'
পরের দিন সকালে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম "আপনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষে কবিতা লিখেছেন,অথচ একটা গান রচনা করবেন না,এটা ঠিক মনে হয়না | এবারের ২৫ শে বৈশাখে সমস্ত দেশ আপনার জন্মোৎসব পালন করবে,তাই এইদিনে একটা গান রচনা না করলে জন্মদিন অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয়না |
শুনে বললেন তুই আবার এক ফরমাশ এনে হাজির করলি | আমি নিজের জন্মদিনে নিজে গান রচনা করছি,লোকে আমাকে বলবে কি ? সবাই ঠিক ধরে ফেলবে আমি নিজে নিজেকে প্রচার করছি |এখানে যারা বড় বড় কবি আছে তাঁদের দিয়ে গান লিখিয়ে নে | আমি হাসতে লাগলাম | তিনি বললেন 'কেন তাঁরা কি কবিতা লিখতে পারেন না মনে করিস ?' উত্তরে বললাম 'আপনি থাকতে অন্যদের কাছে যাবার কি প্রয়োজন?' রাজি হয়ে জন্মদিনের কবিতাগুলি সব খুঁজে আনতে বললেন দপ্তর থেকে | 'পঁচিশে বৈশাখ'
কবিতাটির {পূরবী} ' হে নূতনদেখা দিক আরবার' অংশটি কিছুটা রদবদল করে সুর সংযোজনা করলেন |
সেদিন ছিল ২৩ শে বৈশাখ | পরের দিন আবার আমার গলায় গানটি শুনে বললেন 'হ্যাঁ এবারে ঠিক হয়েছে '|
সেদিন একথা খুনাক্ষরেও মনে হয়নি এই তাঁর জীবনের সর্বশেষ গান |"
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর রচিত প্রথম জন্মদিনের গান ১৩০৫ সালে আটত্রিশ বছর বয়েসে লেখা |
"ভয় হতে তব অভয় মাঝে
নুতন জন্ম দাও হে "
আসলে এই জন্মদিনটি হবার কথা ছিল মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে অর্থাৎ মংপুতে (মংপু দার্জিলিঙের কাছে ছোট একটা গ্রাম |) কিন্তু কবি অসুস্থ হয়ে পরাতে সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি | তাই শেষবারের মতো তিনি মংপুতে যান ১৩৪৭ সালে এবং সে বছর তাঁর জন্মদিন পালন হয়েছিল সেখানেই | জন্মদিন নামক তিনটি কবিতা সেদিন তিনি রচনা করেছিলেন |
তার শেষটিতে আছে -----
অপরাহ্নে এসেছিলো জন্মবাসরের আমন্ত্রণে
পাহাড়িয়া যত|
একে একে দিলো মোরে পুষ্পের মঞ্জরী
নমস্কার সহ
ধরণী লভিয়াছিলো কোন ক্ষণে
প্রস্তর-আসনে বসি'
বহু যুগ বহ্নিতপ্ত তপস্যার পরে এই বর,
এ পুষ্পের দান
মানুষের জন্মদিনে উৎসর্গ করিবে আশা করি |
প্রায় তিনশত মজদুর সেই জন্মদিনের উৎসবে যোগ দিয়েছিলো |স্থানীয় মজদুরের ছেলেমেয়েরা নৃত্যগীতের দ্বারা সে উৎসব আনন্দে ভরিয়ে তুলেছিল |
আরো একটি জন্মদিনের কবিতা ------
কাল প্রাতে মোর জন্মদিনে
এ শৈলআতিথাবাসে
বুদ্ধের নেপালি ভক্ত এসেছিলো মোর বার্তা শুনে,
ভূতলে আসন পাতি '
বুদ্ধের বন্দনামন্ত্র শুনাইল আমার কল্যানে ,-
গ্রহণ করিনু সেই বাণী |
কবিগুরুকে হৃদয়ের প্রণাম নিবেদন করে এই লেখা শেষ করলাম |
(এর পরের পর্বে লিখবো ২২ শে শ্রাবন | কারণ এখানে লিখতে গেলে অনেক বড় হয়ে গিয়ে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা থাকবে)